দুর্দান্ত মেসির শেষ হাসির অপেক্ষা

কোপার কোয়ার্টার ফাইনালে গতকাল ইকুয়েডরের বিপক্ষে গোল করে হাসছেন মেসি। এভাবে হাসতে চাইবেন কোপার সেমিফাইনাল ও ফাইনাল শেষেও।

কোপার কোয়ার্টার ফাইনালে গতকাল ইকুয়েডরের বিপক্ষে গোল করে হাসছেন মেসি। এভাবে হাসতে চাইবেন কোপার সেমিফাইনাল ও ফাইনাল শেষেও। ছবি: এএফপি

একবারে পারেননি। শতবার চেষ্টার চিন্তাও তাঁর জন্য অমূলক। লিওনেল মেসিকে যা করার হয়তো এবারই করতে হবে। এসপার নয়তো ওসপার!

কোন চেষ্টার কথা বলা হচ্ছে? মেসির ক্যারিয়ারের একমাত্র আক্ষেপের গল্প আর কী! আর্জেন্টিনার জার্সিতে কোনো শিরোপা জিততে না পারা! এর আগে নয়বার চেষ্টা করেছেন, পারেননি। কি বিশ্বকাপ, কি কোপা আমেরিকা—একেকটা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে গেছেন, আর মুখ ব্যাদান করে ফিরে এসেছেন। ‘এবার হবে’ স্বপ্ন বুকে বেঁধে টুর্নামেন্টের আগে গলা ফাটানো আর্জেন্টিনা সমর্থকদের গলার পাশাপাশি বুক ভাঙাই সার প্রতিবার।

এবার দশম চেষ্টা চলছে মেসির। ২০০৬ বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে এ নিয়ে চারটি বিশ্বকাপ আর পাঁচটি কোপা আমেরিকায় খেলেছেন। দশমবারে এসে আক্ষেপ ঘুচবে আর্জেন্টিনার নাম্বার টেন-এর?

উত্তর পেতে অপেক্ষা আর দুই ম্যাচের। আর দুটি জয়ের। বাংলাদেশ সময় গতকাল সকালে ইকুয়েডরকে ৩-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে কোপা আমেরিকার সেমিফাইনালে উঠে গেছে আর্জেন্টিনা, আগামী বুধবার বাংলাদেশ সময় সকাল সাতটায় সেখানে অপেক্ষায় গতকাল সকালেই আরেক কোয়ার্টার ফাইনালে উরুগুয়েকে বিদায় করে দিয়ে আসা কলম্বিয়া। সে বাধা পেরোলেই ফাইনাল, যেখানে পৌঁছাতে পারলে মেসিরা পাবেন পেরু কিংবা নেইমারের ব্রাজিলকে।বিজ্ঞাপন

বড়জোর এরপর আর একবার চেষ্টা করতে পারবেন আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড। বয়স হয়ে গেছে না! এই তো, ৩৪তম জন্মদিনের কেক কাটলেন মাত্র দিন দশেক হলো। ২০২২ বিশ্বকাপ শুরু হতে হতে বয়স ৩৫ পেরিয়ে যাবে। মেসি শেষের ডাক শুনছেন।

ডাকটাকে উপেক্ষা করেও চলছেন! এই বয়সে যেভাবে সর্বস্ব দিয়ে ঝাঁপাচ্ছেন, এই কোপা আমেরিকায়ই যেভাবে সবটুকু নিংড়ে দিচ্ছেন, তা দেখে কে বুঝবে এই মেসির বয়স ২৩-২৪-এর বেশি! গতি কমেছে? খেলা গড়ে দেওয়ায়, ড্রিবলিংয়ে সে অভাব পুষিয়ে দিচ্ছেন মেসি। কোপা আমেরিকায় এবার চার ম্যাচে এখন পর্যন্ত যেভাবে দলের তরুণদের সঙ্গে সমন্বয় করে বল কেড়ে নিতে ঝাঁপাচ্ছেন, সেসব দৃশ্য অনুচ্চারে বলে দিচ্ছে, ব্রাজিলের মাটি থেকে এবার কোপা আমেরিকার ট্রফিটা না আনতে পারলে মেসির শান্তি হচ্ছে না!

কিন্তু শুধু প্রেসিংয়ে ঝাঁপানো কিংবা কাল ইকুয়েডরকে হারানোর পর সতীর্থের ভিডিও ধারণের সময়ের মুষ্টিবদ্ধ বাহুতে জানানো প্রতিজ্ঞাই তো মেসির কথা বলবে না, মেসির কথা বলবে তাঁর গোল করা ও করানো এবং তাঁর খেলা গড়ে দেওয়া। আর সেখানে মেসির প্রতিজ্ঞার অনুরণন আরও স্পষ্ট। আরও গম্ভীর সে স্বর।

ইকুয়েডরের বিপক্ষে গতকাল আর্জেন্টিনার তিন গোলের তিনটিতেই মেসির অবদান। রদ্রিগো দি পল আর লওতারো মার্তিনেজকে দিয়ে দুই অর্ধের শেষ দিকে দলের প্রথম দুই গোল করিয়েছেন, ম্যাচের যোগ করা সময়ে চোখধাঁধানো ফ্রি-কিক এসেছে মুকুটের পালক হয়ে। প্রথমার্ধের মাঝামাঝি ম্যাচ গোলশূন্য থাকার সময়ে ম্যাচের সবচেয়ে সুবর্ণ সুযোগটি হাতছাড়াও অবশ্য মেসিই করেছেন, গোলকিপারকে একা পেয়েও বল জালে রাখতে পারেননি। কিন্তু সেই আক্ষেপ ম্যাচ শেষ হতে হতে কী দারুণভাবেই না ভুলিয়ে দিয়েছেন মেসি!

অন্যদের কৃতিত্ব এতে খাটো হচ্ছে না। দি পল, মার্তিনেজ, লো সেলসোরা দারুণ লড়ছেন, মেসিকে ঘিরেই স্বপ্ন বুনছেন। তাঁদের কথায়, খেলায় বুঝিয়ে দিচ্ছেন, মেসি আর আর্জেন্টিনার আক্ষেপ ঘোচানোকে প্রতিজ্ঞা মেনে চোয়াল শক্ত রাখছেন তাঁরাও। দলের রক্ষণ আর মাঝমাঠকে আগের চেয়ে অনেকটা মজবুত করেছেন আর্জেন্টিনার বর্তমান কোচ লিওনেল স্কালোনি। কাল ইকুয়েডরের বিপক্ষে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার গিদো রদ্রিগেজ আর উইঙ্গার আনহেল দি মারিয়াকে যথাসময়ে নামিয়ে ম্যাচটাকে আর্জেন্টিনার হাতছাড়া হতে দেননি। বুঝিয়ে দিয়েছেন, আর্জেন্টিনার টানা ১৮ ম্যাচ অপরাজিত থাকার কৃতিত্বের কিছু ভাগ তাঁরও প্রাপ্য।

কিন্তু দিন শেষে এই আর্জেন্টিনা দলটা মেসিরই। দলটার মুখ মেসি, প্রাণ মেসি।

গোলের জোগানেও মেসি। পরিসংখ্যানই দেখুন না! গতকাল পর্যন্ত কোপা আমেরিকায় আর্জেন্টিনা যে ১০ গোল করেছে, তার ৮টিতেই মেসির অবদান। চারটি নিজে করেছেন, চারটি করিয়েছেন। গোল করা আর করানোর রেকর্ডে টুর্নামেন্টের সেরাও মেসিই।

এই ‘অল্প’ কীর্তিতে মন ভরছে না? নামটা মেসি বলেই এগুলোকেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছে? সে ক্ষেত্রে আপনার জন্য বাড়তি তথ্য, কালকের ম্যাচ নিয়ে টুর্নামেন্টে আর্জেন্টিনার চার ম্যাচের তিনটিতেই ম্যাচসেরা খেলোয়াড়ের নাম লিওনেল মেসি! ২০২১ সালে ক্লাব ও জাতীয় দল মিলিয়ে এ পর্যন্ত ৩৫ ম্যাচের ২১টিতেই ম্যাচসেরা এই আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড। কালকের ফ্রি-কিক দিয়ে ক্যারিয়ারে ফ্রি-কিক থেকে গোলের রেকর্ডেও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকেও ছাড়িয়ে গেছেন। রোনালদোর গোল ৫৭টি, মেসির ৫৮।

গোলকিপারের সামনে ইকুয়েডরের মানবদেয়ালে ছয়জন আর আশপাশে বাকি চারজনকে রেখেও মেসির ফ্রি-কিক ঠেকানোর চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ব্রাজিল কিংবদন্তি পেলেকেও ছুঁয়ে ফেলার আরও কাছে মেসি। দক্ষিণ আমেরিকান অঞ্চলে এখন পর্যন্ত জাতীয় দলে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড পেলের (৭৭), ইকুয়েডরের বিপক্ষে কালকের গোলটি মেসির ৭৬তম। এর বাইরে ৪৬ গোল করানোর রেকর্ড তো আছেই মেসির!

পেলের রেকর্ডটা ব্রাজিলের মাটিতেই ভাঙতে পারবেন মেসি? প্রশ্নটা অবধারিতভাবেই এসেছে। কিন্তু মেসির সরাসরি জবাব, ‘ব্যক্তিগত রেকর্ডের জন্য এখানে আসিনি আমি। আমাদের এখানে একটা অন্য কিছুর জন্য এসেছি।’

অন্য কিছুটা কী, তা মেসির বলার দরকার পড়ে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *