অধিগ্রহণ করা জমিও বেহাত হচ্ছে
সরকারের উদাসীনতায় অধিগ্রহণ করা জমি বেহাত হচ্ছে। এসব জমি আবার অবাধে বেচাকেনাও হচ্ছে। এর পেছনে সংশ্নিষ্ট ভূমি ও এসিল্যান্ড অফিসের কর্মকর্তা এবং স্থানীয় অসাধু ব্যক্তিদের যোগসাজশ রয়েছে। জমির ক্রেতা-বিক্রেতাদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে অন্য ব্যক্তির নামে নামজারি করার চাঞ্চল্যকর ঘটনা উঠে এসেছে ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। ওই নিরীক্ষায় গাজীপুর সদর উপজেলার বাসন ইউনিয়নে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের জন্য অধিগ্রহণ করা জমি বেহাত হওয়ার ঘটনা ধরা পড়ে। এই জমির পরিমাণ খুব বেশি না হলেও অপরাধটি বড় ও নজিরবিহীন। গাজীপুর জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে ওই ইউনিয়নে অধিগ্রহণ করা ৬০ শতাংশ জমি সওজের নামে নামজারি হয়নি।
ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গাজীপুর সদর উপজেলা এসিল্যান্ড অফিস, সদর ভূমি অফিস ও বাসন ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা এবং প্রভাবশালীদের যোগসাজশে সরকারের অধিগ্রহণ করা ওই জমি বেহাত হচ্ছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের হিসাব নিয়ন্ত্রকের (রাজস্ব) দপ্তরের নিরীক্ষা টিমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জয়দেবপুর থেকে দেবগ্রাম-ভুলতা-মদনপুর সড়ক নির্মাণের জন্য প্রথম ধাপে ৪৭ একর ৬২ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এই জমির এলএ কেস নম্বর ৩/৯৮-৯৯। পরে অধিগ্রহণের গেজেটও প্রকাশ করা হয়। ওই ৪৭ দশমিক ৬২ একর জমির মধ্য থেকে ৪৭ দশমিক শূন্য ২ একর জমি সড়কের কাজে ব্যবহারের পর বাসন ইউনিয়নের ভোগড়া মৌজার ৩০ ও ৫২নং দুটি খতিয়ানে ২০০ ও ৫৪৩ নম্বর দুটি দাগে অবশিষ্ট ৬০ শতাংশ জমি রয়ে যায়।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের হিসাব নিয়ন্ত্রক (রাজস্ব) মশিউর রহমান সমকালকে বলেন, জমি অধিগ্রহণের পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সরকারের সংশ্নিষ্ট সংস্থার নামে নামজারি করা হলে এসব সম্পত্তি বেহাত হওয়ার সুযোগ থাকবে না। যথাসময়ে নামজারি না হওয়ায় ওই জমি বারবার কেনাবেচা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতারাও প্রতারিত হচ্ছেন। যে কোনো সময় ওই জমি সরকারের দখলে আনা হতে পারে। তখন এই জমি যারা কিনেছেনে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তিনি আরও বলেন, এসিল্যান্ড অফিস ও ভূমি অফিসের যেসব কর্মকর্তা জালিয়াতি করে ব্যক্তির নামে নামজারি করিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ভূমি অধিগ্রহণ ম্যানুয়াল অনুযায়ী গেজেট প্রকাশের ৯০ দিনের মধ্যে যে সংস্থার নামে অধিগ্রহণ করা হয় (প্রত্যাশী সংস্থা) সেই সংস্থার নামে নামজারি করতে হয়। এ ক্ষেত্রে সওজের নামে ওই জমির নামজারি করার কথা ছিল। এই নামজারির দায়িত্ব সদর উপজেলা এসিল্যান্ড অফিস ও জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও যথাসময়ে কাজটি করা হয়নি। ভূমি অধিগ্রহণ ম্যানুয়ালে গেজেট প্রকাশের ৯০ দিনের মধ্যে প্রত্যাশী সংস্থার নামে নামজারি করে সংশ্নিষ্ট সংস্থা ও ভূমি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার বিধান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো নিয়মই মানা হয়নি।
সূত্র জানায়, গাজীপুরের হিসাব তত্ত্বাবধায়ক (রাজস্ব) আনিসুর রহমানের নেতৃত্বে একটি নিরীক্ষা দল সম্প্রতি গাজীপুর সদর উপজেলা ভূমি অফিসের বিভিন্ন নথি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। হঠাৎ করেই সামনে চলে আসে ভূমি অধিগ্রহণের (এলএ) ৩/৯৮/৯৯ নম্বর কেসটি। ওই কেসটির আওতায় বাসন ইউনিয়নের ভোগড়া মৌজায় দুটি খতিয়ান ও দুটি দাগে সরকার সড়কের জন্য ৪৭ একর ৬২ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করেছে। ওই এলএ কেসের বিপরীতে বাসন ইউনিয়ন ভূমি অফিসের নথি নিরীক্ষাকালে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। ওই ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের হিসাব নিরীক্ষাকালে
নিরীক্ষকদের হাতে চলে আসে সড়কের জন্য ব্যবহারের পর অবশিষ্ট থাকা ৬০ শতাংশ জমি বেহাতের তথ্য-প্রমাণ।
জানা গেছে, ৪৭ একর ৬২ শতাংশ জমি অধিগ্রহণের সময় এই চার মালিককে সরকার ক্ষতিপূরণ বাবদ ১৫ লাখ ২৮ হাজার ৪৬৯ টাকা প্রদান করে। এর মধ্যে মোসা. খাতুন নেছাকে ৩ লাখ ৮২ হাজার ১১৭ টাকা, মো. কফিল উদ্দিনকে ১ লাখ ৫২ হাজার ৮৪৭ টাকা, মোসা. নূরজাহান বেগমকে (রেখা) ৭ লাখ ৭৫ হাজার ৯৫৩ টাকা ও মোসা. হাজেরা বেগমকে ২ লাখ ১৭ হাজার ৫৫২ টাকা দেওয়া হয়।
অধিগ্রহণের ৯০ দিনের মধ্যে প্রত্যাশী সংস্থার নামে নামজারি না করায় জমির আগের মালিক এলাকায় প্রচার করতে থাকেন ওই ৬০ শতাংশ জমি তার। সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামে নামজারি না হওয়ায় এলাকার মানুষও ধরে নিয়েছেন ওই জমির মালিক সরকার নয়, ভোগ-দখলকারীরাই। এরপর তিনি অন্য ব্যক্তির কাছে ওই জমি বিক্রি করেন। এভাবে ওই জমি বিক্রি ও নামজারি হয় দফায় দফায়। এতসবের পরেও বিষয়টি সদর উপজেলা এসিল্যান্ড অফিস, উপজেলা ভূমি অফিস ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসের নজরে আসেনি।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ওই জমি ব্যক্তিমালিকানার কবল থেকে উদ্ধার ও তাদের নামে করা নামজারি বাতিল করে সওজের নামে নামজারি করে গেজেট প্রকাশের সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সংশ্নিষ্ট ব্যক্তি ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ করা হয়।