বিএনপির সামনে তিন কঠিন চ্যালেঞ্জ
নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, দল পুনর্গঠন ও কোন্দল নিরসন * করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে দল গঠনের কাজ শুরু হবে : মির্জা ফখরুল
মাঠের বিরোধী দল বিএনপির সামনে এখন তিন কঠিন চ্যালেঞ্জ। এগুলো হলো : নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আদায়, দল পুনর্গঠন ও অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন।
দলটির নীতিনির্ধারক ও বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা মনে করেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায় করতে হলে আন্দোলনের বিকল্প নেই। আর আন্দোলনের জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী সংগঠন।
সংগঠন শক্তিশালী হলেই চলবে না, সেটাকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে প্রয়োজন ঐক্য। করোনা মহামারিসহ নানা কারণে এই তিন স্তরেই প্রস্তুতির অভাব রয়েছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর এসব মোকাবিলা করা সত্যিই কঠিন চ্যালেঞ্জ। এ লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি না হলেও প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে বলে জানান বিএনপির কয়েকজন নীতিনির্ধারক।
অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আদায় করতে হলে এখন থেকে পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামতে হবে। কারণ, ইতোমধ্যে সরকারের মেয়াদের অর্ধেক সময় পেরিয়ে গেছে।
করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও সময় লাগবে। তাই করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরপরই সরকারবিরোধী কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে হবে। শুধু বক্তৃতা-বিবৃতিতে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করলেই সরকার তা মেনে নেবে না। তাই এ দাবি আদায়ে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা।
তাদের মতে, বিএনপির একার পক্ষে এ দাবি আদায় করা কঠিন। এজন্য সব দল ও মতকে একই প্ল্যাটফরমে আনতে হবে। এ উদ্যোগ বিএনপিকেই নিতে হবে। এসব মুখে বলা যতটা সহজ, বাস্তবায়ন আসলেই কঠিন। সব দল ও মতকে ঐক্যবদ্ধ করতে বারবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। তাই সামনে সবাইকে এক প্ল্যাটফরমে এনে পরিকল্পনামাফিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামা দলটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
জানতে চাইলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, বিএনপির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে একটি সফল আন্দোলন। এছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আর আন্দোলনকে সফল করতে হলে সবার আগে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হবে। তার নেতৃত্ব ছাড়া আন্দোলন সফল করা কঠিন। লন্ডনে বসে নির্দেশনা দিলেই আন্দোলন সফল হবে না। বিএনপি মুখে মুখে সরকার পতনের কথা বললেই তো শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন না। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায় করতে হলে মাঠে নামতে হবে। ঘরে বসে কোনো কাজ হবে না।
এর আগে বিএনপির উচিত অতীতের ভুলত্রান্তি স্বীকার করা। এরপর সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলনে নামা। তিনি বলেন, আন্দোলন করার আগে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে। সেই কাজটুকুও তারা করতে পারছেন না। কোনো কাজ না থাকায় নেতারা নিজেদের মধ্যে নানা ইস্যুতে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে। আন্দোলন নেই বলে একে অপরের পেছনে লেগে আছে। মাঠে থাকলে তখন নেতাকর্মীদের মধ্যে একটা সৌহার্দ তৈরি হবে।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার। এজন্য প্রয়োজন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি অবাধ নির্বাচন। আমরা দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে যে কোনো চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত আছি। তবে দানব সরকারকে হটিয়ে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায় করা সহজ কাজ নয়। এজন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। যার যার অবস্থান থেকে এ সরকারের পতনে আন্দোলন করতে হবে।
তিনি বলেন, আন্দোলনের জন্য দলকে শক্তিশালী করতে হবে। এ লক্ষ্যে আমরা বারবার পরিকল্পনা নিয়েও করোনার কারণে শেষ করতে পারছি না। ডিসেম্বরের মধ্যে সব ইউনিটের কমিটি পুনর্গঠনের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মহামারির কারণে পুনর্গঠন কাজ স্থগিত রাখতে হয়। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পুনরায় কাজ শুরু করব। অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের এ কাজ করতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে ঐক্যবদ্ধ। সরকারের নানা নির্যাতন, মামলা-হামলার পরও একযুগে একজন নেতাও দল ছেড়ে যায়নি। গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে আগামী দিনে তারা আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ হবে বলে আশা করি।
বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা জানান, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সফলতার অন্যতম নিয়ামক হচ্ছে শক্তিশালী সংগঠন। বিগত সময়ে তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে বিগত সময়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন সফলতার মুখ দেখেনি। মূল দলের পাশাপাশি অঙ্গসংগঠনগুলোও সাংগঠনিকভাবে সক্ষমতা দেখাতে পারেনি। তাই বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দল গোছানোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার দাবি ওঠে।
সে লক্ষ্যে কাজও শুরু করে হাইকমান্ড। কিন্তু নানা জটিলতায় বারবার সেটা ব্যর্থতায় রূপ নেয়। নির্বাচনের আড়াই বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো পুনর্গঠন কাজ শেষ করতে পারেনি দলটি। কবে নাগাদ শেষ হবে, তাও অনিশ্চিত। ৮২টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে প্রায় অর্ধশত কমিটি এখনো মেয়াদোত্তীর্ণ। যেসব জেলায় আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছিল সেগুলোর মেয়াদ শেষ হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা সম্ভব হয়নি।
যুবদল, মহিলা দল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ বেশির ভাগ অঙ্গসংগঠনের কমিটিও মেয়াদোত্তীর্ণ। কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদও শেষ হয়েছে তিন বছর। জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠানের কোনো পরিকল্পনাও আপাতত নেই। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর দ্রুত সময়ে এসব কমিটি পুনর্গঠন করা সত্যিই কঠিন। সরকারবিরোধী আন্দোলনের আগে সব কমিটি পুনর্গঠন করা যাবে কি না, তা নিয়েও রয়েছে সংশয় ।
আন্দোলনের আগে বিএনপিতে ঐক্য ফিরিয়ে আনাও বেশ চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দলটির নেতাকর্মীরা। তাদের মতে, দল ঐক্যবদ্ধ না হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করা কঠিন। বিগত সময়ে নানা ইস্যুতে দলের নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়।
ইলিয়াস আলীর গুম ইস্যুতে সম্প্রতি দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়ায় তা অনেকটা প্রকাশ্যে রূপ নেয়। দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীও এ কোন্দলে জড়িয়ে পড়েন। হাইকমান্ডের হস্তক্ষেপে তা কিছুটা নিরসন হলেও এখনো রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব। এছাড়া মনোনয়ন, আধিপত্য বিস্তার এবং পুনর্গঠন ইস্যুতেও নেতাদের মধ্যে রয়েছে কোন্দল। কোন্দল নিরসন করে দলকে ঐক্যবদ্ধ করে মাঠে নামা সহজ হবে না।
জানতে চাইলে বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহাজাহান বলেন, আমাদের সামনে এখন মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সরকারের পতন। আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের বিদায় করে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। আমরা একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্যই আন্দোলন করছি না।
আমরা চাই দেশে একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত হোক। সেটার একটা মাধ্যম হচ্ছে নিরপেক্ষ নির্বাচন। সেই নির্বাচনের পর যারাই ক্ষমতায় আসুক, তারা প্রতিহিংসাপরায়ণ হবে না, আইনের শাসন, বাক্স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে। সর্বোপরি দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিচর্চা করতে হবে।
তিনি বলেন, আন্দোলন ও সংগঠন পাশাপাশি। সংগঠন শক্তিশালী না হলে আন্দোলন সফল করা সম্ভব নয়। আমাদের এখন কথার চেয়ে কাজ বেশি করতে হবে। সরকারের যে ফ্যাসিস্ট আচরণ তাতে বিএনপির একার পক্ষে সরকারবিরোধী আন্দোলন করে সফল হওয়া কঠিন। এজন্য দেশের সব দল ও মতকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার দায়িত্বটা বিএনপির কাঁধেই বর্তায়।
শাহজাহান বলেন, বিএনপিতে কোনো কোন্দল নেই। তবে নেতাদের মত ও চিন্তার ভিন্নতা থাকতে পারে। ধরুন, কেউ হয়তো মনে করছে আন্দোলন ছাড়া নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায় করা সম্ভব নয়। আবার কেউ মনে করছে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে এ সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। তবে যাই হোক, আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতেই হবে।