বিনিয়োগ স্থবিরতায় কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সংকট
করোনায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বিনিয়োগে চলছে স্থবিরতা। আগের ব্যবসা-বাণিজ্য সংকুচিত হয়েছে। নতুন করে কমেছে প্রসার।
কাজের নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি হওয়ার সুযোগও হ্রাস পেয়েছে। অনেকেই চাকরিচ্যুত হয়েছেন। কমেছে বেতন-ভাতা। নতুন কাজের সুযোগ তৈরি করা এবং বর্তমান কাজটি ধরে রাখাই এখন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব মিলে জীবিকার সংকটে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। দেশের পাশাপাশি বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও জীবিকার সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘গোবাল রিস্ক রিপোর্ট ২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এসেছে। এতে বলা হয়েছে, ‘২০২২ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও জীবিকার সংকট। এ সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে যুগান্তরের কথা হয়। তিনি বলেন, কোন খাতে কেমন দক্ষতা প্রয়োজন, আগামী ২০ বছর কোন খাতের বিকাশ কেমন হবে, তার ভিত্তিতে শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা জরুরি। তা না হলে বেসরকারি খাতের চাহিদা অনুযায়ী কর্মীও জোগান দেওয়া যাবে না। এখনই দক্ষ শ্রমিক ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মীর অভাব রয়েছে। ব্যাংকে ভালো এমডি পাওয়া যায় না।
এসব বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে পরিকল্পিতভাবে কর্মের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য দরকার আগাম সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। তিনি বলেন, কর্মসংস্থানের গতি কমে যাওয়ায় অর্থনীতিতে জীবিকার সংকট হয়েছে। এ সংকট থেকে আগে উত্তরণ ঘটাতে হবে। এজন্য বিনিয়োগ বাড়ানো, ছোট ও কুটির শিল্পে বিকাশ ঘটাতে হবে।
সূত্র জানায়, করোনার কারণে আগের কর্মসংস্থান যেমন অনেকে ধরে রাখতে পারেননি, তেমনি নতুন কর্মসংস্থানও হচ্ছে না। এতে শ্রমের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনার কারণে বেসরকারি খাতে নতুন কোনো কর্মসংস্থান হয়নি বললেই চলে। উলটো চাকরি হারিয়েছেন অনেকে। সরকারি খাতেও খুবই কম চাকরির সংস্থান হয়েছে। প্রতিবছর গড়ে ২৬ থেকে ২৭ লাখ লোক নতুন করে শ্রমের বাজারে আসে।
এ হিসাবে দুই বছরে এসেছে ৫২ থেকে ৫৪ লাখ লোক। এদের বেশিরভাগেরই কর্মসংস্থান হয়নি। আইএলওর হিসাবে আগে সাড়ে ৩ কোটি লোক বেকার ছিল। সব মিলে এখন বেকারের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৪ কোটি টাকা। এছাড়া নতুন করে অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। গত দুই বছরে স্বাস্থ্য ক্যাডারে বেশ কিছু পদে নিয়োগ হয়েছে। খুব সীমিত আকারে ব্যাংক ও অন্যান্য সরকারি খাতে কিছু নিয়োগ হয়েছে। যা চাহিদার তুলনায় একেবারেই কম।
সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ হয়েছিল ২০১৬ সালে। ২০১৭ সালে ফল প্রকাশ করা হয়। ওই জরিপ অনুযায়ী মোট শ্রমশক্তির মধ্যে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ৬ কোটি ৩৫ লাখ। এর মধ্যে কাজ করেন ৬ কোটি ৮ লাখ নারী-পুরুষ। বাকি ২৭ লাখ বেকার। ৬ বছর ধরে এ জরিপ হচ্ছে না। অথচ মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি দুই বছর পরপর জরিপ হওয়ার কথা।
এদিকে বিবিএসের এই তথ্য অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। কেননা বিবিএস কৃষি শ্রমে যারা নিয়োজিত তাদেরও কর্মে নিয়োজিত বলে দেখিয়েছে। অথচ এদের বড় অংশই বেশিরভাগ সময় বেকার থাকে। তারা মৌসুমি শ্রমিক হিসাবে কাজ করে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বেকারত্ব বেড়েছে। দেশের কর্মক্ষম তরুণদের এক-চতুর্থাংশই হচ্ছে বেকার। ২০২২ সালে এদের কর্মসংস্থান করাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হকের নেতৃত্বে ২০২১ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে জরিপ চালানো হয়। এতে দেখা গেছে, করোনায় দেশে চাকরিচ্যুতি এবং কর্মহীনতা বেড়েছে। মহামারির প্রথম কয়েক মাসে দেশে অনেক মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। এদের অনেকেই নতুন করে চাকরির বাজারে ঢুকতে পারেননি, অনেকে স্থায়ীভাবে শহর ছেড়ে গ্রামে ফেরত গেছেন।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, মোট কর্মসংস্থানে সরকারি চাকরিতে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বেসরকারি চাকরি ১৪ দশমিক ২ শতাংশ, অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে ৬০ দশমিক ৯ শতাংশ এবং অন্যান্য খাতে ২১ দশমিক ১ শতাংশ।
অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম বলেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। দেশ থেকে যে টাকা পাচার হয়ে যায় সেগুলো স্থানীয়ভাবে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। দেশ থেকে পুঁজি নিয়ে বিদেশে বিনিয়োগের যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে তা না করে সেই পুঁজি দেশেই বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। এতে কর্মসংস্থান বাড়বে। বেকারত্ব কমবে। আগে দেশের বেকারত্ব নিরসন না করে বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়াটা ঠিক হয়নি। এতে অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জরিপে দেখা গেছে, দেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বেকারত্বের হার ৩৪ শতাংশ, আর স্নাতক পর্যায়ে এই হার ৩৭ শতাংশ। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী দশ বছরে কোন শিল্প খাতে কেমন কর্মী দরকার হবে এবং কী ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন পড়বে-এই প্রজেকশন না থাকলে, শিল্প খাতের চাহিদা অনুযায়ী কর্মী জোগান দেওয়া সম্ভব হবে না। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অনেক গ্রাজুয়েট তৈরি হবে, কিন্তু চাহিদামতো কর্মী তৈরি করা সম্ভব হবে না।
দেশের শ্রমশক্তি জরিপের বেকারত্বের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের এমন ব্যক্তিকে বেকার বিবেচনা করা হয়েছে, যে সক্রিয়ভাবে কাজের সন্ধান করে বা কাজের জন্য তৈরি থাকা সত্ত্বেও কোনো কাজ পাননি।
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) মতে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। অর্থাৎ প্রতি দুজনে একজন বেকার। এ মুহূর্তে ১৮-২৮ বছর বয়সি যে সংখ্যক যুবক আছেন, তাদের তিনজনে একজন বেকার। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের হার কম।
আইএলও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩ কোটি। করোনার কারণে ক্ষতি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব না হলে কয়েক বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে ৭ কোটিতে দাঁড়াবে। কেননা প্রতিবছর শ্রমবাজারে যারা আসছেন তাদেরও কর্মসংস্থান হচ্ছে না।
এদিকে করোনার পর থেকে চাকরির বিজ্ঞাপন বহুলাংশে কমে গেছে। করোনার পর চাকরির বিজ্ঞাপন প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কমে যায়। তবে এ বছরের মার্চের পর থেকে বাড়ছে। সেটা এখনো আগের তুলনায় ৫০ শতাংশ কম।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানার বহু শ্রমিক করোনার আঘাতে চাকরি হারিয়েছেন। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গবেষণা অনুযায়ী যার সংখ্যা তিন লাখ ৫৭ হাজার, যা মোট শ্রমিকের ১৪ শতাংশ। এদের অনেকে কাজে ফিরে যেতে পারেননি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গার্মেন্টে চাহিদা অনুযায়ী কর্মী পাওয়া যাচ্ছে না। যে কারণে গার্মেন্টে এখন অনেক বিদেশি কর্মী উচ্চ পদে কাজ করে। উচ্চপদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য অভিজ্ঞ কর্মী তৈরি করাটা এখন জরুরি।