সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ও মার্কিন ষড়যন্ত্রে শেখ হাসিনা

এম ডি কামরুল হাসান, যুক্তরাজ্য

“এখনো যদি বলি, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বা আমাদের দেশ কাউকে লিজ দেবো, তাহলে আমার ক্ষমতায় থাকার কোন অসুবিধা নেই, আমি জানি সেটা। কিন্তু আমার দ্বারা সেটা হবে না”। ক্ষমতাচ্যুত হবার মাত্র এক বছর আগে, ২১ জুন ২০২৩ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা বলেন।

কথাটা সবাই উড়িয়ে দেয়, হাসি ঠাট্টা করে অথচ আমেরিকার প্ররোচনায়, অর্থে এবং সহযোগীতাতেই এই কথা বলার মাত্র এক বছরে পরই ছাত্র আন্দোলনের ছদ্দবেশে এক নীরব ক্যু এর মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। উনার কথা আমরাও বাদ দেই। আমরা একটু পরাশক্তিগুলোর বিশ্বযুদ্ধ প্রস্তুতি ও কৌশলগত নিরাপত্তা প্রস্তুতির দিকে নজর দেই। আমাদের রোহিঙ্গা সমস্যা, ড: ইউনুসের পদ্মা সেতুর বিপক্ষে থাকা এবং দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্ব ব্যাংকের পদ্মা সেতু তৈরি থেকে বের হয়ে আসাও চীন সংক্রান্ত মার্কিন কৌশলগত নিরাপত্তার অংশ।

চীনের উত্থান পুরো পশ্চিমা বিশ্ব জুড়ে একটা বড় ভীতি তৈরি করেছে। কোনো জাতির এত আকস্মিক ও নাটকীয়ভাবে ক্ষমতা অর্জন বিশ্ব কখনো দেখেনি। মাত্র ৩ দশকের কিছু বেশি সময়ে চীন ৮০০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছে, যার ফলে এটি মহাশক্তির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমান্তরালে অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। চীনের সাথে নতুন নতুন জোট তৈরি হচ্ছে এবং ক্ষমতার খেলা জমে উঠেছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জাপানও এমন ভাবেই দ্রুত ক্ষমতার শিখরে উঠে এসেছিল। জিতে গেলেও তার সাথে বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা আমেরিকা ভোলেনি।

সামনে একটা বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা সবাই দেখছে। সেই যুদ্ধে চীনকে সবচেয়ে বড় হুমকি মনে করছে আমেরিকা। আমেরিকা জানে যুদ্ধ মানেই জ্বালানি তেল। যত সৈন্যই থাক আর যত যুদ্ধাস্ত্রই থাক, জ্বালানি তেল না থাকলে জাহাজ চলবে না, বিমান উড়বে না, ট্যাংকগুলোর চাকা ঘুরবে চলবে না, সৈন্য পরিবহন করা এপিসিগুলো চলবে না। তাই একদিকে নিজেদের জন্য জ্বালানি তেল যেমন নিশ্চিত করতে হবে, ঠিক একই কারণে শত্রুর জ্বালানি তেল পরিবহনে বাধা দিতে হবে। আমেরিকার সেই নিরাপত্তার চিন্তার ফাঁদেই পড়ে গেছে আমাদের সেন্ট মার্টিন দ্বীপটা। কিন্তু এই জটিল প্রেক্ষাপটটা বুঝতে হলে আমদের বিশ্বযুদ্ধ কি সেটা বুঝতে হবে। আসুন আমরা দেখি কিভাবে শুধুই জ্বালানি তেলের জন্যই আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়েছিল।

যুদ্ধ মানেই বিভীষিকা, এমনকি যে জিতে তার জন্যও। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার পর আমেরিকা আন্তর্জাতিক সংঘাত থেকে নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নেয়। যেহেতু আমেরিকা বাকি দুনিয়া থেকে বিশাল দুটো মহাসাগর দিয়ে বিচ্ছিন্ন, ভূপ্রকৃতিগত কারণেই আমেরিকা একটি নিরাপদ এলাকা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা একটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হয়ে যায়। তারা অন্য দেশের জন্য যুদ্ধে যাবে না এমন সিদ্ধান্ত নেয় এমনকি তারা যুদ্ধরত দেশে অস্ত্র সরবরাহও করবে না এমন আইনও পাশ করে। মার্কিন কংগ্রেস এই সময় বেশ কিছু অপক্ষপাত (নিউট্রালিটি) বিল পাশ করে। আমেরিকার এই শান্তিপ্রিয় নিরপেক্ষ অবস্থানের সুযোগে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ক্ষুদ্রতর উন্নাসিক একনায়কতন্ত্রগুলো। যার মধ্যে নেতৃত্বে পশ্চিমে জার্মানী ও ইতালি এবং পূর্বে জাপান।

প্রযুক্তি ও নৌ শক্তিতে জাপান সেরা হলেও ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্র জাপানের প্রাকৃতিক সম্পদ নেই বললেই চলে। তাদের প্রায় ৯৫ শতাংশ জ্বালানি আমদানী করতে হয়। কল কারখানার জন্য কয়লা, ইস্পাত ও অন্যান্য ধাতব ও রাসায়নিক প্রায় সবই আমদানি করতে হয়। গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আত্মনিরাপদ অবস্থানের কারণে জাপান অন্য দেশের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ লুঠপাট করার জন্য দুটো নতুন কৌশল হাতে নেয়। এই কৌশলগুলো বাস্তবায়নের জন্য তারা একটি অভ্যন্তরীণ নীল নকশাও প্রণয়ন করে। প্রথমে তাদের প্রথা অনুযায়ী বিভিন্ন শিল্প অলিগার্ক তৈরি করে ও সরকারী অর্থ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার ঐ সব অলিগার্কদের বিপুল অর্থ প্রদান করা হয়। ঐ সব অলিগার্কেরা সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগীতায় সংবাদ ও বিনোদন মাধ্যম ব্যবহার করে, প্রোপাগান্ডা চালিয়ে ও গোপন পুলিশ দ্বারা বিরুদ্ধমত দমন করে ক্রমেই সম্রাটকে মহামানবে পরিণত করে। এর পর সেই ‘মহামানব’ সম্রাটের সেবা করার জন্য বিশাল সংখ্যায় অন্ধ জাতীয়তাবাদী তরুণসমাজ তৈরীর দিকে মনোযোগ দেয়। এর সাথে তারা শক্তিশালী করতে থাকে জাপানের সেনা ও নৌ শক্তি। এরপর সেই অন্ধ জাতীয়তাবাদী তরুণসমাজ ও সামরিক শক্তি একত্র করে তৈরী হয় জাপানের সম্রাটের নৃশংস সেনা ও নৌ বাহিনী।

সম্রাটের নৃশংস সেনা ও নৌ বাহিনী তারপর সেই দুটো কৌশলের বাস্তবায়ন শুরু করে। সেগুলোকে বলা হয় জাপানের উত্তর ও দক্ষিন কৌশল। উত্তর কৌশলটি হল রাজকীয় সেনাবাহিনী ব্যবহার করে পূর্ব চীন, মঙ্গোলিয়া এবং সাইবেরিয়া দখল করে সেখানকার জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ হস্তগত করা। দক্ষিন কৌশলটি হল রাজকীয় নৌ বাহিনী পাঠিয়ে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর খনিজ এলাকা দখল করা যার অনেকগুলোই ডাচ, ইংল্যান্ড বা ফরাসীদের উপনিবেশ। প্রথম কৌশলে শুরুতে তারা অনেকটাই সফল হয় যার ফলে চীন-মঙ্গোলিয়ার মাঞ্চুরিয়া এলাকা তারা দখল করে নেয় এবং জাপানি রাজকীয় সেনাবাহিনী দ্বারা যেখানে ন্যানঝিং গণহত্যা ও গণধর্ষণ সংঘটিত হয়।

তখনকার সময়ের দরিদ্র ও কিছুটা অলস চীন প্রাথমিকভাবে জাপানের আক্রমণের কোন প্রতিরোধই তৈরী করতে পারে না। মাঞ্চুরিয়া অঞ্চলের চীনের অংশ সহজেই দখল করে চীনের সীমানা অতিক্রম করে জাপানী বাহিনী মঙ্গোলিয়ার মাঞ্চুরিয়া অঞ্চলে পৌছে যায়। ক্রমে চীন শক্তি সঞ্চয় করে সোভিয়েত-মঙ্গোলিয় বাহিনীর সাথে একত্র হয়ে জাপানকে মোকাবিলা করতে শুরু করে। ওই সময় জাপানের প্রায় আশি ভাগ জ্বালানি সরবরাহ হত আমেরিকা থেকে। জাপানি রাজকীয় সেনাবাহিনী দ্বারা চীনে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনে আমেরিকার জনগণ জাপানের প্রতি অবরোধ আরোপের ব্যাপক দাবী তোলে। এর ফলে আমেরিকা জাপানের উপর জ্বালানি অবরোধ আরোপ করে এবং জাপানের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ফলত জাপানের উত্তর কৌশল স্থগিত হয়ে যায়।

এর পর জাপান আমেরিকার বন্ধ করা ফলে উদ্ভূত জ্বালানি সঙ্কট কাটাবার জন্য দক্ষিন কৌশল বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। তারা রাজকীয় নৌ বাহিনীকে জ্বালানি সমৃদ্ধ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর দিকে পাঠাবার পরিকল্পনা করে। ঐ দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো অনেকগুলোই ডাচ, ইংল্যান্ড বা ফরাসীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এই পরিস্থিতিতে আমেরিকা তার অপক্ষপাত অবস্থান থেকে বের হয়ে এসে ব্রিটেন ও ফ্রান্সে অস্ত্র বিক্রয় মুক্ত করে। এর সাথে সাথে আমেরিকা ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও কিছু গণতান্ত্রিক দেশে ‘ল্যান্ড এইড’ সহযোগীতা বিল পাশ করে। যেটা ছিল আমেরিকার নিজের নিরাপত্তার জন্য ঐ সকল গণতান্ত্রিক মিত্র দেশগুলোকে বিনামূল্য খাদ্য, জ্বালানি ও অস্ত্র সহযোগীতা করতে পারবে এমন আইন।

উত্তর কৌশলে ব্যর্থ জাপান যখন দক্ষিণ দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো থেকে সম্পদ আহরণে রত, তখন তারা ইউরোপের আরো দুই এক নায়ক রেজিম, জার্মানী ও ইতালীর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। ফলে আমেরিকা জাপানে যুদ্ধ শিল্পে ব্যবহার্য সকল কিছুতে রপ্তানি অবরোধ আরোপ করে। আমেরিকার অবরোধে উত্তর কৌশলে ব্যর্থ জাপান এখন দক্ষিণ কৌশলেও বিপদ দেখতে পায়। কিন্তু এত অবরোধেও তাদের শিক্ষা হয় না। তারা ফরাসী-ইন্দোচীনের আরো বৃহৎ অংশ দখল করা চালিয়ে যেতে থাকে। এর প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকা আমেরিকায় থাকা জাপানের সকল সম্পদ বাজেয়াপ্তির ঘোষণা দেয়। আমেরিকার এই সিদ্ধান্ত ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস উভয়ই অনুসরণ করে এবং তারাও জাপানের উপর অবরোধ আরোপ করে। এর ফলে জাপানে ৯৪ শতাংশ জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।

জাপান তখন চরম সমস্যায় পড়ে। আমেরিকার প্রতি তারা অবরোধ তুলে দেবার আহ্বান জানায়। আমেরিকা বলে বিনিময়ে চীন থেকে সম্পূর্ণ নিজেদের সরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু এতে সম্রাটের সম্মান হানি হবে তাই জাপান সেটা মানতে নারাজ। এই অবস্থায় তারা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ইন্দো-মালয় এলাকায় ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে ও সেগুলো দখল করতে থাকে। নিজের ক্ষমতায় মাতাল এবং অলিগার্ক ও তোয়াজকারী পরিবেষ্টিত সম্রাট তখন একটি মারাত্মক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয়। সেটি হল হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্ল হারবারে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ও নৌ-ঘাঁটিতে অকস্মাৎ আক্রমণ করে বসা। তাদের ধারণা ছিল আমেরিকা কখনই বিশাল সমুদ্র পেরিয়ে তাদের মত এক শক্তিধর দেশের সাথে যুদ্ধ করার ঝুঁকি নেবে না। তাদের ধারণা ছিল পার্ল হারবারে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে যদি আমেরিকার প্যাসিফিক ফ্লিটকে ধ্বংস করে ফেলা হয় তাহলে আমেরিকা তাদের মিত্র ইংল্যান্ড, ডাচ বা ফরাসীদের ইন্দো-মালয় এলাকায় সহযোগীতা করতে পারবে না এবং সকলের চাপে আমেরিকা একটি সম্মানজনক শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হবে।

ক্ষুদ্র প্রাসাদ নিয়ন্ত্রিত একনায়ক জাপান রেজিম একটি বৃহৎ পরাশক্তির মানসিকতা পড়তে ভুল করেছিল। কয়েক বছর থেকে নিষেধাজ্ঞা দিতে থাকা আমেরিকা নিশ্চই মিত্রদের সহযোগীতার কথাই শুধু চিন্তা করে নাই। একটি পরাশক্তি তার নিজের নিরাপত্তার জন্য তার যা যা করা দরকার সেটা করবে। পার্ল হারবারে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে জাপান আমেরিকার প্যাসিফিক ফ্লিট ধ্বংস করেছে ঠিকই কিন্তু জাপানীজের মগজে যে শান্তি চুক্তির ধারণা ছিল আমেরিকার তার ধারে কাছেও যায়নি। পর দিনই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট মার্কিন কংগ্রেসে তার ‘কুখ্যাত দিন’ (ডে অব ইনফেমি) ভাষণটি দেন এবং কংগ্রেসের কাছে জাপানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণার অনুমতি চান। কংগ্রেস অনুমতি দিলে আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে লিপ্ত হয় এবং সম্রাটের ইগো দমন করতে দুটি পারমাণবিক বোমার আঘাতের প্রয়োজন হয়।