নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে ভারতে মুসলিম নিধনের চিত্র
ভারতের আসামে সরকারি বাহিনী কর্তৃক মুসলমানদের উচ্ছেদ ও তাদের নির্যাতনের একটি চিত্র উঠে এসেছে মার্কিন গণমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে। অনুসন্ধানি এ প্রতিবেদনটি রোববার নিউইয়র্ক টাইমসের অনলাইন ভার্সনে প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয় :
পুলিশ তার বাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে, অসহায়ের মতো দৃশ্যটি দেখলেন আহমদ আলী।
তারা ঝাঁকে ঝাঁকে এলো গ্রামটিতে, উচ্ছেদবিরোধী শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে লাঠিচার্জ করলো। যখন বিক্ষোভকারীরা পাল্টা জবাব দেয়ার চেষ্টা করলো, তখন চালানো হলো গুলি। এতে নিহত হলো ১২ বছর বয়সী এক বালকসহ দুজন। পরে পুলিশ গ্রামের বাড়িগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিলো। এ আগুনে পুড়ে গেল গবাদি পশুসহ ঘরের সবকিছু।
এক ভিডিওতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বলছিলেন আহমদ আলী- ‘দয়া করে দেখুন, আমরা কি মিথ্যা বলছি?’
দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের গতমাসের এ সহিংসতার ভিডিও ও বর্ণনা ভারতের অনেকাংশকে ব্যথিত করেছে। ভাইরাল হওয়া এ ভিডিও বিশ্ববাসীর দৃষ্টিও আকর্ষণ করেছে।
স্থানীয় প্রশাসন বলছে, একটি বৃহৎ কৃষি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ‘অবৈধ বাংলাদেশীদের’ লক্ষ্য করে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।
কিন্তু সাক্ষাৎকার এবং হাতে পাওয়া ডকুমেন্ট পর্যালোচনা করে নিউইয়র্ক টাইমস জানতে পেরেছে বাস্তুচ্যুত করা বাসিন্দাদের অনেকেরই ভারতের বৈধ নাগরিকত্ব রয়েছে। তাদের বৈধ অধিকার রয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ভূমিতে বসবাসের।
সরকারের সমালোচকরা বলছেন, উচ্ছেদের বিষয়টি মূলত কেন্দ্রীয় সরকারি দলের দেশটির মুসলিম বিরোধী বৃহৎ প্রচারণা ও পদক্ষেপের অংশ।
দেশটির রাষ্ট্র কর্তৃক বাস্তুচ্যুত মানুষদের একটি সংগঠনের সহ-সভাপতি স্বপন কুমার ঘোষ বলেন, ‘তারা চায় মুসলমানরা হিন্দুদের দয়ায় কোনোরকমে বেঁচে থাকুক।’
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) হিন্দু জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়ে এমন উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে বিপদে পড়েছে দেশটির ২০ লাখেরও বেশি মুসলমান।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ভারত শরণার্থী বিষয়ক একটি আইন করে যেখানে পার্শ্বর্তী দেশগুলো থেকে আগত হিন্দু ও অন্য আরো পাঁচটি ধর্মের বাসিন্দাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু সেখানে স্থান পায়নি মুসলমানরা।
কয়েকটি রাজ্যে এমন একটি আইন বলবৎ করা হয়েছে, যেখানে বিয়ের মাধ্যমে ধর্ম পরিবর্তনকে ‘লাভ জিহাদ’ আখ্যা দিয়ে তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সবচেয়ে কঠিন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এক-তৃতীয়াংশ মুসলিম জনগোষ্ঠীর রাজ্য আসামে। ২০১৯ সালের গ্রীষ্মে নাগরিকত্ব পর্যালোচনার নামে নাগরিকত্বহারা করা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজারের মতো মানুষকে, যাদের বেশিরভাগই গরিব ও মুসলমান।
আর এখন রাজ্যটিতে হিমান্ত বিশ্ব শর্মার প্রশাসন জোর করে উচ্ছেদ করছে হাজারো মানুষদের, যাদেরকে তারা সন্দেহভাজন বিদেশী বলে চিহ্নিত করছে। স্থানীয় জনগণ ও মানবাধিকার গ্রুপগুলো বলছে, উচ্ছেদ করা মানুষগুলো প্রধানত মুসলমান।
বিশ্ব শর্মা সরকার সম্প্রতি রাজ্যের আদিবাসীদের মাঝে ভূমি পুনঃবণ্টনের পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছে।
দলের নেতারা ইতিমধ্যেই বিশ্ব শর্মাকে তাগিদ দিয়েছেন আরো বেশি উচ্ছেদ অভিযান চালাতে এবং বসতিপূর্ণ জায়গাগুলোতে আরো বেশি কৃষি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে।
এ ব্যাপারে আসামের কোনো কর্মকর্তা বা দলীয় কোনো নেতা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে মুখ্যমন্ত্রী বিশ্ব শর্মা এটিকে মুসলিমবিরোধী উচ্ছেদ অভিযান বলতে অনিচ্ছুক। তিনি বলছেন, তাদের এ কাজে ‘জনগণের সমর্থন রয়েছে’।
এ অভিযান এমন একটি অঞ্চলে হচ্ছে, যে অঞ্চলটি সবুজ পাহাড় ও চা বাগানের জন্য বিখ্যাত। সেখানকার অনেক মানুষ নিজেদেরকে ভারতীয় বলে পরিচয় দেয়ার আগে আসামি বলে পরিচয় দিতেই বেশি সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
স্থানীয় বাসিন্দানের অনেক যারা আসামি ভাষায় কথা বলেন, কখনো কখনো ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে চাপা ক্ষোভ দেখান। আর এর মাধ্যমে অঞ্চলটিতে তৈরি হয়েছে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের।
হিন্দু-মুসলিমসহ অনেক আসামি আদিবাসী দীর্ঘদিন ধরে এ দুশ্চিন্তায় আছেন যে, তারা কখন শরণার্থী হিসেবে চিহ্নিত হন। বিশেষত মুসলমানরা যারা বাংলায় কথা বলেন।
জোর করে উচ্ছেদের ঘটনা কয়েক দশক ধরেই চলে আসছে কিন্তু গত ২৩ সেপ্টেম্বরের সংঘর্ষ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
আহমদ আলী ও আরো বেশ ক’জন গ্রামবাসী জানিয়েছেন, পশ্চিম আসামের ধোলপুরের বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনী লাঠিচার্জ করে। বিক্ষোভকারীরাও কেউ কেউ লাঠি দ্বারা প্রতিরোধের চেষ্টা করে। এ সময় পুলিশ বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালায়। এ সময় তারা বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং মসজিদ-মাদরাসায় ভাংচুর চালায়।
এ ঘটনায় মইনুল হক নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, গুলি খেয়ে মইনুল হক মাটিতে পড়ে যান। তারপরও পুলিশ সদস্যরা তাকে লাঠি দ্বারা আঘাত করতে থাকেন। পরে স্থানীয় প্রশাসনের হয়ে কাজ করা একজন ফটোগ্রাফার তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার আঘাতে মইনুলের বুক থেকে রক্ত ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
তাকে সরকারের দেয়া পরিচয়পত্র ‘দি টাইমস’কে দেখায় তার পরিবার, যেখানে দেখা যায়, তিনি ছিলেন একজন ভারতীয় নাগরিক।
পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, তার বয়স ২৮ বছর। তারা ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে একটি চরে টিন ও কাঠ দিয়ে তৈরি করা ঘরে বসবাস করছেন। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা যায় দুজন নারী কান্নাকাটি করছেন।
নিজের ৯ বছরের মেয়ের দিকে তাকিয়ে কান্না স্বরে মইনুলের স্ত্রী মমতাজ বেগম বলছিলেন, ‘আমরা তাকে (মইনুল) ছাড়া কীভাবে বাঁচব? কীভাবে আমি বাচ্চাদের বড় করব?’
মইনুল হকের আত্মীয়-স্বজনরা বলছেন, নিরাপত্তাবাহিনীর কর্মীরা তাদের হুমকি দিয়েছেন যেন তারা তার লাশের কাছে না আসে বা লাশ স্পর্শ না করে। তারা তার লাশকে একটি বুলডোজারের সাথে বাঁধে এবং ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যায়।
তবে এ ব্যাপারে পুলিশ কোনো মন্তব্য করেনি।
মইনুল হকের ছোট ভাই আইনুদ্দিন বলেন, ‘আমরা মুসলমান হওয়ার কারণেই তারা আমাদের অত্যাচার করে।’
স্থানীয়রা বলছেন, তারা এখানে বসবাস করছেন এবং চাষাবাদ করছেন কয়েক দশক ধরে। মইনুলের পরিবার ও অন্যরা তাদের জমির খাজনা দেয়ার ডকুমেন্ট এ প্রতিবেদককে দেখিয়েছেন।
তবুও সরকারের পরিকল্পনা হলো, এখানে কৃষিকাজের জন্য জমির উন্নয়ন করবে এবং তা ধোলপুরে নতুন করে ভূমিহীন হওয়া আদিবাসীদের মাঝে বরাদ্দ দিবে, যারা বেশিরভাগই হিন্দু।
সেখানকার একটি হিন্দু মন্দিরের পুরোহিত উধব দাস বলছিলেন, ‘এই লোকগুলোকে উচ্ছেদ করাটা খুব ভালো একটি কাজ হয়েছে। কারণ হিন্দুরা তাদের জমি ফিরে পাবে।’
মসজিদ-মাদরাসা উচ্ছেদের ব্যাপারে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘হিন্দুদের মসজিদ ও মাদরাসার দরকার নেই।’
আইনজীবীরা ও বিরোধী রাজনীতিবিদরা সতর্ক করে বলছেন, আসামের রাজনৈতিক গোষ্ঠী ধর্মীয় বিভেদকে মারাত্মক পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে।
সেখানকার বিরোধী এক নেতা আখিল গোগি বলেছেন, ‘এটি একটি বর্বর সরকারের বর্বর কর্মকাণ্ড।’ গোগি কঠোর ভারতীয় নিরাপত্তা আইনের মামলায় খালাস পেয়ে গত চার মাস আগে জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
কৃষক আহমদ আলী বলছিলেন, বাড়িতে লাগিয়ে দেয়া আগুনে তার জমির দলিলপত্র পুড়ে গেছে। তিনি বলছিলেন, পুলিশ শুধু বাড়িগুলোই পোড়ায়নি, পুড়িয়ে দিয়েছে তাদের স্বপ্নগুলোও।
‘আগুন শুধু বাইরেই পোড়াচ্ছিল না, অনুভব করেছি এটা আমার ভেতরও পুড়িয়ে দিচ্ছে।’