পোশাক খাত: রপ্তানি বাড়লেও ক্রয়াদেশ কমছে
একদিকে পোশাকের বৈশ্বিক চাহিদা কমেছে, অন্যদিকে বিদ্যুৎ সংকট। দ্বৈত প্রতিকূলতার কবলে পড়া পোশাক খাতে এরই মধ্যে কমেছে রপ্তানি অর্ডারও, যা দেশের করোনা মহামারি থেকে অর্থনৈতিক উত্তরণের পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। আর এ প্রভাব আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই দৃশ্যমান হবে। বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহ, কন্টেইনার ভাড়া, ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে গত পাঁচ বছরে পোশাক খাতের সামগ্রিক উৎপাদন খরচ ৪০ শতাংশ বেড়েছে।
সম্প্রতি গ্যাসের বাড়তি দাম ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে এ খরচ আরো বাড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। এমন পরিস্থিতিতেই তৈরি পোশাক শিল্প খাতে চলতি অর্থবছরে উৎসে কর গত অর্থবছরের তুলনায় দ্বিগুণ করা হয়েছে, যা খাতটির ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে। তাই উৎসে কর দশমিক ৫ শতাংশ করাসহ দীর্ঘমেয়াদি নীতি সহায়তা চেয়ে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগে চিঠি লিখেছেন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তৈরি পোশাক খাতের অনেক রপ্তানিমুখী কারখানায় কমছে ক্রয়াদেশ। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট, বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে খরচ বাড়ছে পোশাক কারখানায়। আর গ্যাস সংকটে অনেক বস্ত্র কলের উৎপাদন ৫০ শতাংশের মতো ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সময়মতো সুতা ও কাপড় সরবরাহ পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা, যা মহামারি থেকে দেশের অর্থনৈতিক উত্তরণের পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো যেন অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত না পায়, সেটি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এজন্য গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং কাঁচামাল আমদানির জন্য ডলার সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে বলে মনে করেন তারা।
বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি মোহাম্মদ নাছির ভোরের কাগজকে বলেন, ক্রয়াদেশ নিয়ে মারাত্মক আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, যদিও এখন রপ্তানি ভালো দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বর্তমান খারাপ পরিস্থিতির প্রভাব আগামী ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যেই পাওয়া যাবে। তিনি আরো বলেন, বৈশ্বিক মহামারিতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পোশাক খাত। এরপর সংক্রমণ পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে প্রচুর ক্রয়াদেশ আসতে শুরু করে। ফলে পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা অর্জন করে। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি প্রচুর বেড়ে যায়। এ কারণে ওই সব দেশের মানুষ পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছে। তাই ক্রয়াদেশও কমতে শুরু করেছে, যা ভবিষ্যতে আরো কঠিন আকার ধারণ করার শঙ্কা রয়েছে। এছাড়া উৎপাদন খরচ ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। এসব পরিস্থিতিতে উৎসে কর কমানোসহ অন্যান্য নীতি সহায়তা দীর্ঘমেয়াদে দিয়ে সরকার এ সংকটকালে পোশাক খাতকে টিকে থাকতে সহায়তা করবে বলে আশা করছি।
রপ্তানি বাজারের জন্য পোশাক তৈরির কাঁচামাল আমদানি করতে ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশনের (ইউডি) সনদ দেয় তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এবং নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ। ফলে ইউডির সংখ্যা দিয়ে পোশাকের ক্রয়াদেশ কম নাকি বেশি সেটি বোঝা যায়। সংগঠনের নেতারা জানান, গত মে-জুন মাসে ইউডি নেয়ার সংখ্যা ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় ১৮ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে একই সময়ে বিকেএমইএ থেকে ইউডি নেয়ার সংখ্যা ১০ শতাংশ কমেছে।
জানতে চাইলে বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ভোরের কাগজকে বলেন, এই মুহূর্তে গ্যাস সংকটে ডায়িংয়ে অনেক প্রভাব পড়ছে। তিনি বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানেই ইতোমধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ উৎপাদন কম হচ্ছে। এতে দুই ধরনের সমস্যা হচ্ছে। যেমন বায়ারদের সঙ্গে কমিটমেন্ট রাখতে পারছি না, যা রপ্তানিতে প্রভাব পড়ছে। আবার উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, বিদ্যুৎ না থাকার কারণে আমাকে জেনারেটর চালিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। ডিজেল কিনতে হয়। সরকার ডিজেল বাঁচাতে বিদ্যুৎ কম দিচ্ছে। কিন্তু বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে আমাকে ডিজেলই কিনতে হচ্ছে। আবার যারা আইপিএস ব্যবহার করে, তারা এটাকে চার্জ দিয়ে রাখছে। ফলে বিদ্যুৎও বেশি যাচ্ছে। এতে আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, একটা খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। মূল্যস্ফীতির কারণে এ সময় পোশাকের আমদানিকারক দেশগুলোতে ভোক্তা চাহিদা স্বাভাবিকভাবেই কমবে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ থেকে বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো যেন কোনো ধরনের অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত না পায় সে বিষয়ে গুরুত্বসহকারে নজর রাখা প্রয়োজন। তার জন্য শিল্পকারখানায় গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং কাঁচামাল আমদানির জন্য পর্যাপ্ত ডলার সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।
পোশাক খাতের অভ্যন্তরীণ এ সংকটের বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছে বিশ্ব গণমাধ্যমও। গতকাল মঙ্গলবার এমনি এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ব্লæমবার্গ ও ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইকোনমিক টাইমস। প্রতিবেদনে তন্ময় হিলফিগার ও ইন্ডিটেক্স এসএ’স জারা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক দাবি করেন, বছর ব্যবধানে জুলাইয়ে নতুন অর্ডার বাড়েনি, উল্টো কমেছে ২০ শতাংশ। উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে কাক্সিক্ষত গন্তব্যে রপ্তানি পণ্য না পৌঁছানের জন্য তিনি দুটো বিষয়কে দায়ী করছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে খুচরা বিক্রেতারা হয় নির্দিষ্ট সময়ে জাহাজ থেকে পণ্য খালাস স্থগিত করে রেখেছে। আর না হয় অর্ডার আনতে গড়িমসি করছে। এটা দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। তিনি আরো জানান, অর্ডার না আসা মানে দেশের অর্থনীতি বিপদে পড়া। এই পোশাক শিল্পের ভূমিকা রয়েছে মোট দেশজ উৎপাদনের ১০ শতাংশের বেশি, যেখানে ৪৪ লাখ লোক এই কর্মে নিয়োজিত রয়েছে। এ দুঃসময়ে এসে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার জ¦ালানি সংরক্ষণ করতে গিয়ে দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিতে পারে না। এ মুহূর্তে দেশ-বিদেশে পোশাক খাত বহুমুখী প্রতিকূলতার শিকার হচ্ছে উল্লেখ করে ফজলুল হক বলেন, যথাসময়ে পোশাক রপ্তানি করতে হলে দেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু রাখা প্রয়োজন।
জ্বালানি সংকটে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। ডায়িং ও ওয়াশিং ইউনিটের জন্য দিনে তিন ঘণ্টা জেনারেটরের উপর ভরসা করতে হচ্ছে। এতে জেনারেটরের ব্যয় বিদ্যুতের চেয়ে বেড়ে তিন গুণ হয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ সংকটে ডায়িং ও ওয়াশিং ইউনিটের উৎপাদন কার্যক্রম কোনোভাবেই বন্ধ রাখা যায় না। যদি এটা করতে হয়, তাহলে সব ফেব্রিক্স নষ্ট হয়ে যাবে। প্রতিবেদনে এমনটিই জানিয়েছেন স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপ লিমিটেডের চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান।
এদিকে গতকাল মঙ্গলবার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানানো হয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চলমান জ্বালানি সংকট ও মুদ্রাস্ফীতির মধ্যেও বিশ্ববাজারে জুলাই মাসে দেশের পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ৯৮৪ দশমিক ৮২ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে তুলনায় বেড়েছে ১৪ দশমিক ৭২ শতাংশ। ইপিবির তথ্য মতে, চলতি বছরের জুলাইয়ে তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৩৩৬ কোটি ৬৯ লাখ ১০ হাজার মার্কিন ডলার। যেখানে ২০২১ সালের জুলাইয়ে রপ্তানি হয়েছিল ২৮৮ কোটি ৭২ লাখ ১০ হাজার ইউএস ডলার। অর্থাৎ ২০২১ সালের জুলাই মাসের তুলনায় ২০২২ সালের জুলাই মাসে ৪৭ কোটি ৯৭ লাখ ইউএস ডলার পরিমাণ রপ্তানি আয় বেড়েছে।
এ বিষয়ে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল ভোরের কাগজকে বলেন, বৈশ্বিক অর্থনীতির এ কঠিন সময়ে যেখানে আমাদের অর্থনীতি আমদানিকৃত মুদ্রাস্ফীতির মুখোমুখি, ইউরো মার্কিন ডলারের বিপরীতে কমছে। আমদানি ব্যয় বাড়ছে। এই অবস্থায় জুলাই মাসে রপ্তানি আয় বেড়েছে এটা আমাদের জন্য ইতিবাচক। তবে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকটের কারণে এবং উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে উৎপাদন কমে যাওয়ার যে প্রভাব পড়েছে তা আগামী তিন থেকে চার মাস পরে বোঝা যাবে।