পশ্চিমের ‘অনাদরে’ তালেবানের ঝোঁক চীন-রাশিয়ার দিকে

পশ্চিমের ‘অনাদরে’ তালেবানের ঝোঁক চীন-রাশিয়ার দিকে

ক্ষমতা দখলের এক বছরপূর্তিতে কাবুলের রাজপথে তালেবান সদস্যদের উদযাপন। ছবি: এএফপি

কাবুল দখলের এক বছরেও বিশ্বের কোনো দেশের কাছ থেকে স্বীকৃতি পায়নি তালেবান শাসন। একঘরে অবস্থায় ধুঁকতে থাকা অর্থনীতি আর ক্রমশ নিম্নগামী মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে চরম প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে আফগানিস্তানকে।  

বারবার আবেদন ও প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তালেবানের ঘোষিত ইসলামিক আমিরাত বিশ্বের কোনো দেশের স্বীকৃতি পায়নি। পশ্চিমা বিশ্ব সাফ জানিয়ে দিয়েছে, স্বীকৃতি পেতে হলে আগে নারী অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

দেশটির সরকারকে আরো প্রতিনিধিত্বমূলক হতে হবে।  

পশ্চিমের সুনজর আদায়ে ব্যর্থ তালেবানের দাবি, যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বীকৃতি না দিয়ে ২০২০ সালের দোহা সমঝোতার লঙ্ঘন করছে। অন্যদিকে আল-কায়েদা নেতা আয়মান আল জাওয়াহিরিকে ড্রোন হামলায় হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের বিরুদ্ধেই দোহা সমঝোতা মেনে চলতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ এনেছে। কারণ দোহা সমঝোতা অনুসারে তালেবান আল-কায়েদা বা অন্য কোনো সশস্ত্র দলকে সুরক্ষা দিতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্রের এমন অভিযোগ উত্থাপন আফগানিস্তানের মানবিক পরিস্থিতির জন্য অশনিসংকেত বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। কারণ এই দ্বন্দ্বের জেরে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে আটকে থাকা আফগান অর্থ ছাড় করা আরো পিছিয়ে যাচ্ছে।

সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত নাথান সেলস বলছেন, জাওয়াহিরির হত্যার পর আফগান অর্থ ছাড়া নিয়ে উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের আশঙ্কা, ওই অর্থ তালেবানের কাছে হস্তান্তর করা হলে তা হয়তো অনিবার্যভাবে আল-কায়েদার পকেটে যাবে।

বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে পশ্চিমের সঙ্গে টানাপড়েন তৈরি হলেও আঞ্চলিক দেশগুলোর ক্ষেত্রে হয়তো চোখে পড়বে ভিন্ন চিত্র। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক ইব্রাহিম বাহিসের মতে, ‘আঞ্চলিক অনেক দেশের জন্য আল-কায়েদা মূল বিবেচনার বিষয় হবে না। এমনও হতে পারে যে তারা এসব জানার পরও নিজেদের সম্পর্ক অব্যাহত রাখবে। ’ 

পশ্চিমাদের কঠোর অবস্থানের বিপরীতে তালেবানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে চীন, পাকিস্তান ও ইরান। এ তালিকায় আছে মালয়েশিয়া, কাতার, সৌদি আরব, রাশিয়া ও তুর্কমেনিস্তানও। বিশেষ করে তুর্কমেনিস্তান, পাকিস্তান, চীন ও মস্কো আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবান নিয়োজিত কূটনীতিকদের স্বীকৃতি দিয়েছে।

পর্যবেক্ষকদের মতে, এসবের পেছনে অন্যতম কারণ হলো রাশিয়া, চীন ও ইরান ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিগোষ্ঠীকে আল-কায়েদার চেয়ে বড় হুমকি বলে মনে করে। কুইন্সি ইনস্টিটিউট অব রেসপন্সিবল স্টেটক্রাফটের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক আনাতোল লিয়েভেনের মতে, তালেবান যত দিন আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখবে, তত দিন ওই সব দেশ তালেবানের প্রতি অন্তত সহানুভূতি বজায় থাকবে।

লিয়েভেন আরো বলেন, তালেবান কাবুল দখলের বহু আগেই তাদের সঙ্গে কেন রাশিয়া ও চীন যোগাযোগ করেছে, তা বোঝা যায় তালেবানের আইএসবিরোধিতা থেকে। তবে তালেবানের জরুরি ভিত্তিতে যে তহবিল প্রয়োজন, তা দেওয়ার বেলায় এ সম্পর্কগুলো থমকে দাঁড়িয়েছে। কারণ রাশিয়ার হাতে দেওয়ার মতো কিছু নেই। আর চীন বরাবরই এ ধরনের লেনদেনের বেলায় অত্যন্ত সতর্ক।

তবে অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ক্লড রাকিসিটসের মতে, পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় তালেবানের সঙ্গে মস্কো ও বেইজিংয়ের যোগাযোগ বেশি থাকলেও তারাও কাবুলের নেতাদের ওপর বিরক্ত।  

১৯৯০-এর দশক থেকে আফগানিস্তানে ঘাঁটি গেড়ে বসা উইঘুর দলগুলো নিয়ে তালেবান কী করে, তা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে চীন সরকার। তাদের এ সম্পর্কিত সবচেয়ে বড় শঙ্কাটি হলো, তালেবান হয়তো এ দলগুলোকে স্বাধীনভাবে চীনে অভিযান পরিচালনার সুযোগ দিতে পারে।

কাবুলের শাসক প্রশ্নে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে তেহরানও। হাজারা শিয়াদের উচ্ছেদের বিষয়টি নিয়ে ইরান আগে থেকেই অসন্তুষ্ট। তালেবান মিত্র পাকিস্তান সমস্যায় রয়েছে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) নিয়ে।

সব মিলিয়ে বেইজিং ও মস্কো এখনও তালেবান প্রশ্নে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘অপেক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করা’ নীতি অবলম্বন করছে। তালেবান শাসকরা যদি সফলভাবে মস্কো ও বেইজিংয়ের আনুকূল্য আদায় করতে পারে, তাহলে তারা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল এড়াতে পারবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আফগানিস্তানে বিনিয়োগ করতে পারে চীন। এতে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে প্রবেশাধিকার পাবে তারা। অন্যদিকে তালেবানেরও আর্থিক সমস্যা মিটবে।  

বর্তমানে মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে চীন, রাশিয়া ও ইরান দাঁড়ানোর যে চেষ্টা চালাচ্ছে, তাতেও ভূমিকা রাখতে পারে তালেবানর সঙ্গে সম্পর্কের প্রসঙ্গ। তালেবান এ ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হতে পারে, যার বদৌলতে বৃহত্তর মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বাড়াতে পারবে ওই সব দেশ। সূত্র : আল-জাজিরা