Uncategorized

কোকা কোলা বয়কটের আদ্যোপান্ত

এম ডি কামরুল হাসান, যুক্তরাজ্য

কোকা-কোলা প্রথম বয়কট করে ইহুদিরা:

বেশ কিছুদিন আগে কোকা-কোলার সিক্রেট নিয়ে একটি প্রচারণা দেখেছিলাম। এতে বলা হয়েছিল – ইংরেজি কোকা-কোলা লেখাটিকে উল্টো করলে হয় ‘লা আল্লাহ লা মুহাম্মদ’। অর্থাৎ ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে কোকা-কোলার নামকরণ করা হয়েছে।

কোকা জাতীয় পানিয়ের মূল হচ্ছে কোলা যা আবিষ্কার করেন মার্কিন রসায়নবিদ জন পেম্বার্টন। দুটি প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

১. প্যালেস্টাইন কোলা, পামির কোলা এবং সর্বশেষ সংযোজন কাসেমী কোলা’ গং কেন এত নাম থাকতে কোলা অর্থাৎ ‘লা আল্লাহ’ শব্দটি বেছে নিল?

২. এত ধরণের পানীয় থাকতে ইসলামবিরোধী কোলা কেন উৎপাদন করতে হবে? শরবতে পামির বা কাসেমী আফজা টাইপের নাম কেন রাখা হল না?

এটা মুসলমানের ছদ্মবেশে থাকা ইহুদিদের চক্রান্ত নয় তো?

মূল প্রসঙ্গে আসি। কোকা-কোলা নিয়ে শুধুমাত্র বাংলাদেশ ও পাকিস্তানেই আজব, অদ্ভুত ও উদ্ভট চেতনা দেখা যাচ্ছে। পাকিস্তানের আমজনতার মধ্যে উম্মাদনা থাকলেও তাদের অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে একটু ভালো। এ প্রসঙ্গে তাদের আলেমরা অর্ধশিক্ষিত আজহারীদের মত অজ্ঞতার পরিচয় না দিয়ে রাসুলুল্লাহ (স.) ইহুদিদের সঙ্গেও ব্যবসা করেছেন বলে উল্লেখ করেছে।

কোনো বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি বা আন্দোলন পরিচালনার মিনিমাম ভিত্তি থাকতে হয়। কোকা-কোলা ইসরাইলের কোম্পানি – এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ কখনো, কোথাও পাওয়া যায় নি; অথচ ইসরাইল ট্যাগ দিয়ে বয়কটের ডাক দেওয়া হচ্ছে! উদ্ভট উটের পিঠে চলছে সোশ্যাল মিডিয়া!

কোকা-কোলা ও ধর্ম:

কোকা-কোলা আবিষ্কার হয় ১৮৮৬ সালে যখন ইসরাইলের অস্তিত্ব ছিল না। এর আবিষ্কারক জন পেম্বার্টন ছিলেন ফ্রিম্যাসন। এটাকেই অনেকে ইসরাইলি লিংক হিসেবে উল্লেখ করে। কিন্তু ফ্রিম্যাসনের সঙ্গে ইহুদি ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। অনেক দেশে ফ্রিম্যাসনে ইহুদিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। গোয়েবলসের পরামর্শে হিটলার প্রথম প্রচারণা চালায় যে, ইহুদিরা ফ্রিম্যাসনের নামে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে। এর রেশ ধরে অনেক দেশে ফ্রিম্যাসন সদস্যদের হত্যা ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কোকা-কোলার সঙ্গে এর যোগসূত্র টানা যাবে না কারণ

পেম্বার্টনের জীবদ্দশায় কোক সাফল্য পায়নি এবং পেম্বার্টনের ছেলের সঙ্গে কোকো-কোলার অংশীদার ও সফল বিপণনকারী আসা ক্যান্ডেলারের বিরোধ ছিল। এছাড়া কোকা-কোলার মালিকানা অনেকবার পরিবর্তন হয়েছে।

প্রথম কোকা-কোলা বয়কট:

বিতর্ক কখনোই কোকা-কোলার পিছু ছাড়েনি। আবিষ্কারের শুরুতে এলকোহল ও কোকেন থাকা নিয়ে আপত্তি উঠেছিল এবং পরবর্তীতে তা বাদ দেওয়া হয়। তবে ধর্মীয়ভাবে প্রথম আপত্তি তোলেন ইহুদি রাব্বি টবিয়াস গিফেন, যাকে কোকের ‘হালাচিক্যাল’ বা ‘কোশের’ তথা ইহুদি ধর্ম মোতাবেক হালালকরণের কৃতিত্ব দেওয়া হয়। লিথুনিয়ায় জন্মগ্রহণকারী গিফেন ১৯০৩ সালে আমেরিকার ওহিও রাজ্যের অভিবাসী হন। ইহুদিদের কাছে ধর্মীয় নির্দেশনার জন্য তাঁর বিশেষ গুরুত্ব ছিল। কোকা-কোলা জনপ্রিয় হওয়ার পর গিফেনের কাছে প্রায় নিয়মিতভাবে প্রশ্ন করা হতো – কোক ‘কোশের’ কিনা। তাই তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে কোক তৈরির উপাদানগুলোর নাম জানতে চান। কিন্তু কোক তার সিক্রেট প্রকাশ করতে অপারগতা জানায়। এ নিয়ে আলোচনা সমালোচনার এক পর্যায়ে রেসিপি গোপন রাখার শর্তে তাকে কোক তৈরির উপাদানগুলোর নাম জানানো হয়। তখন তিনি পান যে, কোক তৈরিতৈ গ্লিসারিন ব্যবহার করা হয় যা গরুর চর্বি ও এলকোহলের মাধ্যমে প্রস্তুত হয় এবং ইহুদি ধর্ম অনুযায়ী তা নন-কোশের। তিনি ঘোষণা করেন ইহুদিদের জন্য কোক হারাম/নন-কোশের। বয়কটের ফলশ্রুতিতে ১৯৩৫ সালে গ্লিসারিন ব্যবহার বন্ধ করে কোক কর্তৃপক্ষ এবং ইহুদিদের জন্য হালাল পানীয় হিসেবে গণ্য হয় কোক।

কোকা-কোলার বিরুদ্ধে মিশরে ইহুদিদের সম্পত্তি দখল করে (১৯৬৫ সালে) কারখানা স্থাপনের অভিযোগ রয়েছে। গত ১৫ বছর ধরে এর মামলা চলছে। অথচ এই কোককে বলা হচ্ছে ইহুদিবাদী! ইহুদি কানেকশন থাকলে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ইসরাইলের চরম বৈরি সম্পর্ক চলাকালে সেসব দেশে কোক বিক্রি শুরু হয় কিভাবে!

ইসলাম অনুসারে কোক বয়কট:

বিশ্বের নামকরা আলেমরা পণ্য বয়কটকে শরীয়ার ফ্রেমওয়ার্কে আনেন না। তাদের মতে, রাসুল (স.) ইহুদিদের সঙ্গেও ব্যবসা করেছেন এবং সাহাবীরা মক্কার ‘মুশরিকদের’ জন্য গম, যব পাঠানো বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলে তিনি তা রদ করেন। এছাড়া ইসলামের ইতিহাস থেকেই জানা যায়, বয়কটের নীতি প্রয়োগ করেছে ইসলামের শত্রু খ্যাত আবু জেহেল, আবু লাহাবরা। কিন্তু শত্রুতা সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে সাহাবাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। মানবিক কারণে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন ও সহানুভূতি প্রকাশে পণ্য বয়কটকে অবশ্যই শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে। কিন্তু তাই বলে প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিগুলোর ঘৃণ্য প্ররোচনায় মিসইনফরমেশনের মাধ্যমে কোনো কোম্পানিকে বলির পাঁঠা বানিয়ে নয়। এজন্য সঠিক তথ্য জানার পাশাপাশি সকল মুসলিম দেশের ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।

তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই – কোকা-কোলা ইহুদি পণ্য, তাহলে বয়কট কি সমাধান? এই নীতির মাপকাঠি কি – ইহুদি মানেই খারাপ এবং বয়কট করতে হবে? এমন নীতি কি ইসলামসম্মত? ইসরাইলের ২০% মুসলমান কি উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত নয়? বঙ্গীয় উম্মতের ইজমা ধরলেও দ্বৈতনীতির প্রশ্ন উঠবে। ফেসবুক, গুগল সহ আধুনিককালের অনেক প্রযুক্তি ও প্রকৌশল ইহুদিদের অবদান যা অস্বীকার করতে হবে। অনেক চিকিৎসা পদ্ধতি বাদ দিয়ে হেকিম-কবিরাজের দ্বারস্থ হতে হবে। ঈমানী শক্তি দেখাতে কেউ তা করে দেখান। নিজের সুবিধামত নীতি নির্ধারণ করা কি মুমিনের কাজ?

কোক বিরোধী প্রচারণার কন্টেন্টগুলো এমন সময় তৈরি করা হয়েছিল যখন কোনো বিষয় যাচাই করার সুযোগ ছিল সীমিত। এখন যে কেউ চাইলেই সহজে তথ্য যাচাই করতে পারে। অথচ সবাই চিলের পেছনে কানের জন্য ঘুরছে! বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়েছে তাই তাদেরকেও বয়কট! কী অরাজক অবস্থা! কোকে ইসরাইলের লেঞ্জা খোঁজা আর নিজেকে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হিসেবে উপস্থাপন করার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।