যে কারণে চীনের টিকা থেকে সরে আসছে ইন্দোনেশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো

জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া। প্রায় ২৮ কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৭ লাখ লোকের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। মারা গেছেন প্রায় ১ লাখ ৬ হাজার মানুষ। এরচেয়ে বেশি শঙ্কার কারণ দেশটিতে হঠাৎ করেই আবার করোনা সংক্রমণ এবং মৃত্যু বেড়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এর পেছনে অধিক সংক্রামক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টই মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।

কিন্তু এমনটা যে হবে ইন্দোনেশিয়া তা ভাবতেও পারেনি। জাপানের অলাভজনক বার্তা সংস্থা কিয়োডো নিউজ জানিয়েছে, জুলাই মাসের মাঝামাঝিতেই দেশটি ১৫ কোটিরও বেশি টিকা সংগ্রহ করে ফেলেছিল। সংখ্যাটি নেহায়েত কম নয়। অবশ্য সংগৃহীত ওই টিকার ৮০ শতাংশেরও বেশি ছিল চীনের তৈরি সিনোভ্যাক টিকা।.

জানুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় অন্তত এক ডোজ টিকা নেয়া ২০ জন চিকিৎসক করোনায় মারা গেছেন। তাদের বেশিরভাগকেই চীনা টিকা দেয়া হয়েছিল। ‘চীনের টিকা নিয়ে ইন্দোনেশিয়ার ডাক্তাররা রোগী হয়ে যাচ্ছেন’ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড বলেছে- মহামারিকালে ইন্দোনেশিয়ায় জুন মাস পর্যন্ত চারশ’র বেশি চিকিৎসক মারা গেছেন যাদের মধ্যে ২০ জন সিনোভ্যাকের দুই ডোজ টিকা নিয়েছিলেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ১৬ই জুলাই থেকে ইন্দোনেশিয়ার সরকার ইতিমধ্যেই দুই ডোজ চীনা টিকা নেয়া স্বাস্থ্যকর্মীদের অতিরিক্ত আরেক ডোজ মডার্নার টিকা দেয়া শুরু করেছে।

অন্যদিকে থাইল্যান্ড সরকারের মতে, দেশটির প্রায় ৬,৭৭,০০০ জন স্বাস্থ্যকর্মী যারা এপ্রিল থেকে জুলাইয়ের মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সিনোভ্যাকের দুই ডোজ টিকা পেয়েছিলেন, তাদের ৬১৮ জন পরে করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন, একজন নার্স মারাও গেছেন।

বিবিসি জানিয়েছে, জুলাইয়ের ১২ তারিখ থাইল্যান্ড ঘোষণা করেছে এখন থেকে প্রথম ডোজ চীনা টিকা নেয়া ব্যক্তিদের দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে বৃটেনের উৎপাদিত অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেয়া হবে। এছাড়া দুই ডোজ চীনা টিকা নেয়া নাগরিকদের বুস্টার হিসেবে অ্যাস্ট্রাজেনেকা বা মডার্নার টিকা দেয়া হবে।
চীনা টিকা নিয়ে বেশকিছু মৃত্যু দেখে থাইল্যান্ড এবং ইন্দোনেশিয়া এখন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের তৈরি টিকার দিকে ঝুঁঁকছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুই দেশের সিদ্ধান্তে আচমকা এই পরিবর্তন চীনের তৈরি টিকার কার্যকারিতা সম্পর্কে তাদের উদ্বেগকেই প্রতিফলিত করে বলে অনেকেই মনে করছেন। চীনা টিকা দেয়ার পর এখন অন্য টিকা দেয়ার বিষয়ে ইন্দোনেশিয়া বা থাইল্যান্ড সরকার মুখে অবশ্য ওই টিকার কার্যকারিতা সম্পর্কে কিছু বলছে না, শুধু বলছে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোই এর কারণ। যদিও বিবিসি বলছে, দেশ দুটি শুরুতে ‘ভ্যাকসিন ব্যর্থ হওয়ার বিষয়ে উদ্বিগ্ন’ বলে জানিয়েছিল। ইতিমধ্যে মালয়েশিয়াও ঘোষণা করেছে যে সিনোভ্যাক টিকার সরবরাহ শেষ হবার পর তারা এখন ফাইজারের টিকা দিয়ে টিকাদান কর্মসূচি চালু করছে।

ওদিকে, সিঙ্গাপুরে সরকারি ভাবে বিনামূল্যের টিকাদান কর্মসূচিতে ফাইজার এবং মডার্নার টিকা রাখা হলেও চীনের টিকা রাখা হয়নি। সিনোভ্যাকের টিকা কেউ চাইলে বেসরকারি ক্লিনিকে গিয়ে স্বেচ্ছায় নিতে পারেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চীনের সিনোভ্যাক এবং সিনোফার্মের টিকা জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দিলেও দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, ডেল্টা সংক্রমণ এবং মারাত্মক অসুস্থতার ক্ষেত্রে সিনোভ্যাকের টিকা কতোটা কার্যকর সেটা বোঝার জন্য আমাদের কাছে পর্যাপ্ত কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি অথবা হাতে কোনো পরিসংখ্যান নেই।

উল্লেখ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা প্রতিরোধে সিনোভ্যাক টিকার ৫১ শতাংশ কার্যকারিতার কথা উল্লেখ করেছে। অন্যদিকে ফাইজার এবং মডার্নার ক্ষেত্রে তা ৯০ শতাংশেরও বেশি এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার ক্ষেত্রে প্রায় ৭০ শতাংশ।

চীনের সিনোভ্যাকের টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল নিয়ে স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে বলে এর আগেও অনেক পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। নিউ ইয়র্ক টাইমস অনেক আগেই জানিয়েছিল- মঙ্গোলিয়া, সেশেলস এবং বাহরাইনের মতো দেশ যারা সহজপ্রাপ্য চীনা টিকার ওপর নির্ভর করেছিল, তারা এখন সংক্রমণ থেকে উত্তরণের জন্য প্রাণপণ লড়াই করছেন।

জুনের শেষের দিকে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এক প্রতিবেদনে জানায়, ‘আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা’ অনুসারে, সেশেলস, চিলি, বাহরাইন এবং মঙ্গোলিয়া তাদের জনসংখ্যার প্রায় ৫৯ থেকে ৬৮ শতাংশকে চীনা টিকা সম্পূর্ণভাবে দেয়া সম্পন্ন করেছে। এক্ষেত্রে তারা যুক্তরাষ্ট্রকেও ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু এই দেশগুলো বিগত সপ্তাহে করোনা সংক্রমণের দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে।
চীনা টিকা পরিপূর্ণভাবে নেয়ার পরও কেন এসব হচ্ছে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিবিসি কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে বসে কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করেছে:

*সময়ের সঙ্গে চীনা টিকার কার্যকারিতা দ্রুত কমে যাওয়া। এক থাই গবেষণায় দেখা গেছে, সিনোভ্যাকের সম্পূর্ণ টিকা নেয়া ব্যক্তিদের শরীরে অ্যান্টিবডি প্রতি ৪০ দিনে অর্ধেক কমে যায়।
*বাস্তব বিশ্বের সংক্রমণের তুলনায় এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ‘ডেটাসেট’ অনেক কম ছিল।
*এটি অধিক সংক্রামক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে হয়তো ভালো কাজ করছে না। কারণ ইন্দোনেশিয়ায় সামপ্রতিক সংক্রমণের ৬০% ক্ষেত্রে এবং থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে ২৬% ক্ষেত্রে এই ভ্যারিয়েন্ট ধরা পড়েছে।

এদিকে, চীনের সঙ্গে এর আগে দেড় কোটি ডোজ টিকা কেনার চুক্তি করার পর এখন নতুন করে আবারো বাংলাদেশ সরকার চীনের প্রতিষ্ঠান সিনোফার্মের কাছ থেকে অতিরিক্ত ৬ কোটি ডোজ টিকা আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। দেশের সিটি করপোরেশন এলাকাগুলোতে মডার্নার টিকা দেয়া হলেও মূলত চীনের টিকা দিয়ে সারা দেশে কর্মসূচি চালানো হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *