যুক্তরাজ্য কি ভেঙেই যাবে
গেল সপ্তাহে লন্ডনের ওয়েম্বলিতে ইংল্যান্ড বনাম স্কটল্যান্ডের ফুটবল খেলা হলো। কেউই জিততে পারেনি। অমীমাংসিত এই খেলাও স্কটিশদের কাছে জয়ের সমান। এমনটাই দাবি ব্রিটিশ মিডিয়ার। কারণ ওয়েম্বলিতে এই প্রথম স্কটিশরা ইংলিশদের তাদের জালে বল পাঠাতে দেয়নি। ইংলিশ মিডিয়ার এমন খোলামেলা প্রতিদ্বন্দ্বীর মতো আচরণ এখানে খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ। আর স্কটিশ সমর্থকেরাও কম যান না। খেলার ফল যা-ই হোক না কেন, স্বাধীন স্কটল্যান্ড বিষয়ে জেতা তাদের চাই-ই। স্লোগানে, সংগীতে আর ব্যানারে স্বাধীন স্কটল্যান্ড বিষয়ে তাঁদের চাওয়া এমনভাবেই উঠে এসেছে।
যুক্তরাজ্যের সাংবিধানিক নাম ইউনাইটেড কিংডম অব গ্রেট ব্রিটেন অ্যান্ড নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড। চারটা ভিন্ন ভিন্ন জাতি জোড়া লেগে তবেই এই দেশ। বলছি স্কটল্যান্ডের কথা। স্কটল্যান্ডের ইতিহাস গৌরবের। স্বাধীনতার। রোমানরা অনেক চেষ্টার পরও তাদের হারাতে পারেনি। এমনকি ইংলিশদের সঙ্গেও দক্ষিণ সীমান্তে তারা প্রায়ই যুদ্ধে জড়িয়েছে। ওয়েলস ১৫৩৬ সালে ইংল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়। আর স্কটল্যান্ডের সঙ্গে ইংল্যান্ডের সংযুক্তি ঘটে ১৬০৩ সালে, রানি প্রথম এলিজাবেথের মৃত্যুর পর। রাজা ষষ্ঠ জেমস ছিলেন রানি প্রথম এলিজাবেথের কাজিন। রানির মৃত্যুর পর তিনি ইংল্যান্ডের রাজাসনে বসেন। যুক্ত হয় স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ড। যদিও একই রাজা, তবু দুই দেশের আইন থেকে শুরু করে শিক্ষাব্যবস্থা ছিল পুরোপুরি আলাদা।
কয়েক দশক পর স্কটল্যান্ড প্রথম উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে নিউ ক্যালিডোনিয়ায় (বর্তমান পানামা)। উপনিবেশ স্থাপনের সেই চেষ্টা বাণিজ্যিকভাবে ভয়ংকর রকম ব্যর্থ হয়। সেই ব্যর্থতা থেকেই একটি আনুষ্ঠানিক ইউনিয়ন বা যুক্তরাজ্য গঠনের চিন্তা করা হয়। ১৭০৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় যুক্তরাজ্য নামের ইউনিয়ন। ১৯৯৭ সালে ৭৪.৩ শতাংশ স্কটিশ একটি স্বাধীন পার্লামেন্টের পক্ষে ভোট দেন। সেই থেকে স্কটল্যান্ডের কৃষি, বনজ, মৎস্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সমাজসেবা, পরিবেশবিষয়ক সিদ্ধান্ত নেয় স্কটিশ পার্লামেন্ট। অন্যদিকে স্কটল্যান্ডের অভিবাসন, পররাষ্ট্রনীতি, প্রতিরক্ষা ও কর্মসংস্থানবিষয়ক সিদ্ধান্ত নেয় ওয়েস্টমিনস্টার। মনে করা হয়েছিল, ক্ষমতার এই বিভাজন হয়তো স্কটিশদের জাতীয়তাবাদী আচরণকে নিয়ন্ত্রণ বা কমিয়ে আনতে সাহায্য করবে। কিন্তু এই বিভাজন খুব একটা কাজে আসেনি।
গত মাসে স্কটল্যান্ডে ভোট হয়ে গেছে। ভোটে সবচেয়ে বেশি আসন জিতেছে স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি বা এসএনপি। যদিও তারা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি (মাত্র একটি আসন কম পেয়েছে)। এসএনপি তাদের ইশতেহারে সোজাসুজি স্বাধীন স্কটল্যান্ড বিষয়ে আরেকটি গণভোট আয়োজনের কথা বলেছে।
ঐতিহাসিক এই ইউনিয়ন এখন আবার ভাঙনের মুখে। ২০১৪ সালের গণভোটে ভাঙন এড়ানো গেলেও আবার উঠেছে ভাঙনের সুর।
গত মাসে স্কটল্যান্ডে ভোট হয়ে গেছে। ভোটে সবচেয়ে বেশি আসন জিতেছে স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি বা এসএনপি। যদিও তারা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি (মাত্র একটি আসন কম পেয়েছে)। এসএনপি তাদের ইশতেহারে সোজাসুজি স্বাধীন স্কটল্যান্ড বিষয়ে আরেকটি গণভোট আয়োজনের কথা বলেছে। যদিও তারা হলিরুডে (স্কটিশ পার্লামেন্টের এলাকার নাম) সংখ্যাগরিষ্ঠ, তবুও এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা কি ওয়েস্টমিনস্টারের ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য যথেষ্ট?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে স্কটিশ পার্লামেন্টের ক্ষমতার নকশা বুঝতে হবে। স্কটিশরা মোট ১২৯ আসনের জন্য ভোট দেন। এর মধ্যে ৭৩টি আসন সংসদীয় এলাকার। বাকি ৫৬টি আসন স্কটল্যান্ডের ৮টি রিজিয়নকে প্রতিনিধিত্ব করে। সংসদে যাতে কেউই খুব সহজে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ছড়ি ঘোরাতে না পারে, তাই এমন জটিল ব্যবস্থা। এতসব জটিলতার ভেতরেও ২০১১ সালে এসএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। সেই জোরে তারা ২০১৪ সালে কী করেছিল, নিশ্চয় ভুলে যাননি। তো এবারও বিজয়ের পর কি তারা সেই পথে, মানে স্বাধীনতার জন্য গণভোট আয়োজনের পথে হাঁটবেন?
এই প্রশ্নেরও কোনো সোজা উত্তর নেই। তবে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যেতে পারে। ‘জিতলে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার জন্য ভোট হবে ‘এমন স্লোগান দিয়েছে এসএনপি এবং গ্রিন পার্টি। আসন জিতেছে যথাক্রমে ৬৪ ও ৮টি। ভোট পেয়েছে ১২ লাখ ৯১ হাজার ২১৪ এবং ৩৪ হাজার ৯০০। শতাংশ বিবেচনায় প্রায় ৪৯ শতাংশ। তার মানে কি স্বাধীনতার পক্ষে গণভোট আয়োজন নিশ্চিত? বা স্কটল্যান্ড কি স্বাধীন হয়ে যাবে? একই রকম দাবি-দাওয়া দিয়ে পার্লামেন্টে আসন পাওয়া এই দুই দলের অর্জন বিবেচনা করে এখনই কোনো উপসংহারে যাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, ‘স্বাধীন স্কটল্যান্ড চাই না’ বা ‘যুক্তরাজ্যেই ভালো আছি’ মন্ত্রে বিশ্বাসী কনজারভেটিভ, লেবার এবং লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের আসন ও ভোটসংখ্যা হলো যথাক্রমে ৫৯১,৯৭৮ (৩১), ৫৭৪, ৩৯৩ (২২) এবং ১৮৭,৮০৬ (৪)। মোটের হিসাবে প্রায় ৫০ %। এখানেও ১ শতাংশের ব্যবধান। কিন্তু শুধু সংখ্যার ব্যবধানের ওপর ভর করে উপসংহারে পৌঁছানোও ঠিক হবে না।
নর্দান আয়ারল্যান্ডের আইরিশদের একটা বিশাল অংশ চাইছে দুই আয়ারল্যান্ড এক হয়ে যাক। প্রায় আগুন জ্বলছে রাস্তায়। কোনো রাজনৈতিক নেতাই সুবিধা করতে পারছেন না। সেই আগুনে ঘি ঢালছে স্বাধীন স্কটল্যান্ডের চিন্তা।
স্কটিশ ইংলিশ জাতিগত তফাতের বাইরে আরও একটি জ্বলজ্বলে বিষয় হলো ব্রেক্সিট। ব্রেক্সিটের নীতিগত প্রশ্নে স্কটল্যান্ডের যুক্তরাজ্য থেকে আলাদা হতে চাওয়াটা কোনোভাবেই অযৌক্তিক নয়। কারণ ৬২ শতাংশ স্কটিশ চেয়েছিলেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে থাকতে। অন্যদিকে ৫৩.৪% ইংলিশ চেয়েছিলেন বের হয়ে যেতে। তাই নীতিগতভাবেই ইংলিশরা কোনোভাবেই স্কটিশদের জোর করে যুক্তরাজ্য নামের ইউনিয়নে ধরে রাখতে পারে না। জোরের প্রসঙ্গ আসছে কারণ, বরিস জনসন সেকেন্ড রেফারেনডামের বিষয়ে সোজাসুজি ‘না’ বলে দিয়েছেন। তার কথা হলো, সেদিনই না একটা রেফারেনডাম হলো! বারবার হবে নাকি! এ রকম রেফারেনডাম এক প্রজন্মে একটি হতে পারে, দুটি নয়।
যদিও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটা বরিসের চাওয়া। কিন্তু ইংল্যান্ডের মানুষ কী চান? গেল মাসে ‘টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি পাঁচজন ইংলিশের মাত্র একজন স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার ঘোরতর বিরোধী। তার মানে, খোদ ইংলিশদের ভেতরেই স্বাধীন স্কটল্যান্ডের ধারণা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এই অবস্থায় যদি বরিসের কনজারভেটিভ ব্রিটিশ সরকার স্কটিশ স্বাধীনতার প্রশ্নে সেকেন্ড রেফারেনডামের বিল ওয়েস্ট মিনস্টারে তুলতে না না দেয়, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীন স্কটল্যান্ডের ধারণা আরও জনপ্রিয়তা পাবে। কারণ, স্কটিশরা এটাকে দেখবেন তাঁদের মতের ওপর ইংলিশদের ক্ষমতার জোর হিসেবে।
এত হিসাবনিকাশের বাইরে একটা ষড়যন্ত্র-তত্ত্বও কিন্তু আছে। খোদ ইংলিশরাই নাকি চান, ইংল্যান্ড নামের ছোট্ট একটা দেশ। তাঁরা স্কটল্যান্ড আর চান না। চান না ওয়েলস কিংবা নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড। আর স্কটিশরা তো করও দেন কম। খরচ করেন বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে স্কটিশরা খরচ করেছেন আয়ের চেয়ে অন্তত ৮.৬ শতাংশ বেশি। ইংল্যান্ড নামের ছোট্ট দেশ হোক, লন্ডন হবে যার কর-স্বর্গ—এমনটাই নাকি চাওয়া ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলের হর্তা-কর্তা-দাতাদের।
তবে স্বপ্ন, চাওয়া-পাওয়া যা-ই হোক, যুক্তরাজ্যে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা শুরু হয়ে গেছে। নর্দান আয়ারল্যান্ডের আইরিশদের একটা বিশাল অংশ চাইছে দুই আয়ারল্যান্ড এক হয়ে যাক। প্রায় আগুন জ্বলছে রাস্তায়। কোনো রাজনৈতিক নেতাই সুবিধা করতে পারছেন না। সেই আগুনে ঘি ঢালছে স্বাধীন স্কটল্যান্ডের চিন্তা।
স্বাধীন স্কটল্যান্ড বিষয়ে স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টার্জন এখন পর্যন্ত অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। ভোট জিতেই গণভোটের হুংকার দিয়েছেন কিন্তু কোভিড-১৯ পরিস্থিতি সামলানোকে দিয়েছেন প্রথম গুরুত্ব। কারণ তিনি জানেন, কোভিড-১৯ পরীক্ষার মতো কঠিন পরীক্ষায় উতরে গেলে স্বাধীন স্কটল্যান্ডের গণভোটের পরীক্ষাটা একটু সহজই হবে।
তবে স্কটল্যান্ড স্বাধীনতা পেলে ভালো হবে, নাকি মন্দ? এটা জানতে অপেক্ষা করতে হবে আরও বহু বছর। কারণ পুরো প্রক্রিয়াই রাজনৈতিক। তাই এই প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দিতে চাই স্টিভেন ডি লেভিট এবং স্টিফেন জে ডুবনার তাদের ‘থিংক লাইক আ ফ্রিক’ বইয়ে বলেছেন, রাজনীতিকেরা যখনই ভুল-শুদ্ধ র মানদণ্ডে বিচার করে কোনো সিদ্ধান্ত নেন, তখন প্রথমেই যাকে হত্যা করা হয় তার নাম সত্য।