তিন আসনে সাংসদ হতে চান আ.লীগের ৯৩ জন

আনোয়ার হোসেন

নির্বাচন
নির্বাচন 

বিএনপিবিহীন উপনির্বাচনে সরকারি দল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া মানেই সংসদ সদস্য হওয়াটা অনেকটা নিশ্চিত বলে মনে করছেন অনেকে। ফলে আসন্ন জাতীয় সংসদের তিনটি শূন্য আসনের আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা এবং কেন্দ্রীয় নেতারাও চেষ্টা করছেন। এই দৌড়ে আছেন প্রয়াত সাংসদদের পরিবারের সদস্য, ব্যবসায়ী ও প্রবাসীরাও।

আওয়ামী লীগের দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গতকাল বুধবার পর্যন্ত তিনটি আসনের জন্য দলীয় মনোনয়ন ফরম কিনেছেন ৯৩ জন। আজ বৃহস্পতিবারও ফরম বিক্রি হবে। আগামী ১৪ জুলাই ঢাকা-১৪, সিলেট-৩ ও কুমিল্লা-৫ আসনে উপনির্বাচনের ভোট গ্রহণের তারিখ ঠিক করেছে নির্বাচন কমিশন। এই নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

আওয়ামী লীগ সূত্র বলছে, ১২ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে দলের সংসদীয় বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানেই এই তিনটি আসনে দলীয় প্রার্থী ঠিক করা হতে পারে। বৈঠকটি হবে সীমিত পরিসরে। প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থা ও দলের সাংগঠনিক প্রতিবেদন এবং দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য গুরুত্ব পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

তিনবারের সাংসদ আসলামুল হকের মৃত্যুর কারণে ঢাকা-১৪ আসন শূন্য হয়। তিনবারের সাংসদ মাহমুদুস সামাদ চৌধুরী মারা যাওয়ায় সিলেট-৩ এবং পাঁচবারের সাংসদ আবদুল মতিন খসরু মারা যাওয়ায় কুমিল্লা-৫ আসন শূন্য হয়।

কোথায় কতজন ফরম কিনেছেন— ঢাকা-১৪: ৩৩ জন সিলেট-৩: ২৫ জন কুমিল্লা-৫: ৩৫ জন ফরম দেওয়া হয়নি ডিপজল ও এখলাসকে।

দলীয় সূত্র বলছে, বিভিন্ন সময় নির্বাচনের আগে দলের নীতিনির্ধারকেরা কাউকে কাউকে ফরম কেনার জন্য আগেভাগে সংকেত দেন। এবার এখন পর্যন্ত এমন কিছু শোনা যাচ্ছে না। করোনার সংক্রমণের কারণে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পাওয়াও কিছুটা কঠিন। ফলে সম্ভাব্য প্রার্থীরা কিছু আঁচ করতে পারছেন না।

আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থী মানে জয় অনেকটাই নিশ্চিত—সাম্প্রতিক সময়ের নির্বাচনের ফলাফলের কারণে এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে। এই উপনির্বাচনে বিএনপি অংশ নিচ্ছে না, ফলে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকের সিদ্ধান্ত ভোটের দিনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। যাঁর ভাগ্যে দলীয় মনোনয়ন জুটবে, তিনিই সাংসদ হবেন।

তবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, সাংগঠনিকভাবে দক্ষ, স্থানীয়ভাবে পরিচিত, দলের জন্য ত্যাগ আছে—এমন প্রার্থীই বেছে নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে মাঠের চিত্র পর্যালোচনা করা হবে।

ঢাকা-১৪, সিলেট-৩ ও কুমিল্লা-৫ উপনির্বাচন। মনোনয়নের দৌড়ে কেন্দ্রীয় নেতা, প্রয়াত সাংসদদের পরিবারের সদস্য, ব্যবসায়ী ও প্রবাসীরা

ঢাকা-১৪ আসনে ৩৩ জন

ঢাকা-১৪ আসনে গতকাল পর্যন্ত ৩৩ জন মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। এঁদের মধ্যে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান (কচি), যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান খান (নিখিল) এবং সাবেক নারী সাংসদ ও যুব মহিলা লীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি সাবিনা আক্তার (তুহিন), প্রয়াত সাংসদ আসলামুল হকের স্ত্রী মাকসুদা হক রয়েছেন।

শাহ আলী ও দারুস সালাম থানা নিয়ে মিরপুর-১৪ আসন গঠিত। এই দুই থানার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং মহানগর উত্তরের বেশ কয়েকজন নেতা মনোনয়ন ফরম কিনেছেন।

দলের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সহযোগী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে মাইনুল হাসান খান ও সাবিনা আক্তার শক্ত প্রার্থী। আর তৃণমূল বিবেচনা করলে দারুস সালাম ও শাহ আলী থানার নেতারাই এগিয়ে থাকবেন। এর বাইরে বড় নাম এস এম মান্নান।

এস এম মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, দল তাঁকে বিবেচনা করবে বলে আশাবাদী।

আর মাইনুল হাসান খান বললেন, এলাকার মানুষের চাপে তিনি প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছেন। বাকিটা দলের সিদ্ধান্ত।

এঁদের তুলনায় আসলামুল হকের স্ত্রী সাংগঠনিকভাবে পিছিয়ে আছেন। প্রয়াত সাংসদের স্ত্রী হিসাবে কতটা সহানুভূতি পাবেন সেটা দেখার বিষয়।

ডিপজল ও এখলাসকে ফরম দেওয়া হয়নি

গত মঙ্গলবার বিএনপি থেকে ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত এখলাস উদ্দিন মোল্লাহ ও চলচ্চিত্র তারকা মনোয়ার হোসেন ডিপজল আওয়ামী লীগের ফরম সংগ্রহ করতে গিয়ে বিফল হন। তাঁরা আওয়ামী লীগ করেন—এমন প্রমাণ চাইলে দেখাতে পারেননি। এ জন্যই ফরম দেওয়া হয়নি। তবে দলীয় সূত্র বলছে, বেশ কয়েক বছর ধরেই এখলাস ও ডিপজল আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভিড়েছেন। ডিপজল ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগেও আওয়ামী লীগের দলীয় ফরম কিনেছিলেন। এবার দলের সক্রিয় নেতা ছাড়া অন্যদের মনোনয়ন দেওয়া হবে না—এই আলোচনা প্রবল। এ জন্য এখলাস ও ডিপজলকে ফরম দেওয়া হয়নি।

সিলেটে দেশি নাকি প্রবাসী

সিলেট-৩ আসনে গতকাল পর্যন্ত ফরম সংগ্রহ করেছেন ২৫ জন। যার প্রায় অর্ধেকই প্রবাসী বলে জানা গেছে। এই আসনের প্রয়াত সাংসদ মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর স্ত্রী ফারজানা চৌধুরীও মনোনয়ন ফরম কিনেছেন।

এখানে আলোচিত প্রার্থী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই সিলেট সদর আসনে মনোনয়ন চেয়ে আসছিলেন। কিন্তু সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের মতো প্রার্থী থাকায় সুযোগ পাননি।

দক্ষিণ সুরমা, বালাগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জ নিয়ে গঠিত সিলেট-৩ আসনের উপনির্বাচন মিসবাহর জন্য একটা সুযোগ বলে মনে করছেন স্থানীয় নেতারা। মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি আশা করছেন এবার দলীয় মনোনয়ন পাবেন।

এর বাইরে এই আসনে বেশ কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশি প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে আছেন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব এহতেশামুল হক চৌধুরীও আলোচনায় আছেন।

একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা বলছেন, সংগঠন শক্তিশালী করার কথা বিবেচনা করে উপজেলা বা জেলার কোনো নেতাকে প্রার্থী করার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

লম্বা প্রার্থীতালিকা কুমিল্লায়

সবচেয়ে মনোনয়নপ্রত্যাশী কুমিল্লা-৫ (ব্রাহ্মণপাড়া ও বুড়িচং) আসনে। এখানে গতকাল পর্যন্ত ৩৫ জন ফরম সংগ্রহ করেছেন। এখানে উত্তর জেলা ও দুই উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ সব নেতা মনোনয়ন ফরম কিনেছেন।

প্রয়াত আবদুল মতিন খসরুর স্ত্রী সেলিম সোবহান খসরু ও ছোট ভাই কুমিল্লা জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি আবদুল মমিন ফেরদৌসও ফরম নিয়েছেন।

আবদুল মোমিন ফেরদৌস প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, পরিবারের সদস্যরা তাঁকে সমর্থন দিয়েছেন। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা বিবেচনায় দলও তাঁকে মূল্যায়ন করবে বলে আশা করছেন।

মতিন খসরুর পরিবারের কেউ মনোনয়ন না পেলে তৃণমূলের নেতারা এগিয়ে থাকবেন বলে দলীয় নেতারা মনে করছেন।

দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকা এত লম্বা হওয়ার বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, সরকারদলীয় নেতাদের হাতে অঢেল টাকা। এখন সবাই সাংসদের সিল লাগাতে চান। এতে আয়ের পথ আরও বেড়ে যায়। এ ছাড়া এই নির্বাচনে বিএনপি নেই, ফলে ভোটে টাকাও খরচ করা লাগবে না। এ জন্যই প্রার্থী হতে এত দৌড়ঝাঁপ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *