চার মামলায় আসামি হাজারের বেশি, আছেন বিএনপি-জামায়াতের নেতারা
কুমিল্লার ঘটনার জেরে চট্টগ্রাম নগর ও জেলায় পূজামণ্ডপে হামলা ও তোরণ ভাঙচুরের ঘটনায় পৃথক চারটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় দেড় শ জনের নাম উল্লেখ করার পাশাপাশি অজ্ঞাতপরিচয় ১ হাজার ৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলার আসামিদের মধ্যে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা জামায়াতের আমির জাফর সাদেক, সাতকানিয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ মুজিবুর রহমানের নাম রয়েছে। এসব মামলায় রোববার পর্যন্ত ৯৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
মামলায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের আসামি করার প্রতিবাদ জানিয়েছেন দলটির চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করতে সাতকানিয়াসহ বিভিন্ন থানায় করা মামলায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের আসামি করা হয়েছে। বিএনপির লোকজন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী। আমরাও চাই, পূজামণ্ডপে প্রকৃত হামলাকারীদের বিচার হোক।’
গত শুক্রবার দুপুরে নগরের আন্দরকিল্লা জেএমসেন হল পূজামণ্ডপে হামলা, ফটকের ব্যানার ছিঁড়ে ফেলা ও মণ্ডপে ঢিল ছোড়ার ঘটনায় শনিবার পুলিশ বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় ৮৪ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছে। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে পাঁচ শ জনকে। নাম উল্লেখ করা আসামির বেশির ভাগই নগরের বৃহৎ পাইকারি কাপড়ের বাজার টেরিবাজারের দোকানমালিক ও কর্মচারী। রোববার পর্যন্ত পুলিশ এই মামলায় ৮৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। মামলার এজাহারে বলা হয়, আন্দরকিল্লা এলাকার বাসিন্দা ইমরান মাজেদ ওরফে রাহুল ও মো. হানিফের নেতৃত্বে শুক্রবার জুমার নামাজের পর আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদের সামনে কুমিল্লায় কোরআন অবমাননার অভিযোগে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। তাঁরা দুজন টেরিবাজারের কাপড়ের ব্যবসায়ী। দুজনের রাজনৈতিক কোনো পরিচয় নেই। তবে তাঁরা বিএনপির সমর্থক বলে স্থানীয় লোকজন ও পুলিশ সূত্র জানিয়েছে। মামলার আসামিদের মধ্যে দুজন কিশোরও রয়েছে। তাদের বয়স ১৭।
মামলার এজাহারে ঘটনার বর্ণনায় বলা হয়, শুক্রবার জুমার নামাজের পর আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদের সামনে ৪০০ থেকে ৫০০ জন হাতে লাঠিসোঁটা ও ইটপাটকেল নিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। তাঁরা মসজিদের সামনের রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে দেন। বাধা দিলে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। এতে পুলিশের কয়েকজন সদস্য আহত হন। পুলিশ তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে চেষ্টা করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফাঁকা গুলি ছোড়েন। একপর্যায়ে তাঁরা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পুরোনো কার্যালয়ের গেটে ভেঙে সেখানে ঢুকে ভাঙচুরের চেষ্টা করেন। এতে ৩০ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ ছাড়া রহমতগঞ্জ রাস্তার মুখে পুলিশের তল্লাশিচৌকির ব্যারিকেড ভেঙে ২০ হাজার টাকার ক্ষতি করেন। সেখান থেকে বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ, চট্টগ্রাম মহানগরের শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে লাগানো দেবী দুর্গার ছবিসংবলিত ব্যানারে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন, ব্যানারে ছিঁড়ে ফেলেন ও গেট ভাঙচুর করেন। এতে সর্বমোট দেড় লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়।
ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে জড়িতদের চিহ্নিত ও আসামি করা হয়েছে বলে কোতোয়ালি থানার ওসি নেজাম উদ্দিন জানিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জড়িত বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। এ পর্যন্ত ৮৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। সোমবার শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, টেরিবাজারের ব্যবসায়ী ইমরান মাজেদ ও হানিফের নেতৃত্বে আকস্মিক এই বিক্ষোভ মিছিল বের হয় বলে গ্রেপ্তার আসামিরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানান। এ বিষয়ে তাঁরা দুজন বলেছেন, কুমিল্লার ঘটনার জেরে তাঁরা ওই বিক্ষোভ মিছিল করেন। দেবী দুর্গার ছবিসংবলিত ব্যানার ছেঁড়া ও ইটপাটকেল ছুড়ে মারার ঘটনাটি বিক্ষোভে অংশ নেওয়া কয়েকজন করেছেন। এ বিষয়ে তাঁদের কোনো পরিকল্পনা ছিল না।
মামলার আসামিদের বেশির ভাগই টেরিবাজারের দোকানমালিক ও কর্মচারী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে টেরিবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, কুমিল্লার ঘটনার পরপরই ব্যবসায়ী সমিতির কার্যালয়ের মাইকে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনায় কেউ যাতে না জড়ান, সে আহ্বান জানানো হয়েছিল। শুক্রবার মার্কেট বন্ধ ছিল। মার্কেটের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় লোকজন আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেন। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে অনেক নিরীহ দোকান কর্মচারীকে আটক করেছে বলে তাঁদের পরিবারের দাবি। প্রকৃতপক্ষে যাঁরা ঘটনায় জড়িত, তাঁদের বিচার হোক।
বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি আশীষ কুমার ভট্টাচার্য বলেন, হামলায় জড়িত দুষ্কৃতকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
সাতকানিয়ায় গ্রেপ্তার ৩
সাতকানিয়ায় পূজামণ্ডপের অস্থায়ী তোরণ ভাঙচুরের ঘটনায় চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা জামায়াতের আমির জাফর সাদেক, সাতকানিয়া উপজেলা জামায়াতের সাবেক আমির মাওলানা আবুল ফয়েজ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোজাফ্ফর আহমদ, সাতকানিয়া উপজেলা জামায়াতের বর্তমান আমির মাওলানা কামাল উদ্দিন, সাতকানিয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ মুজিবুর রহমানসহ ৪২ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছে পুলিশ। এ ছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৪০ থেকে ৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। গত শুক্রবার রাতে সাতকানিয়া থানায় মামলাটি হয়। গতকাল পর্যন্ত পুলিশ এই মামলায় তারেক হোসেন, মনিরুল হাসান ও আবদুল্লাহ তুষার নামের তিন তরুণকে গ্রেপ্তার করে।
থানা-পুলিশ ও সাতকানিয়া উপজেলা পূজা উদ্যাপন কমিটি সূত্রে জানা যায়, কুমিল্লার ঘটনার জেরে গত শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে উপজেলার দক্ষিণ কাঞ্চনার জোটপুকুরিয়া বাজার এলাকায় ৭০ থেকে ৮০ জন একটি মিছিল বের করেন। এ সময় তাঁরা পার্শ্ববর্তী শিব-দুর্গা মন্দির এলাকার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাঁদের বাধা দেয়। পরে তাঁরা পুলিশের দিকে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। এরপর তাঁরা সাতকানিয়া-বাঁশখালী সড়কের জোটপুকুরিয়া বাজার এলাকায় শিব-দুর্গামন্দির পূজামণ্ডপের অস্থায়ী তোরণটি ভাঙচুর করে পালিয়ে যান।
সাতকানিয়া থানার ওসি আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
বাঁশখালীতে আসামি পাঁচ শতাধিক
বাঁশখালীতে পূজামণ্ডপের তোরণ ভাঙচুরের ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। একটিতে ২১ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতপরিচয় ১২০ জনকে আসামি করা হয়েছে। আরেকটিতে অজ্ঞাতপরিচয় পাঁচ শ জনকে আসামি করা হয়েছে বলে বাঁশখালী থানার ওসি কামাল উদ্দিন জানিয়েছেন।
বাঁশখালী পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি আশীষ শীল প্রথম আলোকে বলেন, নাপোড়া ও চাম্বলের ঘটনায় দুটি মামলা করা হয়েছে। জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হোক।
এদিকে কুমিল্লার ঘটনার জেরে গত শুক্রবার কর্ণফুলী উপজেলার শাহমীরপুর এলাকায় প্রতিমা ভাঙচুর ও কয়েকটি ঘরে হামলার ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় তিন শ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। এই মামলায় মো. ফোরকান, আবদুল্লাহ আল মামুন ও শাজাহান নামের তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ওই এলাকার বাসিন্দা এই তিনজনের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই।