পুলিশের ইউনিফর্মে মব সন্ত্রাস
এম ডি মারজানুল ইস্ললাম, যুক্তরাজ্য
উত্তরা পশ্চিম থানার পাঁচ নম্বর সেক্টরের বাসা থেকে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে তুলে নেয় ‘মব’ সন্ত্রাসীরা। গলায় জুতার মালা পরানো হলো, আর সেই দৃশ্য ভিডিও করলো ইউনিফর্মধারী পুলিশদের সামনে। একজন জুতা দিয়ে তার গালে সজোরে দুইবার আঘাত করলো।
ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যায়- সেখানে উপস্থিত ছিল ৮-৯ জন ইউনিফর্ম পরা পুলিশ, আর মাত্র ১০-১৫ জন মব সন্ত্রাসী। পুলিশ দাঁড়িয়ে দেখলো। কিছুই বললো না। কিছুই করলো না।
ইউনিফর্ম পরা পুলিশের সামনেই সত্তরোর্ধ্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা কে এম নুরুল হুদাকে প্রকাশ্যে অপদস্থ করলো মব সন্ত্রাসীরা।
কে এম নুরুল হুদা সেক্টর ৮-এর অধীন মেজর জলিলের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা, যাঁর নাম ছিল ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা। তিনি পরবর্তীতে ফেব্রুয়ারি ২০১৭ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে- ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই যেখানে মব সন্ত্রাসের মূল পৃষ্ঠপোষক, সেখানে মেরুদন্ডহীন পুলিশের কী বা করার আছে! হ্যাঁ, পুলিশের অনেক কিছুই করার আছে। দেশে যদি প্রচলিত আইন থাকে, সত্তরোর্ধ্ব একজন সাবেক সাংবিধানিক পদধারী অসুস্থ ব্যক্তিকে কেন মব সন্ত্রাসীদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে? দেশে তো আইনের শাসন নেই। পুলিশও কী তাই মনে করে? পুলিশের নির্লজ্জ নীরবতাই তো সবচেয়ে বড় অপরাধ।
উত্তরা বিভাগের ডিসি মোঃ মহিদুল ইসলাম- আপনার চেনা মুখ এই দৃশ্যের আড়ালে। আপনি সবকিছু জানতেন। আপনি থামাতে পারতেন এই মব সন্ত্রাস। কিন্তু আপনি নীরব থেকে সহমত দিয়েছেন। ২০২৫ সালের ১০ মার্চ আপনার পোস্টিং হয় উত্তরা বিভাগে। তার আগে আপনি ছিলেন ডিএমপির অর্থ বিভাগের ডিসি, তারও আগে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশে ডিসি হেডকোয়ার্টার।
প্রশ্ন হচ্ছে- কে এম নুরুল হুদা যখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন, তখন আপনি কি পুলিশের চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়েছিলেন? নিশ্চয়ই- না। অথচ আজ সেই মানুষটিকে জুতার মালা পরানোর ভিডিওর পৃষ্ঠপোষকতায় আপনি নিজেই জড়িত!
আপনি কি জানতেন না কে এম নুরুল হুদাকে তুলে আনার পরিকল্পনার কথা? আপনি কি জানতেন না তাকে কিভাবে গণপিটুনি দেওয়া হবে? পুলিশ সদস্যরা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে, মব সন্ত্রাসীরা তাকে অপদস্থ করবে- আপনি জানতেন না? সাদা পোশাকে আপনার পুলিশ আপনার নির্দেশে সেই দৃশ্য ভিডিও করে আপনাকে হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়েছে। সেই ভিডিও আপনি পাঠিয়েছেন মিডিয়া হাউসগুলোতে। ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে।
আর এই গোটা নির্মম অপমানযজ্ঞের নাটের গুরু কে? ডিবির যুগ্ম কমিশনার নাসিরুল ইসলাম। আপনারা কি নাসিরুল ইসলামের কথা ভূলে গেছেন? যার বুয়েট পড়ুয়া মেয়ে লামিসা ইসলাম গত বছর বেইলি রোডের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছিল। সেদিন গোটা বাংলাদেশ কেঁদেছিল লামিসার জন্য। কেঁদেছিল মেয়েহারা সেই সেই নাসিরুলের জন্য, তার অপূরণীয় শূন্যতার জন্য। আজ সেই লামিসার বাবাই যেন হয়ে উঠেছেন এক রাষ্ট্রীয় বর্বরতার নির্লজ্জ কুশীলব। দমন-পীড়নের মেশিন চালাচ্ছেন তিনি। মেয়ের অকাল প্রয়ানের পর ধর্মকর্মে মনোযোগী হওয়ার কথা ছিল তার, অথচ তার হাতেই রচিত হচ্ছে অসভ্যতার গীতিকা।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও কিন্তু দুহাত ভরে কামিয়েছেন ফরিদপুরে জন্মগ্রহণকারী এই নাসিরুল। পুলিশ হেডকোয়ার্টারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন পুরো সময়।
এখন তিনি আইজিপি বাহারুল আলম ও ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলীর মূল ক্যাশিয়ার। নাসিরুলও কিন্তু সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদার আমলে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন নি। এখন সাধু সেজেছেন।
নাসিরুল নিশ্চয়ই মব সন্ত্রাস চিত্রায়নের বিষয়টি কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলীকেও জানিয়েছেন। কমিশনার আইজিপি, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ আরো অনেককেই।
কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী, আইজিপি বাহারুল আলম- সবাই জানেন। সবাই দেখেছেন। কেউ কিছু বলেন নি। কারণ এটাই আজকের বাংলাদেশ। যেখানে রাষ্ট্র নামের শব্দটা আছে, কিন্তু আইন- বিচার বলতে কিছু নেই।
কিন্তু সময় থেমে থাকে না। ইতিহাস ভুলে না। আজ যিনি অপমান করছেন, কাল তিনি নিজেই হবেন অপমানের শিকার। আজ যিনি চুপ আছেন, কাল তিনিই গলা উঁচিয়ে বিচার চাইবেন।
গাইবান্ধার মহিদুল, ফরিদপুরের নাসিরুল, ঝিনাইদহের সাজ্জাত, কিশোরগঞ্জের বাহারুল- আপনারা এই যে রাস্তা তৈরি করছেন, মনে রাখবেন- এই রাস্তায় কাল হেঁটে যাবে আপনাদের পরিবার, আপনাদের সন্তান। আপনি বা আপনার পরিবারের কেউ কাল শিকার হবে মব সন্ত্রাসের।
আর প্রকৃতি? সে তো ফেরত দিতে জানে। লামিসার অকাল মৃত্যু ছিল একবার। সামনেও হয়তো অপেক্ষা করছে এমন কিছু যা মহিদুল- নাসিরুল-সাজ্জাত-বাহারুলদের মতো পিশাচদের থামিয়ে দেবে একদিন।
বিনাশ হোক মব সন্ত্রাসের, মব সন্ত্রাসীদের, পৃষ্ঠপোষকদের আর সেই হিংস্র সিস্টেমের- যা রাষ্ট্রের গলায় জুতার মালা পরায়।
এই জুলুম একদিন থামবেই। এই অপমানের বদলা একদিন নিতেই হবে।

