মেরুদন্ডহীন আওয়ামী বুদ্ধিজীবি সমাজ

সামিউজ্জামান সিদ্দিকীর বিশেষ কলাম

১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরে সবচেয়ে বেশি লাভ হওয়ার কথা ছিলো পাকিস্তানের, কিন্তু শেষ পর্যন্ত লাভ হয়েছে মূলত বর্তমান ক্ষমতায় থাকা আওয়ামিলীগের! ১৪ই ডিসেম্বর সত্যিকারের বুদ্ধিজীবী নিধনের পরে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছরে বর্তমান আওয়ামিলীগ পেয়েছে একজাতের দলদাস শ্রেণির নামমাত্র বুদ্ধিজীবী।

এই অপূর্ব বুদ্ধিজীবী ক্রয় প্রকল্প আর অতীতে কখনো ঘটেছে কি?

এদের কাছে চেতনাধারী ফ্যাসিস্ট এতই পূজনীয় যে দ্রব্যমূল্য বাড়া, বিচার বহির্ভূত হত্যা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের টর্চার সেলে ছাত্র হত্যা, সীমান্তে হত্যা, ক্যান্টনমেন্টের ভেতর ঘটে যাওয়া রেপকে ‘ভালুকের কামড়’ বলা, ভোট না হওয়া, গুম করা, কারাগারে নির্যাতনে লেখক লেখক মুশতাক আহমেদ হত্যা- কিছুই গুরুত্বপূর্ণ না। কারণ এরা চেতনা খাবে, মাখবে, চেতনার কথা বলে স্টেডিয়ামে গিয়ে পাকিস্তান সমর্থক পিটানোকে সমর্থন দিবে, কিন্তু লোকে খাইতে না পাইলে, গুম হইলে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা খাইলে অচেতন হয়ে টুঁশব্দও করবে না এবং যাইই ঘটবে তাতেই ‘প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ’ দিতে থাকবে।

এই মেরুদণ্ডহীন বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় কি একদিনে হয়েছে?

বিএনপি যেমন সরাসরি রাজাকারদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছিল, আওয়ামীলীগ সেই ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে তুলে দিয়েছে নিজেদের পেটোয়া এক মাফিয়া বাহিনীর হাতে, যারা তাদের অবৈধ ক্ষমতায় টিকে থাকতে সবরকম সাহায্য করবে।

এই মাফিয়া সিন্ডিকেটে একাধারে আছে সাংবাদিক, পুলিশ, আর্মি, ব্যবসায়ী, ব্যাংক ও সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে খোদ বুদ্ধিজীবী শিল্পী, লেখক ও শিক্ষক! ফলে ঘটনা কত সূদুরপ্রসারী হয়েছে ভেবেছেন?

অতীতের যত সরকার ক্ষমতায় এসেছে ও গেছে তারা সবাইকে কিনে ফেললেও বুদ্ধিজীবীদের কিনতে পারে নাই। এমনকি জেনারেল এরশাদকেও জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বুদ্ধিজীবী শিল্পী কামরুল হাসান এঁকেছেন ‘বিশ্ববেহায়া’ হিসেবে।

কিন্তু আওয়ামীলীগকে যারাই আঁকার চেষ্টা করেছে তারাই হয়ে গেছে আওয়ামীলীগের নিজস্ব ভাষায় ‘স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি’!

ফলে দেশে অবস্থিত শিশির ভট্টাচার্য কখনোই আর কার্টুন আঁকেন না, আহসান হাবিবরা আঁকেন তথাকথিত রাজনীতি বিবর্জিত ছবি।

আওয়ামীলীগের সবচেয়ে বড়ো অর্জন হলো- তাবৎ বুদ্ধিজীবীদের নীরবতা খরিদ করা! এই নীরবতা ও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি সেজে অপকর্ম করার লাইসেন্স অতীতের আর কেউ কিনেছে কি? অবশ্য যেদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ নিজেদের মাথা বিক্রি করে করে দেয় তাদের জন্য মাথাব্যথা কি আমার সাজে?

আহমদ ছফা বলেছিলেন- বাংলাদেশকে একশো ভাগ সেক্যুলার না বানাতে পারলে যা থাকবে তা মূলত পাকিস্তান! যেহেতু আওয়ামিলীগ সেক্যুলারিজম নিয়েও ব্যবসা করেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাইনবোর্ড টানিয়ে রেখে সকল অন্যায় হালাল করেছে এবং অন্যদিকে বিএনপি নামের দলটি জামায়াতের মতো একটা হতভাগা জঘন্য মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী দলের সাথে একত্রিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধকে হাটে-বাজারে বিক্রি করে দিয়েছে তাতে শেষ পর্যন্ত যা আছে- তা মূলত পাকিস্তানই!

নতুন পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীরা যে তাদেরই তল্পিবাহক হবে, তাতে আর আশ্চর্যের কি আছে?

হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন- যে বুদ্ধিজীবী নিজের সময় ও সমাজ নিয়ে সন্তুষ্ট, সে গৃহপালিত পশু।

৫০ বছর পরে একদল গৃহপালিত পশু পাওয়াই ১৪ ই ডিসেম্বরের ট্র‍্যাজেডি ও বর্তমান আওয়ামিলীগের কৃতিত্ব। কারণ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীলনকশাকারী রাও ফরমান আলীদের কিচ্ছু হয় নাই, বরং নির্বিঘ্নে বিনাবিচারে মরে প্রমাণ করেছে- তাদের বুদ্ধিজীবী নিধনের পরিকল্পনা কতটা সুদূরপ্রসারী ছিলো!

১৯৭১ সালের বুদ্ধিজীবীরা যেকারণে গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন, ২০২১ সালের পোষা বুদ্ধিজীবীরা ঠিক সেকারণেই প্রতিবাদহীন পোষা প্রাণীর মতো বেঁচে আছে, শুধু মরে গেছে সেই বাংলাদেশ যে বাংলাদেশ আমরা আর কখনোই পাবোনা!

১৯৭১ সালে ১৪ ই ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে তাই একটা কথাই বলা যায়- বোলোনা বুদ্ধিজীবীদের মেরে ফেলা হয়েছে, বরং বলো বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে যেন পরের যুদ্ধটা লড়ার লোক তুমি আর খুঁজে না পাও!

আমি বাংলাদেশের পরের যুদ্ধগুলো লড়ার জন্য বিশ্বস্ত সেনাপতি হওয়ার মতো লোক দেখিনা, আপনি দেখেন?