কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীদের ছলনা
এম ডি কামরুল হাসান, যুক্তরাজ্য
কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের ভাষ্য, “আদালতের রায় নিয়ে আমাদের দ্বিমত নেই, আমাদের দাবি হাইকোর্টের কাছে নয়।”
যারা কোটাবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটই জানে না, তারা নিজেদের মেধাবী দাবি করে মেধা কোটা নিয়ে আন্দোলন করছে – এটা খুবই হাস্যকর। আমি নিশ্চিত এখন আন্দোলনে থাকা একজনেরও বিসিএস প্রিলিমিনারি পাশ করার যোগ্যতা নেই। কথিত মেধাবীদের মতো অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের ইতিহাস জানেন না, বা ভুলে গেছেন। ২০১৮ সালে কোটা আন্দোলন শুরুই হয়েছিল আসিফ নজরুলের পরামর্শে এডভোকেট এখলাস উদ্দিন ভুঁইয়ার করা একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটা চালু হয়, নিয়োগ পান ৩৫০ জন। দ্বিতীয় দফায় নিয়োগের আগেই (১৯৭৭ সালে) জিয়াউর রহমান কোটা বাতিল করে। ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধা কোটা চালু হয়। তখন এর বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু করেছিল শিবির। তবে গণধোলাই খেয়ে পিছু হটে। ২০১৩ সালে শিবিরের শিশির মনির আবার কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরুর ব্যর্থ চেষ্টা করে। এ সময় আসিফ নজরুল “কোটা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” শিরোনামে প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক লেখায় কোটা বাতিলে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার কথা উল্লেখ করেছিলেন। ধারণা করা হয়, তার কলামে উল্লিখিত আইনজীবী হলেন শিশির মনিরের সহযোগী এখলাস।
২০১৮ সালে এখলাস উদ্দিন ভুইয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-নাতনি, প্রতিবন্ধী, নারী, জেলা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটাসহ সব ধরনের কোটা বাতিল চেয়ে রিট আবেদন করে। রিটের রায়ে আদালত সুস্পষ্টভাবে এখলাস উদ্দিনকে জানায়, এ নিয়ম হয়েছে ১৯৯৭ সালে, রিট করলে তখনই করা ন্যায়সঙ্গত ছিল। (অর্থাৎ এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হয়েছে।) যাদের মাধ্যমে রিট করা হয়েছিল তারা কেউ বিসিএস পরীক্ষা দেয়নি এ তথ্য জেনে এখলাসকে “আপনি তো সাংঘাতিক লোক” উল্লেখ করে আদালত এবং রিট খারিজ করে দেয়। রিট খারিজ হওয়ার পর শুরু হয় সেই তথাকথিত কোটাবিরোধী আন্দোলন যার ফলশ্রুতিতে সরকার কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে।
যে কেউ চাইলেই যেকোনো বিষয়ে আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে। উক্ত বিষয়ে আদালত যেকোনো রায়ও দিতে পারে। সমাধান হবে আদালতেই। কিন্তু আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কোনো শিক্ষিত সচেতন নাগরিক আন্দোলনে নামতে পারে না। আর নামলে তাকে মেধাবী দূরের কথা বিবেচক বলার সুযোগও নেই।
পৃথিবীর কোথাও কোটা বা দেশের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার নজির নেই। কোটা ব্যবস্থা প্রয়োজন সভ্য দেশের জন্য, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য। দেশ গঠনে অবদান, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, নারীর ক্ষমতায়ন, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ও প্রশাসনে আঞ্চলিক সমতা রক্ষার জন্য কোটা ব্যবস্থা প্রয়োজন। কোন শ্রেণীর জন্য কত শতাংশ কোটা প্রয়োজন তা নির্ধারণের জন্য গবেষণা ও পর্যালোচনার প্রয়োজন হয়।
যারা দেশ-বিদেশ নিয়ে ১০টি সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন করলে ২টির উত্তর দিতে পারবে না, যারা সোশ্যাল মিডিয়ার গুজবে বিশ্বাস করে প্রিলি-রিটেন পাশ করা চাকরি প্রার্থীদের অমেধাবী বলে গণ্য করে, যারা পারিবারিকভাবে মহান মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা করার শিক্ষা পেয়েছে, তাদের মাঝে সভ্য সমাজের বৈশিষ্ট্য প্রত্যাশা করি না।
কোটার বিরুদ্ধে এখন আন্দোলনে থাকা একজনের মধ্যেও মেধা দূরের কথা শিক্ষার্থী সুলভ আচরণও দেখিনি। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এখনো মাঠে থাকা কথিত আন্দোলনকারীদের কারণে বদনামের ভাগীদার হচ্ছে সত্যিকারের বিসিএস পরীক্ষার্থীরা, যাদের সঙ্গে এমন অযৌক্তিক আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই, থাকার কথাও নয়।