তালেবান প্রশ্নে বিএনপির নীরবতা কৌশল, না অতীতকে দূরে রাখা?

বিএনপি
বিএনপি

মধ্য আগস্টে তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করল। শুরু হলো বিশ্বজুড়ে তোলপাড়। উপমহাদেশেও উত্তাপ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ নিয়ে কম কথা হয়নি। মূলধারার প্রায় সব রাজনৈতিক দল যার যার মতো কথা বলেছে এ নিয়ে। ব্যতিক্রম বিএনপি। এখন পর্যন্ত দলটি এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। এর মধ্যে স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়েছে। সেখানকার আলোচ্য বিষয় নিয়ে দলীয় মহাসচিব কথাও বলেছেন গণমাধ্যমে। কিন্তু তালেবান প্রশ্নে দলের অবস্থান নিয়ে কিছু বলেননি তিনি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ একাধিক ও নেতা-নেত্রীর বিষয়টি নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো উত্তর নেই। ‘মনে হয় বলা হয়ে গেছে’, ‘পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে’ ইত্যাদি মন্তব্য করেছেন একাধিক নেতা। কেউ কেউ এই ইস্যুতে ব্যক্তিগত মতও প্রকাশ করতে রাজি নন।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, তালেবানের সাম্প্রতিক উত্থানের বিষয়টি নিয়ে বিএনপি একধরনের দোটানার মধ্যে আছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা সমীকরণের ফলে এ দোটানার সৃষ্টি হয়েছে। তাই দলটি নীরবতাকে বাহ্যজ্ঞান করেছে।

আফগানিস্তান ও তালেবানের বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলীয় মহাসচিবের তো এ নিয়ে কথা বলার কথা। উনি বলেননি? আমরা তো আলোচনা করেছি।’

কী আলোচনা করেছেন, সে বিষয়ে কিছু জানাতে চাননি বিএনপি নেতা গয়েশ্বর রায়।

১৮ সেপ্টেম্বর বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। এরপর ওই বৈঠকের আলোচ্য বিষয় নিয়ে সাংবাদিকদের জানান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে তিনি তালেবান প্রশ্নে কোনো বিষয় বৈঠকে আলোচনা হয়েছে বলে উল্লেখ করেননি।

তালেবানের উত্থান নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। রিজভী বলেন, ‘এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। আমি ঠিক এ মুহূর্তে এ বিষয়ে বলতে আগ্রহী নই।’

তালেবান প্রশ্নে বিএনপির নীরবতা নিয়ে দলটির আন্তর্জাতিক সম্পাদক রুমিন ফারহানার বক্তব্য হলো, ‘আমরা আসলে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। আফগানিস্তানে এখনো কোনো স্থায়িত্বশীল সরকার আসেনি।’

তালেবান প্রশ্নে বিএনপির নীরবতার একাধিক কারণ আছে বলে মনে করেন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ উদ্দিন আহমদ। তাঁর মতে, আফগানিস্তানে মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও তাঁর মিত্র যুক্তরাজ্যের পরাজয় ঘটেছে বা সার্বিকভাবে পশ্চিমা বিশ্বেরই একটি পরাজয়। বিএনপির কোনো আচরণ বা মন্তব্য যদি তালেবানের পক্ষে যায়, তবে এসব শক্তি তাদের ওপর নাখোশ হতে পারে। এসব দেশের প্রভাব তো রয়েছেই। তার চেয়ে বড় কথা, দুটি দেশে বিএনপির প্রথম সারির বেশ কয়েকজন রাজনীতিক থাকেন। খোদ বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘ সময় ধরে যুক্তরাজ্যপ্রবাসী। বিএনপি এসব নেতার নিরাপদ জীবনযাপনকে কোনোভাবেই সমস্যায় ফেলতে চাইবে না।

২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তাদের সরকারে সঙ্গী ছিল জামায়াতে ইসলামী। এ ছাড়া আরও কিছু ইসলামি দলের সঙ্গে তাদের সখ্য ভাব ছিল। সে সময় দেশজুড়ে জঙ্গিবাদী নানা তৎপরতা শুরু হয়। ‘আমরা হব তালেবান, বাংলা হবে আফগান’-জাতীয় স্লোগানের উচ্চারণ সে সময়ই হয়।

অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘বিএনপি হয়তো এখন তালেবান প্রশ্নে কোনো মন্তব্য করে এমন অবস্থান তৈরি করতে চাইবে না, যাতে মানুষের এসব পুরোনো কথা মনে পড়ে।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম তাঁর আগের এক পর্যবেক্ষণের সূত্র উল্লেখ করে বলেন, ১৯৮২ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মদদে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির সারা দেশে দ্রুত শক্তি বাড়াতে সমর্থ হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান পরিচালিত আফগান যুদ্ধে বাংলাদেশ থেকে যে শত শত ‘মুজাহিদ’ পাঠানো হয়, তাতে এখানকার ধর্মীয় সংগঠনগুলোর সক্রিয় ভূমিকা ছিল।

বিএনপি সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াতের সঙ্গে একটু দূরত্ব বজায় রাখার নীতি নিয়েছে বলেই মনে হয়। তালেবান প্রশ্নে বেশি উচ্চবাচ্য করলে পাছে আবার সেই অতীত স্মৃতি স্মরণ হয়ে যায়, এ ভয় আছে বিএনপির।

গয়েশ্বর রায়ের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে কথা বলব না।’

বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পাদক রুমিন ফারহানার কথা, ‘আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য নানা রকমের কৌশল নেয়। জামায়াতের সঙ্গে বা অন্য ইসলামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে আমাদের কোনো আদর্শিক নৈকট্য নেই। এটা ছিল ভোটের জোট। এটা শুধু বিএনপি করেনি, আওয়ামী লীগও করেছে। হেফাজতের সমস্ত দাবি আওয়ামী লীগকে মানতে দেখেছি। এসব একেবারেই ভোটের হিসাব-নিকাশ। এখানে আদর্শের কিছু আছে বলে মনে হয় না।’

ভোটের এই হিসাব-নিকাশ দেশের রাজনীতির জন্য ভালো কিছু হয়নি বলেই মনে করেন এই তরুণ আইনজীবী রাজনীতিক।

তালেবান প্রশ্নে বিএনপির এই নীরবতা যৌক্তিক বলেই মনে করেন কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম মতিনুর রহমান। তিনি বিএনপিঘনিষ্ঠ এবং দলটির রাজনীতির বিশ্লেষক। মতিনুর রহমান বলেন, আফগানিস্তান পরিস্থিতি এখনো টালমাটাল। সেই পরিস্থিতি নিয়ে বিএনপি কথা না বলে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে। আর সেটাই যৌক্তিক।’

মতিনুর রহমান মনে করেন, ভূরাজনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টেছে। আর সেটা বুঝে বিএনপিকে কুশলী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

তালেবান নিয়ে ইতিবাচক কিছু বললে জামায়াত বা ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে অতীত সম্পর্ক আবার সামনে আসার ভয় বিএনপির আছে কি না? প্রশ্নের জবাবে মতিনুর রহমান বলেন, ‘এমন এক ধারণা বিএনপির থাকতে পারে।’

বিএনপি এখন তালেবান নিয়ে কিছু বলছে না রাজনৈতিক দোটানা অবস্থার জন্য। এ অবস্থাকে মার্কিন রাজনীতিতে আচরিত ‘ডোন্ট আসক ডোন্ট টেল’ নীতির মতো বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার। মানে হলো, কিছু জিজ্ঞাসা কোরো না, কিছু বোলো না। কোনো স্পর্শকাতর বা বিতর্কিত বিষয় নিয়ে না সমর্থন করা, না বিরোধিতা করা—বিষয়টি এমন।

অধ্যাপক শান্তনু বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন এভাবে, তালেবানের ক্ষমতা দখল নিয়ে জটিল পরিস্থিতিতে পড়েছে বিএনপি। যদি তারা সমর্থন দেয় বা আহ্বানও জানায় সমর্থন দেওয়ার জন্য, তবে পশ্চিমা বিশ্ব এতে অখুশি হবে, তা ভালো করেই জানে বিএনপি। এতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও বিচ্ছিন্ন হওয়ার শঙ্কা আছে দলটির। কিন্তু যদি আবার ভোটব্যাংকের দিকে তাকানো যায়, তাহলে তাদের সমর্থকদের একটি অংশ উল্লসিত। এ অবস্থায় এই নীরবতা সেসব সমর্থক বা ভোটারকে হতাশ করছে। বিএনপি হয়তো দীর্ঘদিন তাদের ভোটারদের অসুখী রাখতে পারবে না। এই দুইয়ের দোলাচলে তাদের রাজনীতির সমীকরণ কী হবে, সেটা বলা মুশকিল।

এর পাশাপাশি অধ্যাপক শান্তনু মনে করেন, আফগান প্রশ্ন বিএনপির জন্য যতটা জটিল, ততটাই সহজ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছে। তাঁর ভাষায়, ‘আওয়ামী লীগের কাছে তালেবান প্রশ্নটি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের কমন পড়া সবচেয়ে সহজ প্রশ্নটির মতো। তারা নিশ্চিতভাবেই তালেবানের বিপক্ষে থাকবে। দলীয় মতাদর্শিক বিচারেই তারা এটা করবে। শুধু মতাদর্শিক কারণেই নয়, রাজনৈতিক লাভের বিচারেও তারা এই বিরোধিকা করবে। কারণ এতে তাদের ভোটের বাজারে ক্ষতি হবে না। আবার এই বিরোধিতা করে আন্তর্জাতিক পরিসরেও সুবিধা আছে। সেটা শাসক দল হাতছাড়া করতে চাইবে না।’

শাসক দলের একাধিক নেতা কিন্তু সরাসরিই বিএনপিকে তালেবান নিয়ে খোঁচা দিয়ে যাচ্ছেন। সর্বশেষ গত রোববার আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় আসায় এই বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত, ধর্মান্ধরা ভেতরে-ভেতরে খুব উৎফুল্ল। তারা আশায় রয়েছে সেখান থেকে টাকা আসবে, অস্ত্র আসবে আর দেশে তারা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাদের সব ষড়যন্ত্র ও অপতৎপরতা শক্ত হাতে মোকাবিলা করবে।
আব্দুর রাজ্জাকের এ বক্তব্যের বিষয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আব্দুর রাজ্জাক কৃষিমন্ত্রী। উনি কৃষি উপকরণ বিলাতে গেলেও বিএনপির কথা বলেন, করোনার টিকা দিতে গেলেও বিএনপির সমালোচনা করেন। তাঁদের দলের সব নেতার একই অবস্থা।’

আলালের কথা, বিএনপি কোনো দোটানায় নেই। আর উৎফুল্ল হওয়ার মতো কোনো বিষয় নেই।

বিএনপির নেতারা প্রকাশ্যে তালেবান প্রশ্নে কিছু না বললেও বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রকাশ্যেই তালেবানের সরকারকে সমর্থন করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তালেবান ক্ষমতায় আসার পরপরই আগস্ট মাসেই এ আহ্বান জানান তিনি।

মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল অবশ্য এ বক্তব্যকে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ব্যক্তিগত মন্তব্য বলে চিহ্নিত করেন।

তালেবান প্রশ্নে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অবস্থান হলো এখনই এ সরকারকে স্বীকৃতি নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *