ফোনালাপ ফাঁস

দুশ্চিন্তায় মন্ত্রী–সাংসদ

মুরাদ হাসানের এই পরিণতি যে অনিবার্য, এ বিষয়ে সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রায় সবাই একমত। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়ও মুরাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছেন না কেউ। তবে একজন চিত্রনায়িকার সঙ্গে তাঁর দুই বছর আগের ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার ঘটনার পর মন্ত্রিসভার সদস্য, সাংসদ ও সরকারি দলের অনেকে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।

সরকারি দলের একাধিক মন্ত্রী, সাংসদ এবং বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে এই দুশ্চিন্তার কথা জানা গেছে। তাঁদের অনেকে মনে করছেন, সাম্প্রতিক সময়ে মুরাদ হাসান প্রকাশ্যে চরম অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সেটা যথেষ্ট ছিল। এর মধ্যে একজন চিত্রনায়িকার সঙ্গে তাঁর ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার ঘটনাকে আচমকা এবং তা সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের অজান্তে হয়েছে বলেই নেতাদের অনেকে মনে করছেন। ফলে ভবিষ্যতে মন্ত্রী, সাংসদ ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের ব্যক্তিগত বিষয় বা ফোনালাপও এখন ফাঁস হয়ে পড়ে কি না—এই দুশ্চিন্তা অনেকের মধ্যে কাজ করছে।

এই বিষয়ে মন্ত্রিসভার সদস্য ও দলের নেতারা এই বিষয়ে একান্তে কথা বললেও কেউ গণমাধ্যমে বক্তব্য দিতে চাননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের একজন উচ্চপর্যায়ের নেতা প্রথম আলোকে বলেন, মুরাদ হাসানের ঘটনা স্তিমিত হয়ে গেলে বিষয়টি নিয়ে সরকার ও দলের নীতিনির্ধারকদের ভাবার সুযোগ আছে।

মুরাদ হাসানের ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর বেশ কিছু প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সরকার ও আওয়ামী লীগে। সেটা হলো, ফোনালাপ রেকর্ড করার এখতিয়ার আছে এমন কোনো পর্যায় থেকে যদি এটা ফাঁস হয়ে থাকে, তাহলে চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কারণ, এর আগে যেসব ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে, এর বেশির ভাগ সরকারবিরোধীদের।

সরকারের একজন মন্ত্রী নাম প্রকাশ না করে বলেন, নেতা-মন্ত্রীদের ফোন কল রেকর্ড করা হয়—এমন একটা ধারণা তাঁদের মধ্যে আছে। এ জন্য অনেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরাসরি ফোনে না বলে কোনো না কোনো সুরক্ষিত অ্যাপে বলে থাকেন। তবে মুরাদ হাসানের দুই বছর আগের ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে। ফলে ৫-৭ কিংবা ১০ বছর আগের ফোনালাপ নিয়ে কেউ বিব্রতকর অবস্থায় পড়বেন না—এর নিশ্চয়তা কী? ওই মন্ত্রী বলেন, রাজনীতিকেরা অনেক সময় আগ-পিছ বিবেচনা না করে ফোনে অনেক কিছু বলে ফেলেন। সরকারি দলের নেতাদের ক্ষেত্রে এটা বেশি হয়।

আলোচিত ফোনালাপ ফাঁস

গত এক দশকে বেশ কিছু আলোচিত ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ২৯ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে ফোন করেছিলেন। রাজনৈতিক সহিংসতা, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে হওয়া ওই ফোনালাপ নিয়ে জাতির ব্যাপক আগ্রহ ছিল। পরদিন সেই ফোনালাপ ফাঁস হয়ে যায়।

এর কয়েক ঘণ্টা আগে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সচিবালয়ে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, দুই নেত্রীর ফোনালাপ অবশ্যই প্রকাশ করা উচিত। দেশের মানুষকে জানানো উচিত যে এই রাজনৈতিক সংকট নিয়ে তাঁরা কী কথা বলেছেন। এরপর মধ্যরাতের ‘বুলেটিন’ নামে দেশের দুটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল দুই নেত্রীর ফোনালাপ প্রচার করে। পরদিন আরও অনেক গণমাধ্যমে ওই ফোনালাপ প্রচার ও প্রকাশিত হয়।

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না এবং ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র সাদেক হোসেন খোকার মধ্যে একটা ফোনালাপ ফাঁস হয়। এরপর মান্নাকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তিনি ২১ মাস কারাভোগের পর ২০১৬ সালে মুক্তি পান।

গত মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির সফরবিরোধী বিক্ষোভ ও সহিসংতার পর কয়েকজন হেফাজত নেতারও ফোনালাপ ফাঁস হয়। ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হকেরও ফোনালাপ ফাঁস হয়েছিল।

২০০৬ সালে টেলিকমিউনিকেশন আইনকে সংশোধন করে নাগরিকদের টেলিফোন রেকর্ড করার অবাধ ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া হয়। যেমন: ৯৭ক ধারার ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা’র স্বার্থে সরকার গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে যেকোনো টেলিযোগাযোগ রেকর্ড করার ক্ষমতা দিতে পারবে বলা হয়। এ কাজে টেলিযোগাযোগ সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সহায়তা না করলে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।

যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে বা কোনো অপকৌশল অন্যের ওপর প্রয়োগ করে, সেটা যে নিজেদের ওপরও প্রয়োগ হতে পারে, তা প্রাথমিকভাবে তাদের চিন্তায় থাকে না।

শাহদীন মালিক, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

বিভিন্ন সময় আতঙ্ক ছড়িয়েছে

গত জুলাই মাসে ‘চাকরিজীবী লীগ’ ও ‘নেতা বানানোর’ ঘোষণা দিয়ে ছবি পোস্ট করে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়ে গ্রেপ্তার হন হেলেনা জাহাঙ্গীর। তিনি আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য ছিলেন। এরপর গ্রেপ্তার করা হয় কথিত মডেল ফারিয়া মাহাবুব (পিয়াসা) ও মরিয়ম আক্তার (মৌ) এবং চিত্রনায়িকা পরীমনি, প্রযোজক নজরুল রাজসহ আরও কয়েকজন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তখন বলেছিল, প্রভাবশালী ও বিত্তবানদের নানাভাবে ‘ব্ল্যাকমেল’ বা ফাঁদে ফেলে প্রতারণা করাই তাঁদের মূল অপরাধ। সে সময় সরকার ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীদের সঙ্গে এসব ব্যক্তির অডিও-ভিডিও থাকার কথা শোনা যায়। তখনো অস্বস্তিতে পড়েছিলেন অনেকে। অল্প কদিন পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান থেমে গেলে স্বস্তি পান প্রভাবশালীরা।

আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক কথাবার্তা ফাঁস হওয়া নিয়ে রাজনীতিবিদদের এতটা চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। এতে সমালোচনা হলেও ক্যারিয়ার শেষ হয় না। কিন্তু ব্যক্তিগত ‘স্ক্যান্ডাল’ বের হলে রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের পাশাপাশি সামাজিক অবস্থানও শেষ হয়ে যায়। এটাই চিন্তার।

অবশ্য আরেকজন নেতা বলেন, নেতা বা দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ওপর সমাজের প্রত্যাশা অনেক। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ মানুষ বিচার করবে—এটাই স্বাভাবিক। তাই যিনি নিজেকে সামলে চলতে না পারবেন, তার পরিণতি খারাপ হওয়াই উচিত। মুরাদ হাসানের পতন থেকে সবার শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ আছে।

ফোনকল ফাঁস নিয়ে সরকারি দলের অনেকের দুশ্চিন্তার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি দুশ্চিন্তা করারই। তবে যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে বা কোনো অপকৌশল অন্যের ওপর প্রয়োগ করে; সেটা যে নিজেদের ওপরও প্রয়োগ হতে পারে, তা প্রাথমিকভাবে তাদের চিন্তায় থাকে না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *