ভোজ্যতেলের হাহাকার কাটছে না
বাজারে ভোজ্যতেলের হাহাকার যেন কাটছে না। ঈদের আগে সংকটের কথা বললেও ক্রেতারা বাড়তি দামে সয়াবিন তেল কিনতে পেরেছেন। তবে ঈদের পর বাজারে নেই।
শুক্রবার নতুন দাম কার্যকর করার পরও নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটি কিনতে ক্রেতা এক বাজার থেকে অন্য বাজারে ছুটছেন। এমন পরিস্থিতিতে সরবরাহ নেই বলে খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা মিল মালিকদের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন। আর মিল মালিকরা বলছেন-ঈদের আগ থেকেই মিল থেকে স্বাভাবিকভাবে তেল সরবরাহ করা হচ্ছে। এমন পালটাপালটি বক্তব্যে বাজারে তেল না পেয়ে ভোক্তাদের নাজেহাল হতে হচ্ছে।
এদিকে বাজারে দু-একটি দোকানে সোনার হরিণ হয়ে যাওয়া এই রান্না করার তেল পাওয়া গেলেও তা খুচরা বিক্রেতাদের আগের মজুত করা। দাম বাড়বে, এমন তথ্যের ভিত্তিতে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মজুত করেছেন। আগের দামে কিনলেও এখন ক্রেতাদের জিম্মি করে বিক্রি করছেন বাড়তি দরে। এদিকে যারা তেল মজুত করেছেন তারা কেউ দোকানের পেছনে আবার কেউ দোকানের ভেতরে বস্তা ও কাটুনে লুকিয়ে রেখেছিলেন। এমন তথ্যের সত্যতা মিলেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বাজার তদারকির সময়।
দুপুর আড়াইটা, রাজধানীর নয়াবাজারে সয়াবিন তেল নেই। বিক্রেতাদের কাছে ক্রেতারা গেলেই নেই শব্দটি বলে বিদায় করে দিচ্ছেন। সেখানে কথা হয় তেল কিনতে আসা সোবাহান শিকদারের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, রায়সাহেব বাজারে গিয়ে তেল পাইনি। তাই নয়াবাজারে এসে খোঁজ নিচ্ছি। কিন্তু নেই। বিক্রেতারা পাঁচ লিটারের বোতল দেওয়া তো দূরের কথা, এক লিটারের বোতলও দিতে পারছে না। সরাসরি বলে দিচ্ছে তেল নেই। তিনি বলেন, সবার কাছে তেল আছে। কিন্তু বেশি দামে বিক্রি করবে বলে বিক্রেতারা তেল দোকানে উঠাচ্ছে না।
রাজধানীর জিনজিরা কাঁচাবাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানে পাঁচ লিটারের সয়াবিনের বোতল একেবারেই নেই। দুই-এক দোকানে এক লিটারের বোতল মিললেও বিক্রি হচ্ছে ২১০ টাকায়। যা বৃহস্পতিবার সরকারের পক্ষ থেকে ১৯৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া কয়েকটি দোকানে খোলা সয়াবিনও বিক্রি হয়। সেখানে প্রতিলিটার বিক্রি হয়েছে ২০০ টাকা। যা ১৮০ টাকা নির্ধারণ করা আছে। ওই বাজারের মুদি ব্যবসায়ী সাক্কুর আলম যুগান্তরকে বলেন, তেলের দাম বাড়বে এমন তথ্যের ভিত্তিতে কিছু অসাধু খুচরা ব্যবসায়ী আগে থেকে মজুত করেছেন। তখন কম দামে কিনলেও এখন ক্রেতাদের জিম্মি করে বেশি দরে বিক্রি করছেন। যা কখনো ঠিক নয়। তিনি জানান, ঈদের আগ থেকেই দাম বাড়ানোর জন্য মিল থেকে তেল সরবরাহ করা হচ্ছে না। ঈদের পর তা মারাত্মক আকার ধারণ করে। এখন পরিস্থিতি বাজারে তেল নেই।
এদিকে রাজধানীর কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় সকাল থেকেই ক্রেতারা এক দোকান থেকে অন্য দোকানে ছুটছেন তেল কেনার আশায়। কিন্তু তেলের দেখা নেই। কথা হয় কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকার বাসিন্দা মো. ইসহাকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ঈদের আগে দোকানিরা তেলের সংকট সৃষ্টি করলেও ২২০ টাকা দরে খোলা সয়াবিন কিনতে পেরেছি। কিন্তু ঈদের পর আর তেল নেই। বিক্রেতারা বলছেন, মিল থেকে সরবরাহ বন্ধ। তেল নিয়ে এমন অবস্থা তৈরি হবে তা ভাবিনি। যে যেভাবে পারছে পকেট কাটার জন্য ক্রেতাদের ভোগান্তিতে ফেলছে। আর নীতিনির্ধারকরা কাঠের চশমা পরে সব দেখছেন।
একই এলাকার বাসিন্দা মো. ইব্রাহিম যুগান্তরকে বলেন, সারাদিন পাড়া-মহল্লার এক দোকান থেকে অন্য দোকানে ঘুরে অবশেষে ২ লিটার খোলা তেল কিনতে পেরেছি। তাও প্রতি লিটার ২০০ টাকা করে। এটা কোনো বাজার ব্যবস্থাপনা হতে পারে না। যে যেভাবে পারছে সেভাবেই দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। দেখার যেন কেউ নেই।
রাজধানীর মৌলভীবাজারের পাইকারি তেল বিক্রেতা মো. হাকিম বলেন, মিল থেকে সরবরাহ নেই। যে কারণে তেল নিয়ে দেশে এমন অবস্থার তৈরি হয়েছে। মিল মালিকরা দাম বাড়ানোর জন্য এমনটা করছে। তবে আমার প্রশ্ন তারা সরকারকে সঙ্গে নিয়ে তেলের দাম বাড়িয়ে নিল। তারা তেল নিয়ে অরাজকতা করলেও সরকার তাদের শাস্তির বদলে অতি মুনাফা করার সুযোগ দিল। কিন্তু তারপরও মিল মালিকরা তেল দিচ্ছে না। নতুন দামের তেল তারা বাজারেই ছাড়েনি। তারা বলছে ঈদের ছুটিতে ব্যাংক বন্ধ। আগামীকাল (রোববার) ব্যাংক খুললে ডিও (চাহিদাপত্র ) যদি কেউ তাদের হাতে দেয় এরপর মিল থেকে তেল পাওয়া যাবে।
তবে মিল মালিকরা বলছেন-ঈদের আগ থেকে যেভাবে তেল সরবরাহ করা হচ্ছে, এখনো সেভাবেই মিল থেকে তেল সরবরাহ করা হচ্ছে। পণ্যটি নিয়ে মিল থেকে কোনো ধরনের কারসাজি হচ্ছে না। যা কারসাজি করছে খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতা। জানতে চাইলে ভোক্তা অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার যুগান্তরকে বলেন, তেল নিয়ে সব পর্যায়ে তদারকি চলছে। তদারকিকালে দেখা গেছে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে তেল থাকলেও তারা দোকানের পেছনে কিংবা দোকানের ভেতরে বস্তা ও কাটুনে তেল লুকিয়ে রেখেছেন। এমন পরিস্থিতিতে সেই তেল বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য করাসহ অসাধুদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তবে তেল নিয়ে কারসাজি আর সহ্য করা যাবে না। তাই তদারকি জোরদার করে সমস্যা সমাধান করা হচ্ছে। এ সময় কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠান সিলগালাসহ অসাধুদের জেলে দেওয়া হবে।
দশমিনা ও দক্ষিণ (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি জানান, পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার হাটবাজার থেকে সয়াবিন তেল উধাও গেয়ে গেছে। ঈদের কয়েকদিন আগ থেকে শনিবার পর্যন্ত উপজেলার হাটবাজারগুলোতে ভোজ্যতেলের চরম সংকট। সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৩৮ টাকা বৃদ্ধি করে ১৯৮ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও তা মানছে না স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। উপজেলার দু-চারটি দোকানে তেল পাওয়া গেলেও তার দাম রাখা হচ্ছে লিটারপ্রতি ২১০ টাকা দরে। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন নিুআয়ের মানুষ।
চরফ্যাশন দক্ষিণ (ভোলা) প্রতিনিধি জানান, চরফ্যাশনে হঠাৎ সয়াবিন তেলসহ সবজির মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। একদিনের ব্যবধানে সয়াবিন তেলের মূল্য ৪০ টাকা বৃদ্ধিতে নিু ও মধ্যবিত্ত পরিবার হতাশ হয়ে পড়েছে। বাবসায়ীদের দাবি, তেল ও সবজির সরবরাহ কম থাকায় দাম বাড়তি। এ ছাড়া পরিবহণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় দামে প্রভাব ফেলেছে। ফলে বাজারে আগে বোতল তেল প্রতিলিটার ১৬০ টাকা বিক্রি হলেও বর্তমানে ২০৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে। আর খোলা সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকা।
শনিবার বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়-জনগণ নয়, সিন্ডিকেটের স্বার্থ রক্ষায়ই ভোজ্যতেলের মূল্য বৃদ্ধি করেছে সরকার। ঈদের আগে ভোজ্যতেলের সংকট তৈরি করে একটি সিন্ডিকেট জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। সরকার তাদের শাস্তি প্রদান না করে তেলের মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে পুরস্কৃত করল।