ক্লাস শুরুর পর উত্তাল ঢাবি ক্যাম্পাস
গত ১৭ অক্টোবর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সশরীরে ক্লাস শুরু হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন ইস্যুকে সামনে নিয়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে ক্যাম্পাসজুড়ে। ক্লাস শুরুর পর ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ইস্যুতে রাজপথে দেখা গেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে। প্রতিদিন ক্যাম্পাসের কোথাও না কোথাও দলীয় কর্মসূচি হচ্ছে কিংবা শোনা যাচ্ছে নানান রকম স্লোগান।
ক্লাস শুরুর প্রথম দিনই (১৭ অক্টোবর) সকাল ১০টায় দেড় বছর পর মধুর ক্যান্টিনে আসে ছাত্রদলের তিন শতাধিক নেতাকর্মী। একই সময়ে সেখানে অবস্থান করছিলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও। ভেতরে বসার জায়গা না পেয়ে বাইরে অবস্থান নেন তারা। দুই দলের নেতাকর্মীরা পাল্টাপাল্টি স্লোগান দিতে থাকলে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কিছুক্ষণ পর ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা সেখান থেকে বেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে ডাচের সামনে সমাবেশ করেন। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ফজলুর রহমান খোকন। তিনি বলেন, ছাত্রদল একটি সুশৃঙ্খল সংগঠন। স্বাভাবিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আমরা এখানে এসেছি। আমরা প্রতিদিন নিয়মিত এখানে আসব এবং সাহসিকতার সাথে আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করব।
একই সাথে সেদিন পুরো ক্যাম্পাসে সারা দেশের সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে মিছিল ও সমাবেশ করে ছাত্রলীগ। অভিন্ন দাবিতে প্রগতিশীল বাম গণতান্ত্রিক জোটভুক্ত ছাত্রসংগঠনগুলো সম্মিলিত ও আলাদাভাবে মিছিল-সমাবেশ করে। সন্ধ্যায় কুমিল্লায় হিন্দুদের দুর্গামন্দিরে হামলার প্রতিবাদে মৌন প্রতিবাদ সমাবেশ করে টিএসসির অন্তর্ভুক্ত সব সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। তারা সবাই সরকারের কাছে দোষীদের শাস্তির দাবি জানান।
১৭ অক্টোবর রাতে রংপুরের পীরগঞ্জের মাঝিপাড়ায় (হিন্দুপল্লী) ফের হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটলে আবারো বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ঢাবি ক্যাম্পাস। বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে নেমে আসে রাস্তায়। একই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে চলাচলকারী একটি ট্রাকের ধাক্কায় দু’জন শিক্ষার্থী আহত হলে শিক্ষার্থীরা বেশ কিছুক্ষণ রাস্তা অবরোধ করে রাখেন এবং ক্যাম্পাসের ভেতরে বহিরাগত ও ভারী যান চলাচল নিষেধাজ্ঞার দাবি জানান। অবরোধের ফলে ক্যাম্পাসে আবারো উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।
রংপুরে অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে আবারো ১৮ অক্টোবর সোমবার সকালে জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে শাহবাগে অবস্থান নেয় এবং শাহবাগের রাস্তা টানা চার ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে। ফলে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয় শাহবাগ এলাকায়। এ সময় অবরোধকারী শিক্ষার্থীদের সাথে যোগ দেন আশপাশের এলাকার সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষজন। প্রশাসনের আশ্বাসে শেষ পর্যন্ত তারা অবরোধ তুলে নেন। একই দাবিতে সারা দিন ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ মিছিল করে ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন।
বিকেলে একই সময়ে স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্যের সামনে ছাত্রলীগের আয়োজনে শেখ রাসেলের জন্মদিনের কর্মসূচি, টিএসসিতে ছাত্র অধিকার পরিষদের সম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ ও সমাবেশ এবং পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে বাম ছাত্রসংগঠনের মিছিল প্রদক্ষিণ করতে দেখা যায়। ফলে উত্তেজনাকর একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়। একই সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি হওয়ায় পাল্টাপাল্টি স্লোগানে ভরে ওঠে ক্যাম্পাসের আকাশ। যার ফলে সংঘর্ষের মতো ঘটনারও আশঙ্কা তৈরি হয়। সন্ধ্যার পর একে একে ছাত্র ও অন্য সংগঠনগুলো ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে শুরু করে।
গতকাল মঙ্গলবারও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতির পরিবর্তন দেখা যায়নি। সকাল ৯টায় বিভিন্ন হল থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড হাতে ক্যাম্পাসে জড়ো হতে থাকেন। সম্প্রীতি রক্ষার নানা স্লোগানে মুখরিত হতে থাকে ক্যাম্পাস। গতকাল শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকরাও সাম্প্রদায়িক হামলার বিরুদ্ধে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্যের সামনে শিক্ষকদের সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির ব্যানারে তারা মানববন্ধনটি করেন। এ সময় সমিতির সভাপতি ড. রহমতুল্লাহর সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মোহাম্মদ আখতারুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদ, ইনস্টিটিউটের শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন। নাট্যকলা বিভাগের আয়োজনে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী একটি নাটকও সেখানে পরিবেশিত হয়। দুপুর ১২টায় প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে মধুর ক্যান্টিন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সমাবেশ করেন।
সারা দেশব্যাপী হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ঘরবাড়িতে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে ও দোষীদের বিচার দাবিতে বেলা সাড়ে ৩টায় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের (ইশা) সমাবেশ করার কথা থাকলেও একই সময়ে ছাত্রলীগের জগন্নাথ হলসহ কয়েকটি হলের কর্মীরা সেখানে এসে আগেভাগেই সমাবেশ করা শুরু করে, যার ফলে ইশা ও তাদের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। পরে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ইশার নেতাকর্মীরা টিএসসির জনতা ব্যাংকের সামনে থেকে মিছিল বের করে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে দোয়েল চত্বরে এসে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন। পুলিশ ও প্রক্টরিয়াল টিমের অনুরোধে তারা দ্রুত সমাবেশ শেষ করে সেখান থেকে চলে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের এমন পরিস্থিতিতে বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে টহলরত দেখা গেছে পুলিশের একাধিক টিমকে। যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য কী ব্যবস্থা নেয়া হবে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, প্রথম কথা হলো, বিশ্ববিদ্যালয় কোনো সভা-সমিতি করার জায়গা না। যারা ছাত্রদের সুবিধার জন্য কাজ করবে তাদের আমরা সবসময় সাহায্য করব। যদি কেউ অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটায় তাহলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনানুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা গ্রহণ করব।