ইতালির সাফল্যের পেছনে আছেন এক ব্যাংককর্মী
–
মানচিনিকে তো সবাই চেনেন, কিন্তু পাশের জনের নাম জানেন কয়জন?ফাইল ছবি: রয়টার্স
রবার্তো মানচিনির ইতালি এবার চমকে দিচ্ছে সবাইকে। ইউরোতে আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলছে আজ্জুরিরা। গতি আর পাসিং ফুটবল দিয়ে নিরপেক্ষ দর্শকদেরও মুগ্ধ করছে দলটি। অবশ্য শুধু পাসিং ফুটবল দিয়েই ইউরো জেতার পরিকল্পনা করছেন না কোচ মানচিনি।
কোনো টুর্নামেন্ট জেতার জন্য শুধু একটি নির্দিষ্ট কৌশলকে অস্ত্র বানালে তো চলে না। তাই কর্নার, ফ্রি-কিক থেকে গোল বের করে আনার উপায়ও খুঁজে নিচ্ছে তারা। ওয়েলসের বিপক্ষেই কর্নার নিয়ে তাদের কাজ টের পাওয়া গেছে। মাত্তেও পেসিনার গোলের ওই ফ্রি-কিকের সময় দুজন খেলোয়াড় অফ সাইডে দাঁড়িয়ে থেকে বিভ্রান্ত করে দিয়েছিলেন প্রতিপক্ষকে। আর এসব বুদ্ধি ইতালি পাচ্ছে এক সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার কাছ থেকে।
সাবেক কোনো ব্যাংক কর্মকর্তার ইতালির ফুটবলে প্রভাব রাখা নতুন নয়। ইতালিয়ান ফুটবলের চিরায়ত দর্শনকে নাড়িয়ে দিয়ে নাপোলিকে নিয়ে দুর্দান্ত ফুটবল উপহার দিয়েছিলেন মরিসিও সারি। চেলসির সাবেক কোচ ফুটবলকে বেছে নেওয়ার আগে ব্যাংকেই চাকরি জীবন শুরু করেছিলেন। এমনই আরেক ব্যাংককর্মী জিয়ান্নি ভিও। তাঁর সুবাদে এখন ৪ হাজার ৮৩০ উপায়ে ফ্রি–কিক মারার কৌশল হাতে পেয়েছে ইতালি!
না, ভুল পড়েননি, ৪৮৩০ উপায়ে ফ্রি–কিক নেওয়ার কৌশল আয়ত্ত করে রেখেছে ইতালি। প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের অবস্থান, গোলকিপারের দক্ষতা, মাঠে কোন জায়গায় বল আছে—সবকিছু মাথায় রেখে এই কৌশলগুলোর জন্ম দিয়েছেন ৬৬ বছর বয়সী ভিও।
ভিও যখন তাঁর কোচিং লাইসেন্সের জন্য থিসিস করছিলেন, সেটার শিরোনাম ছিল, ‘সেট পিসেস: ফিফটিন গোল স্ট্রাইকার।’ সে থিসিস থেকে একটি বইও লেখা হয়েছিল, ‘দ্যাট এক্সট্রা থার্টি পারসেন্ট।’ এসবই করছিলেন ভেনিসের ইউনিক্রেডিট ব্যাংকের একজন কর্মী হিসেবে। ইতালির সিরি ‘ডি’তে কাজ করার অভিজ্ঞতাই তাঁকে এমন কিছু করার অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। কিন্তো দি ত্রেভিস দলে দুজন যমজ ভাই ছিল, যাদের আলাদা করার কোনো উপায় ছিল না।
ভিও এই দুই ভাইকে বলতেন ফ্রি-কিক নেওয়ার সময় প্রতিপক্ষের গোলকিপারের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে। এতে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডাররা বিপদে পড়তেন। কারণ, তাঁরা বুঝতেন না যমজ দুজনের মধ্যে বিপদের কারণ হতে পারেন কোনজন। আর এভাবে দুজন একসঙ্গে তাকিয়ে থাকায় প্রতিপক্ষ গোলকিপারও মানসিকভাবে অস্বস্তিতে পড়তেন। এই ঘটনাই বুঝিয়ে দেয় ভিও শুধু হাতে থাকা খেলোয়াড় কাজে লাগাতে জানতেন না, মনস্তত্ত্বও ব্যবহার করতে পারতেন।
ভেনিসের এক পত্রিকায় একবার বলেছিলেন, ‘আমি এটুকুই বলব যে হাতে যে খেলোয়াড় আছে তাদের পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং তাদের দক্ষতার সঙ্গে যায়, এমন সমাধান বের করতে হবে। কিছু কিছু খেলোয়াড় আছে যাদের ম্যাচ পড়ার ক্ষমতা অন্য রকম। সর্বোচ্চ পর্যায়ে সের্হিও রামোসের নামই মাথায় আসছে। যেখানেই বল পাঠন না কেন, আপনি বাজি ধরতে পারবেন, সে ওখানে যাওয়ার উপায় বের করে নেবে। সেট পিসে থেকে ফল বের করার জন্য টাইমিং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’
২০০৫ সালে প্রথমে নজরে পড়েন ভিও। এক মনোবিদ আলেসান্দ্রো তেত্তামাঞ্জির সঙ্গে লেখা তাঁর বইটি ইতালির সাবেক গোলকিপার ওয়েল্টার জেঙ্গার হাতে পড়ে। জেঙ্গা তখন রেড স্টার বেলগ্রেডের কোচ। নিজের বইয়ের নাম দিয়ে ভিও বোঝাতে চেয়েছিলেন ম্যাচে সেট পিস (ফ্রি-কিক, কর্নার) দিয়ে ৩০ শতাংশ বাড়তি সুবিধা পাওয়া সম্ভব। নামে আকৃষ্ট হয়ে কিংবদন্তি গোলকিপার বইটি পড়া শুরু করলেন এবং শেষ করেন। এর পরপরই ভিওর সঙ্গে যোগাযোগ করেন ১৯৯০ বিশ্বকাপে ইতালির গোলবার সামলানো জেঙ্গা।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে আল-আইন ক্লাবের কোচ হওয়ার পর ভিওকে নিয়ে যান জেঙ্গা। ২০ দিনের সেট পিস অনুশীলন করিয়েছিলেন ভিও। এরপর জেঙ্গাকে সিরি ‘আ’র কাতানিয়ার দায়িত্ব নিতে বলা হলে উনি ভিওকে সেটপিস স্পেশালিস্ট হিসেবে নেওয়ার শর্ত দেন। জেঙ্গা এ ব্যাপারে বলেছিলেন, ‘আমার মতো পাগলের পক্ষেই সম্ভব ব্যাংকে চাকরি করেছে আর অপেশাদার লিগে কোচিং করিয়েছে, এমন একজনকে সিরি “আ”-তে নিজের প্রথম চাকরির সঙ্গী করা। জিয়ান্নি কেবল বৃহস্পতি আর শুক্রবার আমার সঙ্গে কাজ করত, শনিবার ফেরত যেত। এটি পাগলামি ছাড়া আর কিছুই নয়।’
জেঙ্গা অবশ্য সফল হয়েছিলেন। কাতানিয়া সেবার অবনমন এড়িয়েছিল ৪৪ গোল করার সুবাদে। এর ১৭টি এসেছিল সেট পিস থেকে।
২০১৮ বিশ্বকাপে জায়গা করে নিতে পারেনি ইতালি। নিজেদের সমৃদ্ধ ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর সময় ছিল সেটি। ওই দুঃসময়ে দলের দায়িত্ব নিয়ে সব বদলে ফেলতে চেয়েছিলেন মানচিনি। পাসিং ও আক্রমণাত্মক ফুটবলে নজর দিয়েছিলেন। আর ইউরোতে জায়গা নিশ্চিত করেই দলের সেটপিস নিয়ে কাজ করার জন্য যোগাযোগ করেছেন ভিওর সঙ্গে, ‘আমাকে মানচিনি সরাসরি ডেকেছেন। আমরা বোলোনিয়াতে দেখা করি, একটু আলাপ হলো এবং রাজি হই। গত সেপ্টেম্বর থেকে জাতীয় দলের সঙ্গে কাজ করছি।’
গত সেপ্টেম্বরে বসনিয়ার বিপক্ষেই টের পাওয়া গিয়েছিল ভিওর প্রভাব। লরেঞ্জো ইনসিনিয়ে ফ্রি-কিক নেওয়ার জন্য যখন প্রস্তুত হচ্ছিলেন, প্রতিপক্ষের দেয়ালের পেছনে আরও দুটি দেয়াল ইতালি বানিয়েছিল। অর্থাৎ তাঁরা অফসাইডে ছিলেন তখন। কিন্তু কিক নেওয়ার আগে তাঁরা সবাই আবার অনসাইডে চলে এসে বিভ্রান্ত করে দেন বসনিয়ার খেলোয়াড়দের।
ইউরোর মতো টুর্নামেন্টের আগে এভাবে সেটপিস নিয়ে কাজ করার কারণটা জেঙ্গাই বলে দিলেন, ‘মানচিনি জানে এটা একটা সাত ম্যাচের ছোট টুর্নামেন্ট এবং এখানে সেট পিস–এর মীমাংসা করে দিতে প্রভাব রাখবে।’
যদি সেটাই হয়, আর ইতালি ৫৩ বছরের অপেক্ষার শেষ টানতে পারে, তাহলে সাবেক ব্যাংককর্মীর অবদান নিশ্চিতভাবেই কেউ ভুলবেন না।