নিউইয়র্কের রাস্তায় রাজনীতির নামে দক্ষযজ্ঞ

বিদেশে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের শাখা টিকিয়ে রেখে কার কী লাভ হয়, জানা নেই। তবে এ কথায় কোনো ভুল নেই, এতে বাংলাদেশের ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ নেই।

  • ১৯৩৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিদেশি স্বার্থ রক্ষা হয় এমন সব প্রচারণা নিষিদ্ধ করে ‘ফরেন এজেন্টস রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট’ নামের একটি আইন পাস করে।
  • এই আইনে যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি এজেন্ট হিসেবে তালিকাভুক্ত না হলে কোনো দলের বা তাদের সমর্থকদের কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানো বেআইনি।
  • এই আইনের অধীনে তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হলে ২,৫০,০০০ ডলার জরিমানা ও পাঁচ বছরের জেলের বিধান রয়েছে

গত ১৮ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থকদের মধ্যে 
হাতাহাতি হয়
গত ১৮ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থকদের মধ্যে হাতাহাতি হয়

দক্ষযজ্ঞই বটে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের বাঙালি–অধ্যুষিত বিপণি এলাকা জ্যাকসন হাইটসে ১৮ সেপ্টেম্বর এক মস্ত হাতাহাতির লড়াই হয়ে গেল। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সমর্থক, অন্যদিকে বিএনপির সমর্থক। উপলক্ষ, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নিউইয়র্কে শুভাগমন। দুই পক্ষের সমর্থকদেরই গলার রগ তুলে বলতে শোনা গেল, ‘ধর ধর’। ফেসবুকে হাতাহাতির সে ভিডিও অনেকে নিশ্চয় দেখেছেন। ভাগ্যিস, হাতের কাছে টেবিল বা চেয়ার ছিল না। এর আগে ম্যানহাটনের এক পাঁচ তারকা হোটেলে দলীয় সংবর্ধনায় মাননীয় অতিথির উপস্থিতি তোয়াক্কা না করেই চেয়ার-টেবিল ভাঙা হয়েছিল। সেখানে অবশ্য দুই দল নয়, এক দলের সমর্থকেরা নিজেরাই মাঠ দখলে মত্ত হয়েছিলেন।

প্রশ্ন উঠেছে, বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের নামে যে রাজনীতি এবং রাজনীতির নামে যে কাদা–ছোড়াছুড়ি, এতে ঠিক কার স্বার্থটা রক্ষিত হচ্ছে? যাঁরা দেশ ও জাতির স্বার্থ রক্ষার নামে শুধু মুখে না মেরে হাতে মারার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন, তাঁদের অনেকেই বিদেশি (অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের) নাগরিক। ফলে বাংলাদেশে তাঁদের ভোটাধিকার নেই। বুদ্ধিমান হলে তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার রাজনীতি করতেন, তাতে আখেরে লাভের সম্ভাবনা ছিল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের বৈদেশিক শাখা হিসেবে উপাঙ্গ বা এপেন্ডিক্স হয়ে তাদের ফুটো কড়িটি লাভেরও সম্ভাবনা নেই। মানছি, নেতাগোছের যাঁরা, তাঁদের কেউ কেউ মুলোটা-কলাটা বাগিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু তাতে পাইকপাড়ার আইনুদ্দিনের কী লাভ?

এঁদের অনেকেই হয়তো জানেন না, যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি এজেন্ট হিসেবে তালিকাভুক্ত না হলে এসব দলের বা তাদের সমর্থকদের কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানো বেআইনি। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয়, বাংলাদেশেও আইন রয়েছে দেশের কোনো রাজনৈতিক দল বিদেশে তাদের শাখা বা উপদল রাখতে পারবে না। বাংলাদেশের আইন অনুসারে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধিত কোনো দলের দেশের বাইরে শাখা রাখার সুযোগ নেই। জাতীয় সংসদ নির্বাচনসংক্রান্ত আইন ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে’ রাজনৈতিক দলের ইসিতে নিবন্ধনের যোগ্যতা-অযোগ্যতার শর্তাবলির উল্লেখ আছে। তাতে বলা হয়েছে, যদি কোনো দলের গঠনতন্ত্রে দেশের ভূখণ্ডের বাইরে দল প্রতিষ্ঠা অথবা কার্যালয় পরিচালনা বা শাখা বা কমিটি গঠন করার বিধান থাকে, তাহলে ওই দল নিবন্ধনের যোগ্য বিবেচিত হবে না।

যুক্তরাষ্ট্রেও বেআইনি

আইনে যা–ই থাকুক না কেন, কে শোনে কার কথা! বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি প্রধান দলই এখানে দপ্তর খুলে বসে আছে। সারা বছর ধরে এদের কাজ একটাই, বাংলাদেশ থেকে দলের নেতারা সফরে এলে বিমানবন্দরে ঝান্ডা হাতে আগমন ও আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনার আয়োজন। এ ছাড়া পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার জন্য প্রস্তুতি ও ডাক পড়ার আগেই নেতাদের ব্যাগটা গুছিয়ে দেওয়া তো রয়েছেই। এসবই তাদের ‘জব ডেসক্রিপশন’ বা কর্তব্যতালিকার অন্তর্গত।

অথচ পুরো কাজটাই বেআইনি। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে বসে অন্য দেশের কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে প্রচার-প্রচারণা চালানো যায় না। প্রথমে আইনের কথাটা বুঝিয়ে বলি। ১৯৩৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিদেশি স্বার্থ রক্ষা হয় এমন সব প্রচারণা নিষিদ্ধ করে একটি আইন পাস করে, যার নাম ‘ফরেন এজেন্টস রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট’ বা ফারা। পরে এই আইন একাধিকবার পরিবর্তিত হয়েছে। এই আইনের মোদ্দা কথা, যুক্তরাষ্ট্রে বসে কেউ যদি অন্য কোনো দেশের পক্ষে রাজনৈতিক প্রচারণা চালায় বা তার স্বার্থ রক্ষিত হয় এমন কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত হয়, তাহলে তাকে অবশ্যই ‘ফরেন এজেন্টস’ বা বিদেশি প্রতিনিধি হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে হবে।

এই আইন গ্রহণের একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। আমরা এমন এক সময়ের কথা বলছি, যখন জার্মানিতে ক্ষমতায় আসন গেড়ে বসেছেন অ্যাডলফ হিটলার। ককেশীয় অর্থাৎ সাদা মানুষেরা শ্রেষ্ঠ, এই স্লোগান তুলে তিনি সে সময় এক মহাযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁর সে মতবাদ আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রেও এসে হাজির। এ দেশে বরাবরই শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদী রাজনৈতিক মতবাদ জনপ্রিয় ছিল। দাসপ্রথার শিকড়েই ছিল এই বিশ্বাস যে সাদা মানুষেরা কালোদের ওপর প্রভুত্ব করবে, এটা তাদের ঈশ্বরপ্রদত্ত অধিকার। জার্মানির মতো যুক্তরাষ্ট্রেও শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা হিটলারকে তাদের নতুন পথপ্রদর্শক হিসেবে স্বাগত জানাল। রাতারাতি দেশজুড়ে নাৎসি পার্টির অনুকরণে একাধিক রাজনৈতিক দল চালু হলো। এদের অন্যতম ছিল জার্মান আমেরিকান বান্ড বা জার্মান আমেরিকান ফেডারেশন। ১৯৩৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি এরা নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে যে সমাবেশের আয়োজন করে, তাতে অংশ নিয়েছিল প্রায় ২০ হাজার নাৎসিবাদী আমেরিকান। নাৎসিপন্থীদের কর্মকাণ্ডে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট প্রবলভাবে বিচলিত হয়েছিলেন। তাঁরই ব্যক্তিগত সমর্থনে ১৯৩৮ সালে ফরেন এজেন্টস রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট আইনটি মার্কিন কংগ্রেসে গৃহীত হয়।

দোষী সাব্যস্ত হলে জরিমানা

ফরেন এজেন্টস রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট আইনে চার ধরনের ব্যক্তি বা সংস্থাকে বিদেশি এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরা হলো:

১. বিদেশি সরকার,

২. বিদেশি রাজনৈতিক দল,

৩. বিদেশের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত ও বিদেশ থেকে পরিচালিত কোনো দল বা সংস্থা, এবং

৪. বিদেশি নাগরিক।

এরা যে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে কোনো প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারবে না, তা নয়। পারবে, তবে সে জন্য তাদের বিদেশি এজেন্ট হিসেবে মার্কিন বিচার বিভাগের সঙ্গে তালিকাভুক্ত হতে হবে এবং নির্ধারিত সময় অন্তর তাদের আয়-ব্যয় ও সব কার্যকলাপের হিসাব দাখিল করতে হবে। তালিকাভুক্ত এসব বিদেশি এজেন্ট আইনসম্মতভাবে কোনো বিদেশি রাষ্ট্র, সরকার বা রাজনৈতিক দলের পক্ষে লবিং করতে পারবে। কোনো মার্কিন নাগরিকও যদি বিদেশি স্বার্থ রক্ষার কাজে নিয়োজিত হয়, তাকে আইনসম্মতভাবে সে কাজের জন্য যথাবিহিত তালিকাভুক্ত হতে হবে। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সরকার অর্থের বিনিময়ে লবিস্ট নিয়োগ করেছে, যাদের প্রত্যেককে নিজেদের বাংলাদেশের পক্ষে এজেন্ট হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে হয়েছে।

বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের কোনো দল, যারা যুক্তরাষ্ট্রে তাদের বিদেশি শাখা চালু রেখেছে—এই আইন মেনে বিদেশি এজেন্ট হিসেবে তালিকাভুক্তির তাগিদ অনুভব করেনি। এই আইনের অধীনে তদন্তের ফলে দোষী সাব্যস্ত হলে ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার জরিমানা ও পাঁচ বছরের জেলের বিধান রয়েছে।

আইন রয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি সরকার বা রাজনৈতিক দলের পক্ষে প্রচার-প্রচারণা হয় না, এমন নয়। মূলত যুক্তরাষ্ট্র থেকে তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অনেকেই নানা রকম রাজনৈতিক কার্যকলাপে লিপ্ত হন। কিন্তু সরাসরি বিদেশি রাজনৈতিক দলের নামে এসব কার্যকলাপ চালানোর বদলে তাঁরা সামান্য চালাকির আশ্রয় নিয়ে থাকেন। ভারতীয় কংগ্রেস বা বিজেপির কথা ধরুন। এই দুই দলই যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন থেকে খোলামেলাভাবেই কাজ চালিয়ে আসছে। আইনি ঝামেলা এড়াতে এরা নিজেদের আসল নাম ব্যবহার না করে ‘ওভারসিজ ফ্রেন্ডস অব কংগ্রেস’ বা ‘ফ্রেন্ডস অব বিজেপি ইন ইউএসএ’জাতীয় নাম ব্যবহার করে থাকে। নিজেদের সরাসরি কোনো দলের বিদেশি শাখা না বলে তাদের বিদেশের ‘বন্ধু’ বলে চালানোর কারণে এরাও এত দিন বিদেশি এজেন্ট হিসেবে তালিকাভুক্তির প্রয়োজন দেখেনি। কিন্তু ২০২০ সালের মার্কিন নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণের অভিযোগে তদন্তের সম্মুখীন হলে ‘ওভারসিজ ফ্রেন্ডস অব বিজেপি’ নিজেদের বিদেশি এজেন্ট হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে বাধ্য হয়। যদ্দুর জানি, উপমহাদেশের এই একটি দলই মার্কিন আইন মেনে তালিকাভুক্ত হয়েছে। পাকিস্তানি দলগুলোও মার্কিন আইনের তোয়াক্কা না করে নিজেদের আদি নাম ব্যবহার করে চলেছে। যেমন পিপলস পার্টি ইউএসএ বা পাকিস্তান মুসলিম লিগ এন (বা নাওয়াজ), ইউএসএ।

কার লাভ, কার ক্ষতি

ভারত বা পাকিস্তানের কথা জানি না। তবে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর যে বৈদেশিক শাখা রয়েছে, তার সব কলকাঠি ঢাকা থেকেই নাড়া হয়। আলোচনায় আছে, কে সভাপতি হবেন, কে হবেন না, সে সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় নেতারাই নিয়ে থাকেন। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় নেতা-কর্মীদের কাছে জনপ্রিয় এমন ব্যক্তিদের বদলে ঢাকায় কেন্দ্রীয় কর্তাব্যক্তিদের নেকনজরে রয়েছেন এমন লোকদের দলীয় শাখার নেতৃত্বে রাখা হয়। এতে স্থানীয় পর্যায়ে অসন্তোষ জন্মে, সৃষ্টি হয় উপদল। এসব উপদলের সমর্থকদের মধ্যে রাগ-বিরাগ শেষ পর্যন্ত হাতাহাতি ও চেয়ার-টেবিল ভাঙায় পরিণত হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশের চিরাচরিত রাজনৈতিক ধারা অনুসরণ করে বিদেশের মাটিতে আওয়ামী লীগ-বিএনপির সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, সে তো রয়েছেই।

বিদেশে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের শাখা টিকিয়ে রেখে কার কী লাভ হয় জানি না, তবে এ কথায় কোনো ভুল নেই এতে বাংলাদেশের ক্ষতি বই লাভ কিছু নেই। পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার মতো ঘটনায় বিদেশের মাটিতে ক্ষতগ্রস্ত হয় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি। এতে বেকায়দায় পড়েন অভিবাসী বাঙালি। তারা শুধু অন্য মার্কিনদের চোখে নয়, নিজের ছেলেমেয়ের চোখেও হেয় হন। বাংলাদেশ বিষয়ে প্রকৃত গর্ববোধের বদলে এসব ছেলেমেয়ের মনে পিতা-মাতার জন্মভূমি বিষয়ে জন্ম নেয় বিরাগ ও প্রত্যাখ্যান।

এ অবস্থা বদলানো খুবই সহজ। যেহেতু নাটাইটি ঢাকার নেতা-নেত্রীর হাতে, তাঁরা চাইলে যেকোনো মুহূর্তেই বিদেশে নিজ দলের শাখা-প্রশাখা বিস্তার রোধ করতে পারেন। ঘোষণা দিয়ে জানাতে পারেন, না, বিদেশে আমাদের কোনো শাখা নেই। নিদেন পক্ষে তাঁরা যে কাজটি করতে পারেন তা হলো যুক্তরাষ্ট্রের আইন মেনে নিজ সমর্থকদের বিদেশি এজেন্ট হিসেবে তালিকাভুক্তির নির্দেশ দেওয়া। ভারতীয় উদাহরণ অনুসরণ করে নিজ দলের যুক্তরাষ্ট্রীয় শাখা গঠনের বদলে বিদেশে নিজ দলের সমর্থক বা বন্ধুদের সংগঠন প্রতিষ্ঠার কথাও ভাবতে পারেন। সবচেয়ে বড় যে কাজটি তাঁরা করতে পারেন তা হলো, লেজুড়জাতীয় ব্যক্তিদের বদলে যোগ্য ও বুদ্ধিমান লোককে এসব সংগঠনের দায়িত্ব দিতে পারেন। তাতে হয়তো প্রকাশ্যে এমন হাতাহাতির ঘটনা কমলেও কমতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *