৪৭% শিশুর জন্ম অদক্ষ হাতে

♦ দেশে প্রতি এক লাখ শিশু জন্ম দিতে গিয়ে প্রাণ হারান ১৭৩ নারী ♦ করোনাকালে বাল্যবিবাহ ১৩ শতাংশ বেড়েছে ♦ প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে অল্প বয়সে গর্ভধারণ, গর্ভপাত এবং অনিরাপদ সন্তান প্রসবের বিভিন্ন ঘটনা তুলনামূলকভাবে বেড়েছে -মনজুন নাহার, মেরী স্টোপস-বাংলাদেশের অ্যাডভোকেসি বিভাগের প্রধান

করোনা মহামারিকালে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ ও শিশু জন্মের হার নিকট অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ বাল্যবিবাহ। করোনাকালে বাল্যবিবাহ ১৩ শতাংশ বেড়েছে। আবার লকডাউন, হোম অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধসহ এমন কিছু বিষয় বিবেচনায় সন্তান জন্মদানের এটাই সঠিক সময় বলে মনে করে অনেক পরিবার।

ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে পরিবার পরিকল্পনা ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে অ্যাপভিত্তিক সেবা ও সচেতনতা বাড়ানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

এমন অবস্থায় ১১ জুলাই পালিত হয়েছে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘৮০০ কোটির পৃথিবী; সবার সুযোগ, পছন্দ ও অধিকার নিশ্চিত করে প্রাণবন্ত ভবিষ্যৎ গড়ি’। করোনাকালে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এই প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়ছ। কারণ বৈশ্বিক মহামারি শুরুর দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা একাধিক প্রতিবেদনে এই সময়ে সারা বিশ্বে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের ফলে শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার বেড়ে যাওয়াসহ বেশ কিছু আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। করোনা পরিস্থিতিতে বাল্যবিবাহের ঘটনাও বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হয়, গত আড়াই বছরে যার সত্যতা মিলেছে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্রাকের গবেষণায় উঠে এসেছে, বৈশ্বিক মহামারি করোনার মধ্যে এ দেশে বাল্যবিবাহ ১৩ শতাংশ বেড়েছে, যা গত ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। করোনাকালে অভিভাবকদের কাজ না থাকায়, সন্তানের স্কুল খোলার অনিশ্চয়তায়, করোনা মহামারি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কায় অনিরাপত্তাবোধ এবং বাইরে থেকে আসা ছেলে হাতের কাছে পাওয়ায় বাল্যবিবাহ বেড়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) ‘বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি-২০২১’ প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগে ৫৯ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হয়। ১৫ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে তারা মা হতে গিয়ে মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়ে। আরো বলা হয়, করোনার কারণে আশঙ্কাজনক হারে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ায় এবং স্কুল বন্ধ থাকায় বাল্যবিবাহ বেড়েছে। এতে অতিরিক্ত ৩.৫ লাখ শিশু গর্ভবতী হয়েছে। ১.৯ লাখ শিশু পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

ইউএনএফপিএসহ একাধিক বেসরকারি সংস্থার তথ্য মতে, বর্তমানে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়স নারীদের মধ্যে ৫৩ শতাংশেরই ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়েছে, যাঁরা প্রজনন স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ে তেমন সচেতন নন। এ কারণে বাংলাদেশে অনেক নবজাতকের মৃত্যু হয়। অদক্ষ হাতে জন্মও নবজাতকের মৃত্যুর আরেকটি কারণ। সরকারের নানা পদক্ষেপ সত্ত্বেও এখনো ৪৭ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় অদক্ষ হাতে। তাই বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ১৭৩ জন মা প্রাণ হারান।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, ১৮৬০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল মাত্র দুই কোটি। ১৯৪১ সালে তা বেড়ে হয়েছিল চার কোটি ২০ লাখ। অর্থাৎ ৮১ বছরে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বাড়ে মাত্র দুই কোটি ২০ লাখ। আবার ১৯৬১ সালে জনসংখ্যা ছিল পাঁচ কোটি ৫২ লাখ, যা ১৯৯১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১১ কোটি। অর্থাৎ ৩০ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ। ২০১২ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৫ কোটি ২৭ লাখ। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ কোটি আট লাখ।

বিবিএসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯১ লাখ এক হাজার। সে হিসাবে বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটির বেশি। এ হারে বাড়তে থাকলে ২০৫০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২২ কোটি ২৫ লাখে, যা জন্ম নিয়ন্ত্রণে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু হার কমানো, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা রোধ ইত্যাদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এই অবস্থায় পরিবার পরিকল্পনা সেবার মান উন্নয়নে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে সবার সম্পৃক্ততায় সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কাজি আ খ ম মহিউল ইসলাম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে অনলাইন স্বাস্থ্যসেবার আওতা বাড়াতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নতুন করে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় সার্ভিস সেন্টারে গিয়ে সেবা গ্রহণ বা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবার পরিকল্পনা তথ্য সরবরাহের পরিবর্তে অ্যাপভিত্তিক সেবা বাড়াতে হবে। সেবাগ্রহীতা ও সেবা প্রদানকারী উভয় পক্ষকেই মোবাইলের ব্যবহার বাড়িয়ে ডিজিটাল সেবায় দক্ষ করতে হবে।

মেরী স্টোপস-বাংলাদেশের অ্যাডভোকেসি বিভাগের প্রধান মনজুন নাহার কালের কণ্ঠকে বলেন, করোনাকালে প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে অল্প বয়সে গর্ভধারণ, গর্ভপাত এবং অনিরাপদ সন্তান প্রসবের বিভিন্ন ঘটনা তুলনামূলকভাবে বেড়েছে, যা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে। তবে করোনা মহামারির প্রথম দু-তিন মাস পরিস্থিতি বুঝতে সময় নিলেও, পরবর্তী সময়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সহযোগিতায় মেরী স্টোপস নিরাপদ মাতৃত্ব, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারসহ এসংক্রান্ত যাবতীয় সেবা প্রদানে কাজ করে যাচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।