মুজিবঃ একটি জাতির রূপকার

আলী আমিন,যুক্তরাজ্য

মুজিব: একটি জাতির রুপকার — শেখ মুজিবর রহমানের বায়োপিক মুক্তি পেয়েছে আজ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই সিনেমাটি নিয়ে ব্যাপক ট্রোল হচ্ছে। বেশিরভাগ মানুষ বেশ তাচ্ছিল্যের সাথে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। আমি যখন লিখছি তখন আইএমডিবি’তে সিনেমাটির রেটিং ২.২/১০

ব্যক্তিগতভাবে আমি এতে বেশ কষ্ট পাচ্ছি, খারাপ লাগছে। কারণ শেখ মুজিবর রহমান তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার মত ব্যক্তিত্ব নন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টিতে তাঁর অবদান আপনাকে স্বীকার করতেই হবে। রাজনৈতিক জীবনে তিনি কতটুকু সফল বা ব্যর্থ সেটা ৭২-৭৫ পর্যালোচনা করলে সহজেই বুঝতে পারা যায়। কিন্তু ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ তিনি ও তাঁর সম্পূর্ণ পরিবার যে পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের শিকার হোন, তার পর সেসব নিয়ে আলোচনা করা নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। তিনি সফল ছিলেন না ব্যর্থ, সে প্রশ্ন করে জঘণ্য হত্যাকান্ডের শিকার মুজিব ও তাঁর পরিবারকে অপমান না করাই সভ্য সমাজে কাম্য।

পররর্তীতে শেখ মুজিবর রহমান ও তাঁর পরিবার হত্যার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের যথাযথ বিচারের মুখোমুখি না করে, বরং তাদের এক প্রকারের ক্লিন চিট দিয়ে এবং ইনডেমনিটি ঘোষণা করে — বৈদেশিক মিশনে পাঠিয়ে তৎকালীন শাসক গোষ্ঠি এই মর্মান্তিক হত্যাকান্ড’কে এক প্রকারের লেজিটিমাইজ করে দেয়। যা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং অগ্রহণযোগ্য।

শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করা পর্যন্ত এই বিচারের অপেক্ষা করতে হয়। যে কোন মানুষের জন্যেই তার পরিবারের সদস্যদের এভাবে হত্যার ঘটনা মেনে নেয়া অসম্ভব। শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানাও আমার আপনার মতোই মানুষ, স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পেয়ে তারা তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিচারের পথ মুক্ত করে এবং হত্যাকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়।পোস্ট সংক্ষিপ্ত করার জন্যেই লিখছি যে, সরকার হিসেবে পারফরমেন্সে ১৯৯৬-২০০১ সময়কার আওয়ামী লীগ আর বর্তমান আওয়ামী লীগের পার্থক্য এক রকমের আকাশ-পাতাল।

আওয়ামী লীগের পর, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০১ এ বিএনপি ক্ষমতায় আসে এবং যথেচ্ছভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র শাসন করে। ১৯৯১-১৯৯৬ সালে যে দলটি অত্যন্ত সফলতার সাথে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিস্থাপনে অগ্রগামী ভূমিকা রাখে, তারা যেন পুনরায় ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে একরকমের বেয়াড়া হয়ে যায়। যার ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচাইতে দূর্নীতিগ্রস্থ রাষ্ট্রে পরিনত হয় তাদের ওই শাসনামলে। শেখ মুজিবর রহমান হত্যার সাথে জড়িতদের বিচারও অনেকটা স্থবির হয়ে যায়। সাথে যুক্ত হয় শেখ হাসিনার উপর গ্রেনেড হামলার ঘটনা আর জেএমবির তান্ডব। আওয়ামী লীগের লাগাতার ধ্বংসাত্বক আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয় বিএনপি।

১/১১ পরবর্তী ঘটনার দিকে আলোকপাত তেমন করার প্রয়োজন নেই। ২০০৯ এ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ, এবং শুরুতেই পিলখানায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অত্যন্ত চৌকস কিছু কর্মকর্তার গণহত্যা সংঘটিত হয়। বিডিআর বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ শেখ হাসিনার নতুন সরকার ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে হার্ড লাইন অবলম্বন করে এবং বিরোধী দল এবং সরকার সমালোচকদের দমনে পদ্ধতিগতভাবে নানা পদক্ষেপ নেয়। দেশের নিরাপত্তা বাহিনী ব্যবহার করে গুম-বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের এক প্রকারের উৎসব শুরু হয় দেশে।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় আরোহণের পর শেখ হাসিনা বাংলাদেশে মুজিবীয় কাল্ট সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেন বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান যার একটি সিআরআই। পুরো দেশে মুজিববাদ এবং আওয়ামী কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠার গোড়াপত্তন হয় ২০১০ থেকেই। জনসাধারণের নাগরিক অধিকার ও বাক স্বাধীনতা হরণ করে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে একটা নজরদারীর রাষ্ট্রে পরিণত করে। দেশের সকল সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের শিকার হয়। গণমাধ্যমকে কুক্ষিগত করে সরকার সমর্থক ব্যবসায়ী গোষ্ঠি। বিতর্কিত যুদ্ধাপরাধী বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় বিএনপি-জামাত নেতাদের। ২০১৪’র একপাক্ষিক নির্বাচনে জিতে দ্বিগুণ শক্তিতে নিপীড়ন শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকার।

আমাদের এই উপমহাদেশে শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বদের হত্যার দুঃখজনক অনেক উদাহরণ বিদ্যমান। ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, তার ছেলে রাজীব গান্ধী, বিতর্কিত বিচারে ফাঁসির শিকার জুলফিকার আলী ভুট্টো, আততায়ীর হাতে নিহত তার কন্যা বেনজীর ভুট্টো, নেপালের পুরো রাজপরিবারের গণহত্যা, শ্রীলংকার প্রেমাদাসা। সবাই নিজ দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন।

মর্মান্তিক এসব হত্যার ঘটনার পর তাঁদের পরিবারের সদস্যরা সরকার গঠণ করেছেন এমন নজিরও রয়েছে। কিন্তু কেউই নিজ রাষ্ট্রকে নিজ সম্পদ এবং জনগণকে একপ্রকারের দাস বলে মনে করেননি, যেমনটি করেছেন শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ। পুরো দেশে প্রচ্ছন্নভাবে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আওয়ামী কাল্ট প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বারবার শেখ মুজিবর রহমান’কে সামনে আনা হয়েছে এবং জনগনের উপর মুজিব ও তাঁর নিহত পরিবারের সদস্যদের অযাচিতভাবে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।

২০১৮’র প্রহসনের নির্বাচন, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় দূ্র্নীতি, রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতী-পদায়ন এবং মুজিব পরিবারের নিহত বিভিন্ন ব্যক্তিদের জাতীয় বীর হিসেবে প্রতিষ্ঠার এহেন কোন চেষ্টা নেই যা গত প্রায় ১৫ বছরে করা হয়নি। একটা পুরো প্রজন্মই এই নিপীড়ন, অন্যায় ও কর্তৃত্ববাদ দেখে বেড়ে উঠেছে।

কালা কানুন জারির মাধ্যমে জনসাধারন এবং গণমাধ্যমের কন্ঠ রোধ করা হয়েছে, সাংবাদিক ও অধিকার কর্মীদের জেলে ঢুকিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। এবং ব্যালট চুরি করে নাগরিকদের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। এবং এসবের ফলে রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি অবজ্ঞা এবং অসম্মান তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। যার প্রতিফলন শেখ মুজিবর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রতি অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যতায় ফুটে উঠেছে।

শেখ হাসিনা অবশ্যই এসব বিষয়ে অবগত, তিনি আরো অবগত যে দেশের রিজার্ভের কি অবস্থা এবং ব্যাংকিং সেক্টরের শোচনীয় অবস্থার বিষয়ে। টাকা ছাপিয়ে মূদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি করে জনজীবন আরো অনিশ্চিয়তার দিকে ধাবমান। অর্থনীতির ইতিহাসে কখনোই কোন পঞ্জি স্কিম সফলতার মুখ দেখেনি। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে যে বিশাল পঞ্জি স্কিম গড়ে উঠেছে সেটাও একসময় মুখ থুবড়ে পড়বে। আর তখন?

প্রধান বিরোধীদল হিসেবে মামলা-গ্রেফতারে জর্জরিত বিএনপি — দেশে গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠায় তাঁদের সর্বোচ্চ চেষ্টাই করে যাচ্ছে। কিন্তু ২০০১-২০০৬ সংঘটিত বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যর্থতা ও দূর্নীতির বিষয়ে দলটির সর্বোচ্চ নেতৃত্বের কোন রকমের অনুশোচনা বোধই এখনো পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়নি। পরিতাপের বিষয় হলো, এই দলটির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচাইতে স্বচ্ছ ইমেজের নেতা হিসেবে সুপরিচিত — সম্মানীত।

আওয়ামী লীগ সরকার দেশকে হয়তো দিয়েছে অনেক, কিন্তু কেঁড়ে নিয়েছে বহুগুণে অনেক। প্রতিটি প্রকল্প কেন্দ্র করে দূর্নীতির যে মহোৎসব হয়েছে, সেসবের আদৌ কোন বিচার সম্ভব কিনা, সে বিষয়ে আমি সন্দিহান।

আর এসব কারণে পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন বন্ধু প্রতীম রাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নানা বিরুপ পদক্ষেপ আর নাই বা উল্লেখ করলাম।

শেষ করছি একটি প্রশ্ন রেখে, বাংলাদেশের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে শেখ মুজিবর রহমান ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ’কে, যথাক্রমে আদর্শ নেতা ও জনবান্ধব রাজনৈতিকদল হিসেবে প্রতিষ্ঠার এই ব্যর্থতা আসলে কার উপর বর্তাবে?

প্রকাশক, দৈনিক নবযুগ