‘অলআউট’ মাঠে নামার প্রস্তুতি বিএনপির
চূড়ান্ত আন্দোলনের খসড়া প্রস্তুত
প্রথম ধাপে রোডমার্চ ফাইনালে ঢাকা ঘেরাও * সমমনাদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক, আসছে যৌথ ঘোষণাপত্র * কাল সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বিএনপির হাইকমান্ডের মতবিনিময়
বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলনের রোডম্যাপের খসড়া প্রায় চূড়ান্ত। এতে প্রথম দফায় বিভাগীয় শহরে রোডমার্চসহ সবশেষে ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচি থাকছে। বাধা দেওয়া হলে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দেবে মাঠের বিরোধী দল।
তবে সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনের পরিকল্পনা রয়েছে ঈদুল আজহার পরই। যার ওয়ার্মআপ বা প্রস্তুতি পর্বের রিহার্সেল হতে পারে কিছুদিনের মধ্যে। গোপনীয় রোডম্যাপে আন্দোলনের এমন পরিকল্পনা রয়েছে।
রোডম্যাপ অনুযায়ী চূড়ান্ত আন্দোলনে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে ফলাফল ঘরে তুলতে চায় বিএনপি। এছাড়া হঠাৎ জাতীয় নির্বাচনের তফশিল এগিয়ে আনার গুঞ্জন রয়েছে। সরকারের এমন কূটকৌশলকেও মাথায় নিয়ে আন্দোলন পরিকল্পনায় বিকল্প রোডম্যাপ করা হচ্ছে। উপরন্তু মাঠের আন্দোলন যখন তুঙ্গে যাবে, তখন বিদ্যমান পরিস্থিতি বুঝেই কৌশল নির্ধারণ করবে দলটির হাইকমান্ড। বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
এদিকে রোডম্যাপ চূড়ান্তের আগে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর মতামত নিতে সিরিজ বৈঠক করছেন বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। আগামীকাল সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে মতবিনিময় করবে হাইকমান্ড। এর আগে সাড়ে ৩ হাজার ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক ও বর্তমান চেয়ারম্যানদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করে তাদের পরামর্শ নেওয়া হয়েছে।
সব পক্ষের মতামত বিশ্লেষণ করে আন্দোলনের প্রথম দফার কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হচ্ছে। এ দফায় ঢাকা থেকে বিভাগীয় শহরে রোডমার্চ করার পক্ষে প্রায় সবাই মত দিয়েছেন। সোমবার বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও এ ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলসহ সবার মতামতের একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করে হাইকমান্ডের কাছে জমা দেবেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। আগামী সোমবার স্থায়ী কমিটির পরবর্তী বৈঠকে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। সেখানেই চূড়ান্ত করা হবে প্রথম ধাপের কর্মসূচি ও দিনক্ষণ। এরপর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তা ঘোষণা করা হবে। তবে অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, বিএনপির নয়া আন্দোলন কর্মসূচিতে দেশি-বিদেশি প্রভাবশালী মহলের প্রভাব বিস্তার করার যথেষ্ট সুযোগও রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, ভূরাজনৈতিক ও পররাষ্ট্রনীতির নানান দিক বিশ্লেষণ করে বিএনপি অবশ্যই ভবিষ্যৎ রাজনীতির ফলাফল বিশ্লেষণ অব্যাহত রাখবে। সেক্ষেত্রে দলটির প্রকৃত কর্মসূচি কখনো জনসম্মুখে আসবে না। এটাই রাজনীতির কৌশল। কেননা প্রতিপক্ষ দল যদি অপরপক্ষের সব কৌশল-কর্মসূচি জেনে যায়, তাহলে সেটি সফল হওয়ার সুযোগ থাকে না। এছাড়া শেষ কথা হলো-বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষ যতক্ষণ কোনো আন্দোলনে সম্পৃক্ত হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত শুধু দলীয় নেতাকর্মী দিয়ে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন সফল করার সুযোগ নেই।