করোনার টিকা দিতে প্রস্তুত পাঁচ হাসপাতাল

জরুরি বিভাগের পকেট গেটের ওপরে লেখা করোনা টিকাদানকেন্দ্র। গেট দিয়ে নেমে গেল ঢালু পথ। সে পথে নেমেই চোখে পড়ল মিস্ত্রি রং করছেন, স্বেচ্ছাসেবকেরা কাজ করছেন, কাজ বুঝে নিচ্ছেন। সেখানে স্থাপিত হয়েছে অপেক্ষা ঘর, টিকা দেওয়ার বুথ, টিকা নেওয়া শেষে বিশ্রামের শয্যা। জরুরি প্রয়োজনের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ)।

বৃহস্পতিবার সকাল হতেই এখানে একে একে স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনাভাইরাসের টিকা নেবেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) স্থাপিত করোনা টিকাদানকেন্দ্রে বুধবার সকালে গিয়ে দেখা গেল এমন চিত্র। চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনার টিকা কার্যক্রম শুরু করতে শেষ মুহূর্তের কাজ তদারক করছেন। টিকা নেওয়ার প্রক্রিয়ায় যেন কোনো ঘাটতি না থাকে, সে চেষ্টাই সবার।

বুধবার উদ্বোধনের পর বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারি) সকালে রাজধানীর পাঁচটি হাসপাতালে করোনা টিকার কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বৃহস্পতিবার ৪০০ স্বাস্থ্যকর্মী কোভিড–১৯–এর টিকা নেবেন। এই তিন হাসপাতাল বাদে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ১০০ ও বাংলাদেশ–কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ৬০ জন স্বাস্থ্যকর্মীকে এ টিকা দেওয়া হবে। এ দুটি হাসপাতালেও সম্পন্ন হয়েছে টিকাদানের প্রস্তুতি।

বুধবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ, মুগদা ও বিএসএমএমইউ ঘুরে দেখা গেছে, নিজ নিজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত। প্রতিটিতেই টিকাদানকেন্দ্র, অপেক্ষা ঘর, টিকা দেওয়ার বুথ এবং বিশ্রাম শয্যার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আইসিইউ সুবিধা রাখা হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও মুগদা হাসপাতালে। বিএসএমএমইউ করোনা টিকাদানকেন্দ্রে আইসিইউ ব্যবস্থা রাখা হয়নি। তবে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জরুরি প্রয়োজনে অবশ্যই টিকা নেওয়া ব্যক্তির জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বুধবার বিকেলে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনাভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রথম আলোকে জানিয়েছে, তাদের করোনা টিকাদানকেন্দ্রে ১৪০ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনার টিকা নেবেন। এর মধ্যে ২০ জন চিকিৎসক, ২০ জন নার্স আছেন। অন্যরা হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মী ও স্টাফ। সেখানে চারটি টিকা দেওয়ার বুথের মধ্যে দুটি নারীদের জন্য। বিশেষজ্ঞসহ মোট ২৩ জন চিকিৎসক টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। এখানে টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা এবং ২০ জন স্বেচ্ছাসেবক থাকবেন। বুধবার বিকেলের দিকে হাসপাতালে করোনার টিকা পৌঁছায়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সবাই যেন ভ্যাকসিনটা স্বস্তির সঙ্গে নিতে পারে, সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে। জরুরি বিভাগের ভূগর্ভস্থ তলায় (বেসমেন্টে) করোনা টিকাদানকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। তিনি বলেন, টিকা নিতে এলে প্রথমে অভ্যর্থনা, নিবন্ধন, প্রাথমিক শারীরিক পরীক্ষা—প্রভৃতি ধাপগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। এরপর প্রত্যেককে আধা ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করা হবে। করোনার টিকার কার্যক্রম শুরু হয়ে গেলে মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে বলে আশা ঢাকা মেডিকেল কলেজ পরিচালকের।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার টিকা নেবেন ২০০ জন। ঢাকা, ২৭ জানুয়ারি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার টিকা নেবেন ২০০ জন। ঢাকা, ২৭ জানুয়ারি

ঢাকা মেডিকেল কলেজের টিকাদানকেন্দ্রটির চতুর্দিকের দেয়ালে রং করা হয়েছে। অপেক্ষা ঘরে (ওয়েটিং রুম) নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বসানো হয়েছে সারি সারি চেয়ার। টিকা নেওয়ার পর কারও খারাপ লাগলে পাশেই ব্যবস্থা আছে চারটি পোস্ট-ভ্যাকসিনেশন শয্যা। আরও কোনো শারীরিক জটিলতা দেখা দিলে সেটি সামাল দিতে দুই শয্যার আইসিইউ প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

বিএসএমএমইউর করোনা টিকাদানকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে মিন্টো রোডের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের উল্টো পাশে বিএসএমএমইউ কনভেনশন সেন্টারে। সেখানে বুধবার দুপুরে গিয়ে দেখা গেল, সেন্টারে ঢুকতেই তথ্যকেন্দ্র। এরপর হাতের ডান পাশে সারি সারি সোফা পাতা। সেখানেই অপেক্ষা ঘর। অপেক্ষা ঘরের পশ্চিমে মোট আটটি বুথ। এই বুথগুলোতে বৃহস্পতিবার বিএসএমএমইউর ২০০ জন স্বাস্থ্যকর্মীকে করোনার টিকা দেওয়া হবে। এ টিকাকেন্দ্রে আরও আছে চারটি হাই–ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ), কেবিন ব্লকে অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ চার শয্যাটি শয্যা। এ ছাড়া টিকাকেন্দ্রে উপস্থিত থাকবেন দুজন চিকিৎসক, প্রস্তুত রাখা হবে দুটি অ্যাম্বুলেন্স।

বিএসএমএমইউ জানিয়েছে, বিএসএমএমইউর উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়া বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে প্রথম করোনার টিকা নেবেন। এরপর একে একে হাসপাতালটির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের করোনার টিকা দেওয়া হবে।

বুধবার বেলা আড়াইটার দিকে করোনা টিকাদানকেন্দ্রের তদারক করছিলেন বিএসএমএমইউর কোষাধ্যক্ষ মো. আতিকুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিকা নিয়ে মানুষ অবশ্য একটু দ্বিধান্বিত। তবে আমরা আশাবাদী।’

মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই হাসপাতালের বহির্বিভাগের তৃতীয় তলায় করোনার টিকা দেওয়া হবে। প্রথম দিনে মোট ৬০ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনা টিকা নেবেন। এর মধ্যে চিকিৎসক পাঁচজন, বাকিরা হাসপাতালের নার্স ও কর্মকর্তা। টিকা সংরক্ষণের জন্য দুটি ঘর আছে। এখানে টিকা দেওয়ার দুটি বুথ, বিশ্রামঘর ও আইসিইউর ব্যবস্থা আছে।বিজ্ঞাপন

বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে মুগদা হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, জরুরি বিভাগের সামনে টানানো হচ্ছে করোনা টিকাদানকেন্দ্রের একটি বড় ব্যানার। বহির্বিভাগের তিনতলায় ঢুকতেই মিলল করোনা টিকাদানকেন্দ্র। কেন্দ্রের ভেতরটা পরিষ্কার করা হয়েছে, চারদিকের দেয়ালে দিকনির্দেশনা লেখা— টিকার জন্য কোন ঘর থেকে কোথায় যেতে হবে।

মুগদা হাসপাতালের পরিচালক অসীম কুমার নাথ প্রথম আলোকে বলেন, এখানে টিকা নিতে প্রথমে নিবন্ধন করা হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেন্দ্রে টিকা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। টিকা নেওয়ার পর যদি কারও বিরূপ প্রভাব পড়ে, তাহলে তাৎক্ষণিক সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, চিকিৎসকদের মধ্যে টিকা নিয়ে যে সন্দেহ ছিল, এখন তাঁরা সন্তুষ্ট। তাঁরা ভ্যাকসিনের গুরুত্ব জানেন।

মুগদা হাসপাতালে বৃহস্পতিবার প্রথম টিকাটি নেওয়ার কথা রয়েছে হাসপাতালটির সিনিয়র কনসালট্যান্ট নন্দিতা পালের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার সময়ের প্রথম থেকেই আমরা হাসপাতালে কাজ করেছি। করোনা নিয়ে মানুষের ভীতি আমি দেখেছি। সেই সাংঘাতিক অবস্থা থেকে এখন টিকা এসেছে। আমি টিকা নিতে এগিয়ে এসেছি, এতে অন্যরাও সাহস পাবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *