ফুলবাড়ি কয়লা খনি নিয়ে কিছু কথা
আফরোজা আলীম আশা, যুক্তরাজ্য
জিয়া হাসান নামে ইউনুসের এক বেতনভুক্ত এক দেশদ্রোহী ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন বাংলাদেশের বামপন্থীরা “বিদেশে কয়লা–গ্যাস বেচে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে জনমনে আতঙ্ক তৈরি করেছে এবং জনগনকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করেছে।”
তিনি মনে করেন, এশিয়া এনার্জি কিংবা সাগরের গ্যাস উত্তোলন কারী আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর সাথে চুক্তিতে খনিজ সম্পদ রপ্তানির যে বিধান থাকে তা মূলত দেশে ব্যবহার না হলে রপ্তানির উদ্দেশ্যে রাখা হয়, বাস্তবে এগুলো ব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য।
তিনি বলেছেন, “কয়লা আমদানি রপ্তানির বড় খরচ ট্রান্সপোর্টেশন। ফুলবাড়ির কয়লা ট্রাকে করে পোর্টে করে রপ্তানি করার ন্যুনতম কোনো অর্থনৈতিক যুক্তি নেই। ভারতেরও বাংলাদেশের কয়লা আমদানির যৌক্তিক কারন নেই… ।”
চলুন যাচাই করে দেখা যাক, ফুলবাড়ীর কয়লা ভারতে ও আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানির কোন পরিকল্পনা ছিল কি ছিল না। এই অনুসন্ধানে আমি রেফারেন্স হিসেবে কোন বামপন্থীর বক্তব্য নয়, এশিয়া এনার্জির ডকুমেন্টই ব্যবহার করব।
ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প নিয়ে এশিয়া এনার্জির পরিবেশ ও সামাজিক সমীক্ষা প্রতিবেদনের ভলিউম ১ অধ্যায় ৬ এ বলা হয়েছে:
“প্রস্তাবিত ফুলবাড়ি খনি থেকে উত্তোলিত কয়লা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করা হবে। এই কয়লার একটি অংশ (০.৫ মিলিয়ন টন প্রতি বছর) খনি-মুখে (মাইন গেট) বিক্রি করা হবে।
তবে এর বড় অংশ রেলপথে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, সরাসরি ভারতে অথবা সমুদ্র পথে আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করা হবে। যদি খনির কাছাকাছি (মাইন-সাইটে) বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হয়, তবে সেখানেও কয়লা সরবরাহ করা সম্ভব হবে, তবে তাতে অন্যান্য স্থানে কয়লা পরিবহনের পরিমাণ কমে যাবে।”
শুধু তাই না উৎপাদিত কয়লার কতটুকু দেশে ব্যবহার হতো, কতটুকু ভারতে রপ্তানি হতো আর কতটুকু আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করা হতো তার পরিমাণও স্পষ্ট উল্ল্যেখ করা ছিল:
“০.৫ মিলিয়ন টন কয়লা ট্রাকযোগে খনি-মুখ থেকে সংগ্রহ করে স্থানীয়ভাবে ব্যবহার করা হবে;
২.৫ মিলিয়ন টন কয়লা রেলপথে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় অংশে পরিবহন করা হবে;
৪.০ মিলিয়ন টন কয়লা রেলপথে ভারতের বাজারে পাঠানো হবে; এবং
৮.০ মিলিয়ন টন কয়লা রেল ও জাহাজে করে আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করা হবে।”
কাজেই এশিয়া এনার্জির নিজের ডকুমেন্ট থেকেই দেখা যাচ্ছে, বছরে উত্তোলিত ১৫ মিলিয়ন টন কয়লার ১২ মিলিয়ন টন বা ৮০ শতাংশই ভারতসহ বিদেশে রপ্তানির পরিকল্পনা ছিল এশিয়া এনার্জির। এর মধ্যে ভারতে রপ্তানি করা হতো বছরে ৪ মিলিয়ন টন আর অন্যান্য দেশে ৮ মিলিয়ন টন।
দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লার ব্যবহারের কথাটা ছিলো এভাবে: “যদি খনির কাছাকাছি (মাইন-সাইটে) বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হয়, তবে সেখানেও কয়লা সরবরাহ করা সম্ভব হবে।” অর্থাৎ দেশে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করাটা আসল উদ্দেশ্য ছিল না, এটা ছিল “যদির ব্যাপার”। বামপন্থীরা বেশিরভাগ কয়লা ভারত সহ বিদেশে রপ্তানির সমালোচনা করার কারণে, এশিয়া এনার্জি পরবর্তীতে খনি মুখে একটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কথা বলে কিন্তু কয়লা রপ্তানির পরিকল্পনাটাই মূল ছিল।
উত্তোলিত কয়লা বিদেশে রপ্তানি করাটা এশিয়া এনার্জির জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে এর জন্য আলাদা ভাবে গবেষণা করেছিলো কোম্পানিটি। এইসব গবেষণা থেকে দেখা যায়, বিদ্যমান রেল নেটওয়ার্ক এবং বন্দর অবকাঠামো রপ্তানির জন্য এই বিপুল পরিমাণ কয়লা পরিবহনের উপযুক্ত নয়, তাই এশিয়া এনার্জি এসব অবকাঠামো উন্নয়নেরও পরিকল্পনা করে। এসব পরিকল্পনার মধ্যে ছিল:
-রেল নেটওয়ার্কের বিভিন্ন অংশের পুনর্বাসন;
-খুলনায় কয়লা পরিবহন, সংরক্ষণ এবং বার্জে লোড করার জন্য একটি নতুন বন্দর স্থাপন;
– সুন্দরবনের আক্রাম পয়েন্টের কাছে একটি ভাসমান স্থানান্তর টার্মিনাল স্থাপন; এবং
– বঙ্গোপসাগর থেকে জাহাজগুলো যাতে নিরাপদে ওই ভাসমান টার্মিনালে পৌঁছাতে পারে, সেজন্য ড্রেজিং করা।
কাজেই এশিয়া এনার্জির নিজস্ব ডকুমেন্ট থেকেই দেখা যাচ্ছে, ফুলবাড়ীর কয়লা বিদেশে রপ্তানির যে সমালোচনা বামপন্থীরা করে ছিলেন, সেটা দেশের জনগণকে ভয় দেখানোর জন্য অমূলক কোন কথা ছিল না।
ফুলবাড়ীর কয়লা খনি থেকে উত্তোলিত কয়লা কিভাবে রেলপথে দর্শনা হয়ে ভারতে রপ্তানি করা হবে, কিভাবে সুন্দরবনের আক্রাম পয়েন্ট থেকে জাহাজে করে বিদেশে রপ্তানি করা হবে, তার ডিটেইল মানচিত্রও এশিয়া এনার্জি তৈরী করেছিলো। পাঠকদের অবগতির জন্য সেই মানচিত্রও এখানে যুক্ত করে দেয়া হলো।