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়াসহ জনদাবি নিয়ে বিএনপি রাজপথে আন্দোলন করে আসছে। আমাদের এ আন্দোলনে সাধারণ মানুষও সাড়া দিয়েছে। দেশকে ভয়াবহ সংকট থেকে রক্ষার একমাত্র সমাধান হচ্ছে এ সরকারের পতন। শুধু বিএনপি নয়, দেশের বিভিণ্ন শ্রেণি-পেশার মানুষও তাই চায়। তিনি বলেন, সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলন শিগগিরই আরও জোরদার করা হবে। দেওয়া হবে নতুন কর্মসূচি। তবে সেটাও হবে শান্তিপূর্ণ। গণতান্ত্রিক এ আন্দোলন দ্রুতই গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেবে এবং তাতে সরকারের পতন নিশ্চিত হবে বলে আশা করি। এবার কোনো বাধাই এ আন্দোলনকে রুখতে পারবে না।
জানা গেছে, সোমবারের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এতে প্রায় সব নেতাই ধারাবাহিক কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলন জোরদার করার পক্ষে মত দেন।
এক নেতা বলেন, চূড়ান্ত আন্দোলনের শুরুতেই হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দেওয়া ঠিক হবে না। শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সরকারের ওপর প্রবল চাপ তৈরি করতে হবে।
সরকার যদি সেই কর্মসূচিতে বাধা দেওয়াসহ কঠোর অবস্থানে যায়, ঠিক সেই জনদাবির মুখে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি দেওয়া হবে। তাতে সাধারণ মানুষেরও সমর্থন পাওয়া যাবে। সবাই বলবে সরকারই বিএনপিকে কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য করেছে।
স্থায়ী কমিটির দুজন নেতা যুগান্তরকে বলেন, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্র সফর নিয়েও আলোচনা হয়েছে। প্রায় সব নেতাই অভিন্ন সুরে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফর ব্যর্থ।
তিনি যে গোপন মিশন নিয়ে সেখানে গেছেন সেটি এখন পর্যন্ত সফলতার মুখ দেখেনি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কিংবা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কারও সঙ্গেই তিনি দেখা করার সুযোগ পাননি। ফলে তাকে জনদাবির মুখে একটা পর্যায়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন দিতেই হবে। তবে এ সফর নিয়ে দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী কিংবা আওয়ামী লীগ যাতে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে না পারে সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের তিনজন নেতা যুগান্তরকে বলেন, চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রথম ধাপে এসএসসি পরীক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ২৩ মে শেষ হবে লিখিত পরীক্ষা।
এরপর ব্যবহারিক পরীক্ষা চলবে ৩০ মে পর্যন্ত। সে হিসাব করে মের শেষদিকে বা জুনের শুরুতে বিভাগীয় শহরে রোডমার্চ চূড়ান্ত করার সম্ভাবনা রয়েছে। শুরুতে দুটি বিভাগে এ কর্মসূচি দেওয়ার চিন্তাভাবনা রয়েছে।
সেটা সফল হলে পরে অন্যান্য বিভাগেও একই কর্মসূচি পালন করা হতে পারে। তারা আরও বলেন, ঈদুল আজহার আগে রোডমার্চসহ ধারাবাহিক কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলনের একটা গতি তৈরি করা হবে।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি যাতে কম হয় সে ব্যাপারেও দলের পক্ষ থেকে নেওয়া হবে নানা উদ্যোগ। সংলাপ কিংবা সরকারের কোনো কৌশলকেই এবার তারা গুরুত্ব দেবে না।
ঈদুল আজহার পরই শুরু হবে ফাইনাল। রাজপথেই হবে ফয়সালা। তবে অতীতের মতো এবার আন্দোলন দীর্ঘসময় টেনে নেওয়া হবে না। অল্প সময় টার্গেট করে অলআউট মাঠে নামা হবে।
এ সময়টা হবে সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ। আন্দোলনের শেষ ধাপে ঢাকা ঘেরাওয়ের কর্মসূচিকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে গণভবন, বঙ্গভবন কিংবা সচিবালয় ঘেরাওয়ের ঘোষণা আসতে পারে।
সারা দেশ থেকে নেতাকর্মীদের ঢাকায় আসার নির্দেশ দেওয়া হবে। আসার পথে সরকার বাধা, হামলা কিংবা গণগ্রেফতার শুরু করলে তা প্রতিহত করার প্রস্তুতি নিতে ইতোমধ্যেই তৃণমূলে বার্তা পাঠানো হয়েছে।
ওই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সারা দেশে সংঘাত, সংঘর্ষ কিংবা প্রাণহানি হলে তাৎক্ষণিকভাবে টানা হরতাল কিংবা অবরোধ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল যুগান্তরকে বলেন, চলমান আন্দোলন আরও জোরদার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। শিগগিরই তা সরকার পতনের এক দফায় রূপ নেবে। সে লক্ষ্যে কর্মসূচি চূড়ান্তের কাজ চলছে। তিনি বলেন, কর্মসূচি সফলে অলআউট মাঠে নামতে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। সংলাপ কিংবা সরকারের কোনো ফাঁদেই আমরা পা দেব না। রাজপথেই হবে ফয়সালা।
সমমনাদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক-শিগগিরই যৌথ ঘোষণাপত্র : আন্দোলনের কর্মসূচি চূড়ান্তের আগে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করছে বিএনপি। ২৯ এপ্রিল গণফোরাম ও পিপলস পার্টির সঙ্গে মতবিনিময় করা হয়। পরের দিন বৈঠক করে বাম গণতান্ত্রিক ঐক্যের সঙ্গে। সোমবার ১১ দলীয় জোটের সঙ্গে বসেন দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
মঙ্গলবার বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির সদস্যরা গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বৈঠকে চলমান আন্দোলন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যুগপৎ আন্দোলন অব্যাহতভাবে চলছে। এই আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যেসব কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন আমরা সেগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি। খুব শিগগিরই একটি যৌথ ঘোষণা জাতির সামনে তুলে ধরা হবে।
গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক রাষ্ট্রসংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম বলেন, আলোচনার একটা জায়গা হচ্ছে-অতীতে যেভাবে আন্দোলনে সরকার পরিবর্তন হয়েছে বাংলাদেশে, বর্তমানের আন্দোলন এর চেয়ে আলাদা। বৈঠকে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু এবং জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহিদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন ছাড়াও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, আন্দোলনের কর্মসূচির পাশাপাশি অভিন্ন দাবিতে যৌথ ঘোষণাপত্র তৈরিতে সমমনা দলগুলোর মতামত নেওয়া হয়। বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চ আলাদাভাবে সরকার পতনসহ ১০ ও ১৪ দফা দাবি তুলে ধরে।
এ নিয়ে তাদের মধ্যে কিছুটা মতপার্থক্য তৈরি হয়। যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অন্য দলগুলো কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হয়। এমন পরিস্থিতিতে সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে একটি যৌথ ঘোষণাপত্র তৈরির সিদ্ধান্ত হয় এবং সে লক্ষ্যে কাজ চলছে।
কোনো একক দল বা জোটের পক্ষ থেকে আলাদা দফা না দিয়ে তা সমন্বয় করে একটি যৌথ ঘোষণাপত্র তৈরি করা হচ্ছে। বিএনপির ১০ দফা দাবির সঙ্গে অন্যদের কিছু প্রস্তাব সন্নিবেশিত করা হবে। সেগুলো উপদফা কিংবা মূল দফার সঙ্গে যুক্ত করা হতে পারে। আরও জানা যায়, সমমনা দলগুলো আলাদাভাবে কোনো কর্মসূচি পালন করলে তাতে বিএনপি নেতাকর্মীদের অংশ নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে।