বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর শুরু হয় কিভাবে?

লিখেছেন রেদোয়ানুর রহমান

কোনো ঐতিহাসিক হ্যাপি একসিডেন্ট ছাড়া বাংলাদেশে কোনোদিনও স্ক্র্যাচ থেকে একটা পলিটিকাল পার্টি তৈরী হবে না। একশ বছর পরেও হবে না। আওয়ামী লীগ হয়েছে ফার্স্ট মুভার এডভান্টেজের কারণে আর বিএনপি হয়েছে ক্ষমতায় থেকে। নীচের থেকে অরগ্যানিকভাবে একটা পলিটিকাল পার্টি তৈরী – বাংলাদেশে সম্ভব না। এইখানে নতুন পলিটিকাল পার্টি হবে টপ-ডাউন মেথডে – নইলে না। এর মূল কারণ বাংলাদেশের মানুষরা “অযোগ্যতা” কী – এ সম্বন্ধে কিছু জানে এবং অযোগ্যতাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য সদাপ্রস্তুত (তবে সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না) – কিন্তু যোগ্যতা কী – এ সম্বন্ধে নূন্যতম ধারণাও রাখে না এবং যোগ্যতাকে পুরস্কৃত করার কল্পনার জন্য যে ভাষা লাগে – সেটাই তার নাই।

বাংলায় কল্পনা করে বলে সে শুধু নিজেকে নিবেদন করতে শিখে। দেখবেন যে বাঙালি মাত্রই যোগ্য ও গুণী মানুষ দেখলে একদম নিজেকে সমর্পণ করে দেয় – পূজারীর মতো। সে “পবিত্রতা” ইনভোক না করে “প্রশংসা” কল্পনা করতে পারে না। একটা উদাহরণ দেই?ঢাকা ১৭’র এলেকশানে একজন ক্যান্ডিডেট ধরেন যে দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত (বড় পিতার মতো) ও কমিটেড গান্ডু (ছোটো পিতার মতো) কিন্তু মিথ্যায় পারদর্শী বাকপটু (হে মাতার মতো) – অন্যদিকে আরেকজন ক্যান্ডিডেট ধরেন যে একটি মেয়ে – রুমীন ফারহান কিংবা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। এবং দুই ক্যান্ডিডেটই ধরেন আওয়ামী-বিএনপি বাইনারীর বাইরে।

নির্বাচনের এক মাস আগে ধরেন রুমীন ফারহানা কিংবা রিজওয়ানা কোনো এক ডিনার টেবলে বললেন যে, লুঙ্গি পরে ফকিন্নীরা এবং এটা ধরেন যে ‘ভায়রাল’ হয়ে গেলো। আমি বাজি ধরে বলতে পারি বাংলাদেশের একজন এভরেজ ভোটারের মাথায় এক হাজার কোটি টাকা চুরির থেকে একটা মেয়ের “লুঙ্গি পরে ফকিন্নীরা” বলাটা অনেক অনেক বেশী অগ্রহণযোগ্য। একটা নিরপরাধ শিশু (দেখতে কালো ও লুঙ্গি পরা) পুলিসের গুলিতে মারা গেলো – এটা তাকে রাগায় না কিন্তু কেউ একজন বললো যে পান্তা একটা ডিজগাস্টিং খাবার – এটা শুনলে সে ক্ষোভে ফেটে পরে। লিট্রেলি, সে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।

একজন এভরেজ বাংলাদেশী, দুইজন ক্যান্ডিডেটের একজনকে কেন পানিশ করতে হবে – এটা বোঝে কিন্তু যাকে তার পুরস্কৃত করা উচিত – সেটা কেন করা উচিত – একেবারেই বোঝে না। সেই ভাষাটাই তার নাই।বাংলায় নৈর্ব্যক্তিক চিন্তা করা অসম্ভব – অন্তত একটা ক্রিটিকাল ম্যাসের জন্য অসম্ভব। ফলে এই চিন্তার মানুষদের জন্য কোনো নির্দিষ্ট ‘লক্ষ্যে’ হয়তো একতাবদ্ধ হওয়া সম্ভব (যেমন সরকার পতন, দেশ স্বাধীন করা) – কিন্তু কোনো প্রিন্সিপালের জন্য একতাবদ্ধ হওয়া অসম্ভব। কোনো এবস্ট্রাক্ট আইডিয়াকে সে দীর্ঘদিন ধারণ করতে পারে না। তার চাই প্রচুর ভাত, লম্বা বিল্ডিং, ৩০০ ফিট রাস্তা ও ২ কিমি ব্রিজ। একটা নতুন পলিটিকাল পার্টির কাজই হোলো প্রিন্সিপালে অনড় থাকা। এই কাজটাকে যে রেকগনাইজ করবে – সেই মানুষই তো এইদেশে নাই। তার আছে একটা গরীব দেশ – এটা অজুহাত কল্পনা করে সে যে কী স্বস্তি বোধ করে – বলে বোঝানো সম্ভব না। ব্রাজিল সেনেগালের কাছে ৪-২ গোলে হেরেছে – এর চাইতেও বেশী।

যেইমাত্র আওয়ামী লীগের পতন হবে দেখবেন যে সবার আগ্রহ কীভাবে মজিবকোটদের পানিশ করা যায় – কিন্তু পরের সরকার কী ভালো কাজ করলো, কী তার চ্যালেঞ্জ – এ নিয়ে সে কিছুই বুঝবে না। ৬ থেকে ৮ মাসের মধ্যে সে ভুলে যাবে আগে কী অবস্থা ছিলো! আমি তারেক রহমান সাহেবকে এই প্রশ্নটা করেছিলামও। “ধরেন যে বিএনপি একসময় ক্ষমতায় আসলো এবং এই দেশের মানুষকে পূর্ণ বাক-স্বাধীনতা দিলো। এই দেশের মানুষ কি আপনার মনে হয় যে এই বাক-স্বাধীনতা পাওয়াটাকে মোটেও রেকগনাইজ করবে? তখন তো এই পত্রিকাগুলোই প্রতিদিন আপনাকেই গালি দিবে। আপনার কি মনে হয় মাহফুজ আনাম, মতিউর রহমানদের পক্ষে এই বাক-স্বাধীনতা রেকগনাইজ করা সম্ভব? ৬ মাস পরেই তারা কল্পনা করে নিবেন যে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার সময়ও বাকস্বাধীনতা ছিলো। মানে আপনার মা এবং আপনি নিজে – প্রতিদিন গালি খাওয়ার মাধ্যমে মাহফুজ আনাম, মতিউর রহমানদের ক্রেডিবিলিটি ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবেন।

এটা কি আসলেই আপনারা করবেন?”তার উত্তর ছিলো যে বাংলাদেশের মানুষ সেটা অবশ্যই রেকগনাইজ করবে। এই ব্যাপারে তার কমিটমেন্ট আমার কাছে অনেস্ট মনে হয়েছে – এট লীস্ট ওনাদের ট্র্যাক রেকর্ড ভালো – ২০০৫ সালের প্রথম আলোর এডিটোরিয়াল কার্টুন দেখলেই বুঝবেন। তাছাড়া ওনার কাছে আমার প্রশ্নগুলো খুবই আপত্তিকর – উনি সেগুলো স্বাভাবিক ভাবেই নিতে পারেন। দেখেন ভবিষ্যতে কী হবে সেটা আল্লাহ জানেন কিন্তু তারেক রহমান সাহেব কিংবা আলমগীর সাহেবকে আপনি যেকোনো প্রশ্ন করতে পারবেন – তারা/তাদের লোক রামদা দিয়ে আপনাকে কোপাবে না – ব্যাগের থেকে শংকর মাছের চাবুক বের করে পেটাবেন না।উনি রাজনীতিবিদ এবং বাংলাদেশের মানুষকে অবশ্যই আমার চেয়ে ভালো বোঝেন – সন্দেহ নাই।

কিন্তু আমি তার এই আশাবাদ শেয়ার করি না। এই সমস্যা যে কোন লেভেলে যাবে – আমার মনে হয় না যে তিনি সেটা কল্পনা করতে পারছেন। অবশ্য না পারলেই ভালো। আমি বাকস্বাধীনতার পক্ষের মানুষ – আমি চাই আপনি তারেক রহমান, খালেদা জিয়া, জিয়াউর রহমান – সবাইকে ইচ্ছামতোন সমালোচনা করবেন – এবং সেটা ঢাকাতে বসেই। একটা সভ্য দেশে সেটাই হওয়া উচিত।কিন্তু এই সমালোচনা করতে পারার “সুযোগ”কে এই দেশের মানুষ কখনোই মূল্যায়ন করবে না। উল্লাপাড়া ছাত্রদলের নেতা সবুর খানের কাউকে থাপ্পড় দেয়া ও আয়নাঘরকে বাঙালি; বিশাল সংখ্যক বাঙালি – ফ্রীডম অফ স্পীচের বিরুদ্ধে একই ব্যত্যয় মনে করবে।যে ভাষায় কথা বললে আপনার বোল ও হৃদয়ের মাঝে একটা সুষম মেলবন্ধন হয় – সেই ভাষাটা আমাদের নাই। ভালো কাজের, সততা ও যোগ্যতার প্রতিক্রিয়া আমাদের দেশে হোলো জানাজায় পার্টিসিপেট করা, কান্নাকাটি করা ও ফেইসবুকে স্টেটাস দেয়া যে আহা! বড় ভালো মানুষ ছিলো! এরকম দেশে অরগ্যানিকভাবে নতুন পলিটিকাল পার্টির কোনো জায়গা নাই। তবে জোনায়েদ সাকী সাহেবের দলের মতো মানববন্ধন ও পিআর মূলক পলিটিকাল পার্টির হিউজ পোটেনশিয়াল ও নীশ আছে – এটা স্বীকার করি।