দেশে পাঁচ ধরনের অপরাধ বেড়েছে

দেশে পাঁচ ধরনের অপরাধ বেড়েছে

দেশে করোনা মহামারির সময় চুরি, ছিনতাই, দস্যুতা, ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতন—এই পাঁচ ধরনের অপরাধ বেড়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাওয়া ২০২০ সালের সারা দেশের অপরাধ পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে এই চিত্র পাওয়া গেছে।

এ ছাড়া আগের বছরের (২০১৯) তুলনায় না বাড়লেও এই সময়ে দেশে খুন ও মাদকসংক্রান্ত অপরাধের ঘটনাও ঘটেছে উল্লেখসংখ্যক হারে।

ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতনের ঘটনার বাইরে দেশে প্রচলিত যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়, তার মধ্যে চুরি, ছিনতাই ও দস্যুতার ঘটনা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।

গত বছরের ৮ মার্চ থেকে দেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এই মহামারিতে খুন, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাই ও দস্যুতার মতো কিছু অপরাধ বাড়তে পারে, সেটা কিছুটা অনুমিত ছিল। সেদিকে নজর রাখার জন্য পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটকে। তবে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা এভাবে বেড়ে যাবে, সেটা ছিল ধারণার বাইরে।

সারা দেশের থানাগুলোতে দায়ের হওয়া মামলার ভিত্তিতে পুলিশ সদর দপ্তর অপরাধের যে পরিসংখ্যান তৈরি করেছে, তাতে দেখা যায়, গত বছর সারা দেশে ৬ হাজার ৫৫৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ দেশে দৈনিক গড়ে ১৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।

এর আগের বছর, ২০১৯ সালে ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৫ হাজার ৮৭২টি। পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, কয়েক বছর ধরেই ধর্ষণের ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলছে। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু ঘটনা দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। যার প্রতিবাদে মানুষ রাস্তায় নেমেছিল।

পাশাপাশি শিশু নির্যাতনের ঘটনাও পাঁচ বছর ধরে বেড়ে চলছে। গত বছর শিশু নির্যাতনের ঘটনা ছিল আড়াই হাজারের বেশি। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৩৬৩।

যৌন সহিংসতা ও ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সামাজিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি পর্নোগ্রাফিকেও একটা বড় কারণ মনে করছেন অপরাধ বিশ্লেষকেরা।

গত বছর দেশে চুরির ঘটনা ঘটেছে ৯ হাজার ৭৩৩টি। এর মধ্যে আড়াই হাজার সিঁধেল চুরির ঘটনা ঘটেছে। এর আগে ২০১৯ সালে মোট চুরির ঘটনা ছিল ৯ হাজার ৩১৯টি।

২০২০ সালে দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে ৯৭৮টি। আর ছিনতাই (দ্রুত বিচার আইনে মামলা) ৮৭১টি। এর মধ্যে আগের বছরের তুলনায় ছিনতাই বেড়েছে ৩৪০টি। আর দস্যুতা বেড়েছে ৮২টি।

ছিনতাইকারীদের হাতে কেউ কেউ মারাও গেছেন। গত ৫ মে রাজধানীর কমলাপুরে বিআরটিসি বাস ডিপোর সামনে একটি কার থেকে এক দুর্বৃত্ত রিকশা আরোহী সুনীতা রানী দাসের গলায় ঝোলানো ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে টান দিলে তিনি রিকশা থেকে ছিটকে পড়ে গিয়ে মারা যান।

অবশ্য চুরি, ছিনতাই ও দস্যুতার সব ঘটনায় থানায় মামলা হয় না। মামলার বাইরে থাকা ঘটনা এই হিসাবে যুক্ত হলে সংখ্যাটা আরও বাড়বে। এর মধ্যে দস্যুতা প্রকারান্তরে ডাকাতি। গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বরে দিনেদুপুরে তিন সশস্ত্র দুর্বৃত্ত মুখে মাস্ক ও মাথায় হেলমেট পরে চুয়াডাঙ্গায় সোনালী ব্যাংকের উথলী শাখায় ঢোকে। তারা ব্যাংক ঢোকে এবং পিস্তল বের করে ব্যাংকের ব্যবস্থাপকসহ সবাইকে জিম্মি করে প্রায় ৯ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে যায়। ঘটনাটি ডাকাতি হলেও মামলা হয় দস্যুতার (দণ্ডবিধির ৩৯০ ধারায়)। ওই ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি (১ থেকে ৪ জন) অপর কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের তাৎক্ষণিক মৃত্যু বা জখমের ভয় দেখিয়ে বলপূর্বক কোনো বস্তু বা অস্থাবর সম্পত্তি অর্পণে বাধ্য করলে তা দস্যুতা বলে গণ্য হবে।’ আর দণ্ডবিধির ৩৯১ ধারায় ডাকাতির মামলা হয়। এই ধারায় বলা হয়েছে ৫ বা ততোধিক ব্যক্তি অপর ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের মৃত্যু বা জখমের ভয় দেখিয়ে বলপূর্বক কোনো বস্তু বা অস্থাবর সম্পত্তি অর্পণে বাধ্য করলে তা ডাকাতি বলে গণ্য হবে। গত বছর দেশে ডাকাতির ঘটনায় মামলায় হয়েছে ৩০২টি। আগের বছর এই সংখ্যা ছিল সাড়ে তিন শ।

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মশিউর রহমানের মতে, করোনাকালে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। অভাবের তাড়নায় কেউ কেউ চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ছে। সামাজিক ও বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকায় পারিবারিক সহিংসতাও বাড়ছে। আবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেট ব্যবহার করে পর্নোগ্রাফিতে আসক্তি হয়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটাচ্ছে।

আগের তুলনায় না বাড়লেও ২০২০ সালে দেশে সাড়ে তিন হাজারের বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৬৫৩। তবে করোনাকালে বেশ কয়েকটি নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোতে পরিবারের সদস্য বা স্বজনেরাই জড়িত। স্ত্রী, সন্তান বা মা-বাবাসহ পরিবারের ছোট্ট শিশুকে পর্যন্ত হত্যার ঘটনা ঘটেছে। করোনাকালে নানামুখী দুশ্চিন্তা, হতাশা ও অস্থিরতাকে এ জন্য দায়ী মনে করছেন অপরাধ বিশ্লেষকেরা।

সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগের ফলে দেশে অ্যাসিড–সন্ত্রাস অনেকাংশে কমে এলেও গত বছর ১৬টি অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। আগের বছর এমন ঘটনা ছিল ১২টি।

করোনাকালে বা বিভিন্ন সময়ে সরকার লকডাউন বা বিধিনিষেধ দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিলেও মাদক চোরাচালান ও বিক্রি বন্ধ হয়নি। পুলিশের হিসাবে গত বছর ৭৩ হাজারের বেশি মাদকদ্রব্য আইনে মামলা হয়েছে, যা আগের বছর ছিল ১ লাখ ১১ হাজারের মতো।

তবে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি—মিডিয়া অ্যান্ড অপারেশনস) হায়দার আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাকালে চুরি, ডাকাতি ও রাহাজানি বাড়ার কথা থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর সঠিক নেতৃত্ব ও আইজিপির বিচক্ষণতার কারণে সেভাবে বাড়েনি।’ তিনি বলেন, এ সময়ে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এ–সম্পর্কিত অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে বা কিছু পরিবর্তন হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আগের বছরের তুলনায় ২০২০ সালে নারী নির্যাতন, খুন, ডাকাতি, অপহরণ, পুলিশ আক্রান্ত, অস্ত্র আইনে, বিস্ফোরক আইনের মামলা তুলনামূলক কম হয়েছে। গত বছরে সব ধরনের অপরাধে দেশে মোট মামলা হয় ১ লাখ ৮৭ হাজার ৯২৬টি। এর আগের বছর ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ২ লাখ ২৫ হাজার ৬৮৪টি।

করোনার সময় নির্দিষ্ট কিছু অপরাধ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে মহামারির সময় ঘরবন্দী থেকে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও মানসিক অস্থিরতা অনেকে বেড়ে গেছে। জীবনমানের অবনতি হয়েছে। মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ কাজ করছে। এ কারণে নানা অপরাধ বেড়েছে। তাঁর মতে, করোনাকালে মানুষ আইনি সুবিধা (লিগ্যাল অ্যাকসেস) কম পাচ্ছে। সামাজিক সুরক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় দুর্বল ব্যবস্থাপনা মানুষকে আরও নাজুক করেছে। এ অবস্থায় আইনের সুরক্ষার বিষয়গুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিশ্চিত করার পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষাও নিশ্চিত করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *