বঙ্গবন্ধুর চিন্তা দিশা দেখাতে পারে
ভারতীয় উপমহাদেশ যে আদর্শের সংকটে ভুগছে, তা থেকে উত্তরণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তা দিশা দিতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। তিনি বলেছেন, তারা (খুনিরা) বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গেছে, তবে তাঁর আদর্শ ও চিন্তাকে নয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে বুধবার লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস (এলএসই) দক্ষিণ এশিয়া কেন্দ্র আয়োজিত এক বক্তৃতায় অমর্ত্য সেন এ কথা বলেন। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সঙ্গে যৌথভাবে আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল এই বক্তৃতার প্রধান বক্তা ছিলেন অর্মত্য সেন।
এতে প্যানেল আলোচক হিসেবে বাংলাদেশের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারপারসন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান এবং যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এলএসইর পরিচালক মিনুশে শফিক। সঞ্চালক ছিলেন এলএসইর দক্ষিণ এশিয়া কেন্দ্রের পরিচালক আলনুর ভিমানি।
অমর্ত্য সেনের বক্তৃতার শিরোনাম ছিল ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের রূপকল্প’। এতে অর্মত্য সেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রচিন্তা ও সমতাভিত্তিক জাতি গঠনের দর্শনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন। আর রেহমান সোবহানের আলোচনায় বেশি জোর পায় বঙ্গবন্ধুর বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের চেষ্টা।
অমর্ত্য সেন বক্তব্য শুরু করেন বঙ্গবন্ধু শব্দের অর্থ দিয়ে। তিনি বলেন, আক্ষরিক অর্থে বঙ্গবন্ধু শব্দটির মানে হলো বাংলার বন্ধু। কিন্তু তিনি ছিলেন এর চেয়েও বেশি। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মহান রাজনীতিবিদ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি এবং বাংলাদেশের মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলা ব্যক্তিত্ব। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে মানুষ ভালোবাসে মন থেকে।
অমর্ত্য সেন বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও দর্শন কেন সমাজের জন্য, বিভিন্ন রাষ্ট্রের জন্য এখনো জরুরি, তা বিভিন্ন যুক্তির মাধ্যমে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ভারতীয় উপমহাদেশ এখন একটি আদর্শিক সংকটে ভুগছে। উপমহাদেশের দেশগুলো বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার চিন্তা থেকে শিখতে পারে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে মানুষের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা থাকবে না, এটা তিনি বিশ্বাস করতেন না। বঙ্গবন্ধু চাইতেন, ধর্মকে যেন রাজনীতির হাতিয়ার করা না হয়।
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান গ্রহণের দিনটিতে বঙ্গবন্ধুর একটি বক্তব্য তুলে ধরেন অমর্ত্য সেন, যেখানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সবাই যার যার ধর্ম পালন করবে। ধর্মকে শুধু রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অর্মত্য সেন বলেন, বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা ভারতসহ অনেক দেশের জন্য জরুরি।
অমর্ত্য সেন বলেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু সংখ্যালঘুদের জন্য সমান সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি সামনে আনতে ভয় পাননি। এটা তাঁর নির্বাচনে জয়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এখান থেকে শেখা উচিত যে সত্য ও যুক্তিসংগত কথা বলতে কখনো পিছপা হওয়া উচিত নয়।
অমর্ত্য সেন মনে করেন, বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ববন্ধু হিসেবে বর্ণনা করা উচিত। সেটা কেন, তা–ও নানা যুক্তিতে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সবার অংশগ্রহণে সমান সুযোগের মাধ্যমে রাষ্ট্রগঠনের যে দর্শন বঙ্গবন্ধুর ছিল, তা অনুসরণ করলে শ্রীলঙ্কা তামিলদের সঙ্গে দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ এড়াতে পারত।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, বঙ্গবন্ধু চাইতেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিতে ‘ইগালেটেরিয়ান’ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হোক। সেখানে পাকিস্তানের মতো অভিজাত শ্রেণি তৈরি না হোক, যারা সকল সুবিধা ভোগ করবে, আর সাধারণ মানুষ পিছিয়ে থাকবে। বঙ্গবন্ধু চাইতেন, বাংলাদেশে বঞ্চিতরা হবে রাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী। উল্লেখ্য, ‘ইগালেটেরিয়ান’ চিন্তা হলো এমন একটি রাজনৈতিক দর্শন, যেখানে সব মানুষকে সমান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর সবার জন্য সমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করা হয়।
রেহমান সোবহান বলেন, বঙ্গবন্ধু যে অভিজাত শ্রেণির উত্থান পছন্দ করতেন না, চাইতেন না, সেটা তাঁকে হত্যার পেছনের একটি কারণ। তিনি বলেন, ‘আমরা বঙ্গবন্ধুকে যদি সত্যিকার সম্মান জানাতে চাই, তাহলে সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় আমাদের নজর দেওয়া উচিত। শুধু বাংলাদেশ নয়, এটি আশপাশ ও বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে যেখানে বৈষম্য বাড়ছে, সেই সব দেশের জন্যও প্রযোজ্য।’
সাইদা মুনা তাসনীম বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন। তবে বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।