কে এই এলিনা কাভায়েভা, পুতিনের সঙ্গে সম্পর্ক কী

ইউক্রেনে হামলার পর রাশিয়া ও দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। পুতিন ঘনিষ্ঠ রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তাদের পাশাপাশি তাঁর দুই মেয়েও নিষেধাজ্ঞার আওতায় এসেছেন। এবার ইউরোপীয় কমিশনের প্রস্তাবিত নতুন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় একটি নাম এসেছে, যাঁর সঙ্গে পুতিনের রক্তের সম্পর্ক বা সরাসরি দাপ্তরিক সম্পর্ক নেই। তবে নামটি নিয়ে পুতিন সম্পর্কে অবগতদের বিপুল আগ্রহ রয়েছে।

তিনি সাবেক রুশ জিমন্যাস্ট এলিনা কাবায়েভা। এক সময় পুতিনের দল ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টিরও সদস্য ছিলেন। এই দল থেকে রাশিয়ার পার্লামেন্টের নিম্মকক্ষ ডুমার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এক সময় তিনি রাশিয়ার ন্যাশনাল মিডিয়া গ্রুপের চেয়ারপারসনের দায়িত্বে ছিলেন। দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান সব সংবাদমাধ্যমে এই গ্রুপের মালিকানা রয়েছে। বর্তমানে তিনি সুইজারল্যান্ডে বসবাস করেন।

এসব ছাপিয়ে এলিনা কাবায়েভার প্রতি বিশেষ আগ্রহের পেছনে আরেকটি কারণ রয়েছে। জল্পনা রয়েছে তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রেমিকা। এমনকি রুশ প্রেসিডেন্টের কয়েকজন সন্তানের মা–ও তিনি।

জল্পনা সত্যি হলে তিনিও পুতিনের ঘনিষ্ঠ। প্রশ্ন উঠতে পারে, এরপরও নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল থেকে কেন মুক্তি পেলেন তিনি? কয়েকটি সূত্রের বরাত দিয়ে বিবিসি বলছে, এতদিন পার পেলেও এবার তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে প্রস্তাব দিয়েছে ইউরোপীয় কমিশন।

একই কথা বলছে বার্তা সংস্থা এএফপি। তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রেমলিনের হয়ে মিথ্যা প্রচার ও পুতিনের ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণে এলিনাকে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় ফেলতে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ইইউ জোটের সদস্য দেশগুলো অনুমোদন দিলেই ওই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করা হবে।

পুতিন সব সময়ই নিজেকে কঠোর গোপনীয়তার বেড়াজালে রাখেন। ব্যক্তিজীবন নিয়ে করা প্রশ্নগুলো একদমই এড়িয়ে যান তিনি। হয়তো এ কারণেই এলিনা কাবায়েভের সঙ্গে সম্পর্কের কথা সরাসরি অস্বীকার করেছেন তিনি।

২০০৮ সালে মস্কোভস্কি করেসপন্ডেন্ট পত্রিকা খবর প্রকাশ করে যে, ভ্লাদিমির পুতিন তাঁর স্ত্রী লুদমিলার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে এলিনা কাবায়েভাকে বিয়ে করার পরিকল্পনা করছেন। তখন দুই নারীই এ খবর নাকচ করেন। এর কিছু দিন পরেই রাশিয়া সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়। এর প্রায় পাঁচ বছর পর পুতিন ও লুদমিলা তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদের ঘোষণা দেন।

দুজনের সম্পর্কের কথা পুতিন অস্বীকার করার পর একজন সফল ক্রীড়াবিদ থেকে নিজেকে রাজনীতিতে জড়ান কাভায়েভা। কাভায়েভা মূলত একজন রিদমিক জিমন্যাস্ট ছিলেন। এতে প্রতিযোগীরা রিবন ও বলের মতো সরঞ্জাম ব্যবহার করে নিজেদের উপস্থাপনা করেন।

জিমন্যাস্ট হিসেবে দেশ-বিদেশে এলিনা কাভায়েভার বেশ সুনাম ছিল। ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে নিজেকে বিশ্বের সেরা জিমন্যাস্ট বলেও দাবি করতেন তিনি। এলিনা কাভায়েভা ছিলেন রুশ টিমের নেতৃস্থানীয় জিমন্যাস্ট, এই ক্রীড়ায় প্রভাব ধরে রেখেছিল তাঁদের দল। ২০০০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতিটি অলিম্পিকেই সোনা জেতে রাশিয়া।

এলিনা কাভায়েভার জন্ম ১৯৮৩ সালে। মাত্র চার বছর বয়স থেকেই তিনি রিদমিক জিমন্যাস্টের চর্চা শুরু করেন। কাভায়েভার কসরত দেখে কোচ ইরিনা ভিনেরও উচ্ছ্বসিত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘তাঁকে যখন প্রথম দেখি তখন আমি নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। রিদমিক জিমন্যাস্টিকের গুরুত্বপূর্ণ দুটি গুণের সমাবেশ তাঁর মধ্যে, যা সাধারণত দেখা যায় না। এগুলোর একটি হলো নমনীয়তা ও অপরটি হলো ক্ষিপ্রতা।’

১৯৯৬ সালে আন্তর্জাতিক জিমন্যাস্টিকে অভিষেক হয় কাভায়েভার। এর মাত্র দুই বছরের মাথায় ১৯৯৮ সালে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন তিনি।

ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের পর তাঁর ওপর প্রত্যাশার চাপ আরও বেড়ে যায়। ২০০০ সালে সিডনি অলিম্পিকে অপ্রত্যাশিত ভুলে স্বপ্নপূরণের পথে হোঁচট খান কাভায়েভা। তবে পুরোপুরি খালি হাতে ফিরতে হয়নি তাঁকে। অলরাউন্ড ইভেন্টে ব্রোঞ্জ পদক জেতেন তিনি। চার বছর পর এথেন্স অলিম্পিকে ধরা দেয় কাঙ্ক্ষিত স্বর্ণ পদক।
অবসরে যাওয়ার আগে ১৮টি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন কাভায়েভা। এ ছাড়া ২৫টি ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন তিনি। তবে রাশিয়ার অন্যান্য অ্যাথলেটদের মতো ডোপ কেলেঙ্কারি থেকে মুক্ত থাকতে পারেননি তিনি। নিষিদ্ধ কিছু সেবন করায় ডোপ ডেস্টে পজিটিভ হলে ২০০১ সালে তাঁর পদক কেড়ে নেওয়া হয়।

জিমন্যাস্ট থেকে অবসরের পর রাজনীতিতে জড়ান কাভায়েভা। ২০০৭ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত রাশিয়ার পার্লামেন্টের নিম্মকক্ষ ডুমার সদস্য ছিলেন তিনি। এরপর ২০১৪ সালে ন্যাশনাল মিডিয়া গ্রুপের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।

ক্রেমলিন এসব খবর অস্বীকার করে আসছে। ২০১৫ সালে পুতিনের এক মুখপাত্র বলেন, ভ্লাদিমির পুতিনের ঔরসে সন্তান জন্মের খবরের কোনো ভিত্তি নেই।
পুতিন অবশ্য প্রথম স্ত্রী লুদমিলার গর্ভে জন্ম নেওয়া তাঁর সন্তানদের নামও প্রকাশ্যে কখনো উল্লেখ করেননি। শুধু এটুকু বলেছেন যে, তাঁর দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে আছে।

পুতিনের সঙ্গে সম্পর্কের কথা প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই আলোচনায় উঠে আসেন কাভায়েভা। ফ্যাশন সাময়িকী ভোগ ২০১১ সালে তাঁকে নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করে। সেখানে তিনি ফরাসি ফ্যাশন হাউজ বেলমেইনের তৈরি একটি স্বর্ণখচিত পোশাক পরেন। ২০১৪ সালে সোচির শীতকালীন অলিম্পিকের মশালধারীদের একজন ছিলেন কাভায়েভা।

সর্বশেষ গত এপ্রিলে মস্কোতে জুনিয়র জিমনাস্টিকস উৎসবে যোগ দেন এলিনা কাভায়েভা। এর মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন বলে যে কথা বলা হচ্ছিল, তাতে পানি ঢালেন। সেখানে বক্তব্যে রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানের প্রশংসা করেন তিনি।

ইউক্রেনে রুশ হামলার পর থেকেই কাভায়েভার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি ওঠে। তবে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী নয় বলে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের খবর। ব্যাখ্যায় বলা হয়, ভ্লাদিমির পুতিনের ‘একান্ত ব্যক্তিগত জায়গায়’ এ ধরনের ব্যবস্থা নিলে তাতে উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে।