তাপস–খোকনের বিরোধ, পেছনে ‘ক্ষমতার লড়াই’
দুজনের বিরোধের শুরু মেয়র পদে মনোনয়নকে ঘিরে। এরপর ‘টাকার হিসাব’ নিয়ে গত জানুয়ারিতে তাঁদের বিরোধ প্রকাশ্যে আসে। শুরু হয় কথার লড়াই, চলে অনুসারীদের পাল্টাপাল্টি মিছিল-মানববন্ধন। তাঁরা দুজন হলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ও সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। দুজনের পুরোনো তিক্ততা আবার সামনে এল গতকাল মঙ্গলবার।
শুরুটা হয়েছিল গত জানুয়ারি মাসে। দলের নীতিনির্ধারকদের হস্তক্ষেপে মাঝখানে কয়েক মাস দুজনই চুপ ছিলেন। তবে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের ভিত্তিতে আদালত গত রোববার সাঈদ খোকনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও পরিবারের আটটি ব্যাংক হিসাব জব্দের আদেশ দিলে গতকাল রীতিমতো সংবাদ সম্মেলন করে তাপসের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝাড়লেন সাঈদ খোকন। দুদকের তৎপরতার পেছনে তাপসের হাত রয়েছে বলেও মনে করছেন তিনি।
অবশ্য তাপস পাল্টা জবাব না দিয়ে বিষয়টি আদালত ও দুদকের বলে এড়িয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর কমিটির একাধিক নেতা বলছেন, বর্তমান ও সাবেক মেয়রের এই পাল্টাপাল্টি অবস্থান—আসলে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বেরই বহিঃপ্রকাশ। তাপস ও খোকনের এই বিরোধ অচিরেই শেষ হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, তাপসের কাছে মেয়র পদ হারানোর বিষয়টি সাঈদ খোকন এখনো মেনে নিতে পারছেন না। অন্যদিকে সাঈদ খোকনের মেয়র থাকাকালে নেওয়া নানা সিদ্ধান্তের দোষ-ত্রুটি খোঁজার কাজও চালিয়ে যাবেন তাপস।
সাঈদ খোকনের বাবা মোহাম্মদ হানিফ ছিলেন অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র। তিনি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন দীর্ঘ সময়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন ছিলেন তিনি। বাবার মৃত্যুর পর সাঈদ খোকন ঢাকা মহানগরের নেতৃত্ব ও সিটি করপোরেশনের মেয়র—দুটিরই উত্তরাধিকারী হবেন, এমন প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু মহানগর আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে তিনি গত বছর মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন হারান বঙ্গবন্ধুর ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণির ছেলে শেখ ফজলে নূর তাপসের কাছে।
* ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও পরিবারের ব্যাংক হিসাব জব্দে দুদকের তৎপরতার পেছনে মেয়র তাপসের প্ররোচনা রয়েছে বলে মনে করছেন সাঈদ খোকন। * সাঈদ খোকনের ব্যাংক হিসাব জব্দের বিষয়টি আদালত ও দুর্নীতি দমন কমিশন–সংশ্লিষ্ট বলে উল্লেখ করেছেন মেয়র তাপস।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী বাছাই নিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নানা নাটকীয়তা জন্ম দেয়। দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ থেকে সাঈদ খোকনকেই দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়র পদে রাখার পক্ষে মত আসে। খোকনও মনোনয়ন চূড়ান্ত করার আগপর্যন্ত নিজের আশাবাদের কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু ডেঙ্গু মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, দলীয় কোন্দলে যুক্ত হওয়া, সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ—সব মিলিয়ে মনোনয়ন পাননি তিনি। তাঁর পরিবর্তে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য তাপস মনোনয়ন পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। এরপর থেকেই খোকন ও তাপসের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়।
সাংসদ পদ ছেড়ে মেয়র নির্বাচিত হয়ে ফজলে নূর তাপস গত বছরের ডিসেম্বরে গুলিস্তান এলাকায় দুটি মার্কেটে নকশার বাইরে থাকা দোকান উচ্ছেদে গেলে দুজনের ঠান্ডা লড়াই প্রকাশ্য হয়। তখন মার্কেটের দোকানদারেরা বলেছিলেন, নকশাবহির্ভূত দোকান বৈধ করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে মেয়র থাকা অবস্থায় সাঈদ খোকন তাঁদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। প্রায় ৩৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলাও করেন এক ব্যবসায়ী। এই মামলার তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন।
এর পাল্টা হিসেবে উচ্ছেদে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের নিয়ে গত ৯ জানুয়ারি হাইকোর্ট এলাকার কদম ফোয়ারার সামনে মানববন্ধন করেন সাঈদ খোকন। সেখানে সাঈদ খোকন অভিযোগ করেন, তাপস দক্ষিণ সিটির শত শত কোটি টাকা তাঁর নিজ মালিকানাধীন মধুমতি ব্যাংকে স্থানান্তর করেছেন। তাপসের উদ্দেশে সেদিন তিনি বলেন, রাঘববোয়ালদের মুখে চুনোপুঁটির গল্প মানায় না। মেয়র পদে থাকার যোগ্যতা তাপস হারিয়েছেন বলেও তখন উল্লেখ করেছিলেন তিনি।
ওই ঘটনার পর ১১ জানুয়ারি খোকনের বক্তব্য মানহানিকর উল্লেখ করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন মেয়র তাপস। অবশ্য পরে তিনি আইনি ব্যবস্থা নেননি। কিন্তু এক আইনজীবী সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে মানহানির মামলার আবেদন করেন। পরে অবশ্য ওই আবেদন খারিজ হয়ে যায়। এরপর গত জানুয়ারি মাসে সাবেক ও বর্তমান মেয়রের পক্ষে-বিপক্ষে পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ও মানববন্ধনও করেছেন তাঁদের অনুসারীরা। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের হস্তক্ষেপে দুজনই পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। একপর্যায়ে সাঈদ খোকনকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করা হয়।
তাপসের ওপর দোষ চাপালেন খোকন
ব্যাংক হিসাব জব্দে দুদকের পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এসে সাঈদ খোকন বলেন, ‘মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস নগর পরিচালনায় সীমাহীন ব্যর্থতা ঢাকতে বারবার আমার প্রতি হয়রানি ও বিদ্বেষমূলক আচরণ করে আসছেন। আমি মনে করি দুদকের এই কর্মকাণ্ড তাপসের প্ররোচনায় সংঘটিত হয়েছে।’
সংবাদ সম্মেলনে তাপসের প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বারবার ক্ষিপ্ত হয়ে যান এবং উচ্চ স্বরে কথা বলেন সাঈদ খোকন। সংবাদ সম্মেলনে তাঁর সঙ্গে আসা লোকজনও বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে তাপসের উদ্দেশে তিনি বলেন, কত শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন, তা এই শহরের মানুষ জানে। যাহোক, ক্ষমতায় আছেন, কাজ করেন। ঢাকার মরা মানুষের ওপরও ট্যাক্স বসিয়ে দিয়েছেন। কীভাবে মানুষের ভালোবাসা আশা করেন।
মেয়র তাপসকে উদ্দেশ করে খোকন বলেন, ‘নগর পরিচালনা করতে পারে না। আরও বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখো। বড় হওয়ার স্বপ্নে সাঈদ খোকন বাধা নাকি। তুমি বড় হও, আমার কী। আমাকে মেরে বড় হইতে হবে নাকি? যে দায়িত্ব পেয়েছ পালন করো, তারপর বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখো। ’
সাঈদ খোকন বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন আমার এবং আমার পরিবারের সদস্যদের কোনো নোটিশ না দিয়ে, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে সরাসরি আদালতের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা (ব্যাংক হিসাব জব্দ) জারি করেছে।’ এতে তাঁর এবং তাঁর পরিবারের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে ব্যাংক হিসাব বন্ধ থাকলে পারিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বন্ধ হয়ে যাবে উল্লেখ করে খোকন বলেন, ‘আমার সংসার পরিচালনা করা দুরূহ হয়ে যাবে।’ তদন্তের মাধ্যমে জব্দ ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দুদক তদন্ত করতেই পারে। তদন্তে আমার এবং আমার পরিবারের সদস্যদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু কারও প্ররোচনায় বা দলাদলিতে দুদক নিজেকে জড়াবে, একজন নাগরিক হিসেবে এটা আমি প্রত্যাশা করি না। ’
মা ফাতেমা হানিফের ব্যাংক হিসাবও জব্দ হয়েছে উল্লেখ করে সাবেক মেয়র খোকন বলেন, সন্দেহের বশবর্তী হয়ে একজন সম্মানী মানুষের সম্মান হানি করা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়রের স্ত্রী লাঞ্ছিত হবেন, তা ঢাকাবাসী মেনে নেবে না। এ বিষয়ে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রয়োজন হলে ঢাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে আরেকবার আন্দোলন করব। ’
তাপস কেন ব্যর্থ, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে খোকন বলেন, ‘আমি লাশ দাফন ফ্রি করে দিয়েছিলাম। আজিমপুরে গিয়ে দেখেন একটা লাশ নামানোর আগে টিকিট লাগে।’ তিনি বলেন, ‘আমি লাখ লাখ ব্যানার ফেলে দিয়েছিলাম। আজ সিটি করপোরেশন নিজের নামে ব্যানার লাগায়।’
আওয়ামী লীগের সদস্য হিসেবে দলের সভাপতি শেখ হাসিনাকে জানিয়ে এই সংবাদ সম্মেলন করছেন কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘নেত্রী যদি দেখেন এই শহরের মানুষ নিষ্পেষিত হচ্ছে, তিনি চুপ করে বসে থাকবেন? অসম্ভব।’
সংবাদ সম্মেলনটি মেয়র তাপস, আদালত নাকি দুদকের বিরুদ্ধে, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে সাঈদ খোকন বলেন, ‘আমি গতকাল (সোমবার) আদালতের আদেশের কপি পাইনি। অনেক গণমাধ্যমকর্মী টেলিফোনে আমার বক্তব্য জানতে চেয়েছিলেন। আজ আদালতের আদেশের কপি পাওয়ার পর সাংবাদিকদের উদ্দেশে প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্যই এই সংবাদ সম্মেলন।’
অভিযোগের জবাব দেননি তাপস
সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের সংবাদ সম্মেলনের পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ বিভাগ এক প্রতিক্রিয়ায় জানায়, বিষয়টি (সাঈদ খোকনের ব্যাংক হিসাব জব্দ) আদালত ও দুর্নীতি দমন কমিশনসংশ্লিষ্ট। বিচারাধীন কোনো বিষয়ে বর্তমান মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস কোনো ধরনের বক্তব্য বা প্রতি উত্তর দিতে নিরুৎসুক।
উল্লেখ্য, গত রোববার সাঈদ খোকনের তিনটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবসহ তাঁর মা ফাতেমা হানিফ, স্ত্রী ফারহানা আলম ও বোন শাহানা হানিফের মোট আটটি ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দেন আদালত।
দুদক প্রভাবিত হয়ে কাজ করে না
এদিকে সাঈদ খোকনের অভিযোগ অস্বীকার করে দুদকের সচিব মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, দুদক স্বাধীন সংস্থা, তারা প্রভাবিত হয়ে কাজ করে না। দুদক মানুষকে অযথা বা একচেটিয়া, একদিক থেকে কোনো কিছু করে না। দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা প্রয়োজন মনে করলে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন।
জব্দ করা ব্যাংক হিসাবগুলোতে মোট কত টাকা আছে, তা বলেননি দুদক সচিব। তবে সাঈদ খোকন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আটটি ব্যাংক হিসাবে ৭ কোটি ৬২ লাখ টাকার মতো রয়েছে।
দুদকের আবেদনে আদালত ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছেন উল্লেখ করে দুদক সচিব বলেন, অ্যাকাউন্টগুলো ফ্রিজ থাকবে। মনে করা হচ্ছে যে অতীতে বেশ টাকাপয়সার অস্বাভাবিক লেনদেন আছে।
এখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ না থাকায় নিজেদের মধ্যেই ক্ষমতার লড়াই হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ভাগ্যবশত দুর্নীতি–দুর্বৃত্তায়ন রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। ক্ষমতার সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের মধ্যে দুর্নীতি বেশি দেখা যাচ্ছে। এ নিয়ে বিরোধও হচ্ছে। বর্তমান ও সাবেক দুই মেয়র পাল্টাপাল্টি যেসব অভিযোগ করছেন বিভিন্ন সময়, তা তদন্ত হওয়া দরকার।