ইউক্রেন সংকট সমাধানে ফ্রান্স-জার্মানি কেন মরিয়া
কয়েক মাসের সামরিক আয়োজন এবং কয়েক সপ্তাহের নিবিড় কূটনীতির পর ইউক্রেন সংকট একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছে। এটি এখন সামরিক সংঘাতের দিকে যেতে পারে আবার আলোচনায়ও সমাধান আসতে পারে। যা-ই ঘটুক, এর মূল্য দেওয়া লাগতে পারে ইউক্রেন ও বাকি ইউরোপকে। ফলে তাদেরই শান্তির জন্য বড় ছাড় দিতে হবে এবং যুদ্ধ হলে অধিকতর ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।
ঠিক এই কারণে, ইউক্রেন ইস্যুতে যখন রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র মুখোমুখি, তখন তাদের চেয়েও এই সংকট নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করছে ইউরোপের দুই শীর্ষ শক্তি ফ্রান্স ও জার্মানি। তারা সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং পারমাণবিক পরাশক্তিগুলোর মধ্যে দূরত্ব ঘুচিয়ে সেতুবন্ধ তৈরি করতে চায়। ক্রেমলিনকে সন্তুষ্ট এবং হোয়াইট হাউসকে ক্ষুব্ধ না করেই কাজটি করতে চায় ফ্রান্স ও জার্মানি।
একটি জায়গায় ইউরোপ একমত। যদি ইউক্রেনে হামলা চালানো হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের মতোই ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু ওয়াশিংটনের পথে না হেঁটে ব্রাসেলস চাচ্ছে হুমকি ও আলটিমেটামকে এড়িয়ে চলতে। ফলে ইউরোপীয় জোটটি ইউক্রেনের সীমান্ত থেকে সামরিক চাপ সরিয়ে নেওয়া এবং শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য একটি কূটনৈতিক রোডম্যাপ গ্রহণ করার জন্য রাশিয়ার প্রতি অনুরোধ জানানোর ওপরই বেশি জোর দিচ্ছে। ফ্রান্স ও জার্মানি বিশ্বের তৃতীয় ও চতুর্থ বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ। তার পরও তারা এখন পর্যন্ত ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানো থেকে বিরত রয়েছে, যাতে মস্কোকে উসকে দেওয়া বা ক্ষুব্ধ করার মতো পরিস্থিতি এড়ানো যায়।
এই পরিস্থিতি আবারও দুটি মহাদেশীয় শক্তিকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিরুদ্ধে মতবিরোধে ফেলে দিয়েছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এরই মধ্যে ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহকারী হতে উৎসাহিত হয়েছে, যেখানে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন তাঁর পূর্বসূরি টনি ব্লেয়ারের পদাঙ্কই অনুসরণ করছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্টের নিজস্ব ইংলিশ পুডল (পোষা কুকুর) হয়ে।
প্যারিস ও বার্লিন প্রমাণ করেছে যে ওয়াশিংটন ও লন্ডন ভুল করছে এবং ইরাক আগ্রাসনের প্রত্যাঘাত পশ্চিমা ঐক্য, নিরাপত্তা ও বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য সম্পূর্ণ দুঃস্বপ্ন ছিল। তার পরও বাইডেন প্রশাসন মনে করে, যে ভুলটির পুনরাবৃত্তি হওয়া উচিত নয় সেটি হচ্ছে এটি ইরাক নয়, বরং ভুলটি হলো ‘জর্জিয়া ভুল’। কারণ ‘কোনো প্রতিরোধ না করায়’ রাশিয়া ২০০৮ সালে জর্জিয়া আক্রমণ করে এবং ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে সংযুক্ত করে নেয়। এই অ্যালার্ম বাড়িয়ে দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চান না যে পশ্চিমা দেশগুলো বা ন্যাটো আবারও পাহারার বাইরে থাকুক। কারণ তাঁর মতে, ‘পুতিনের কোনো আত্মা নেই’ এবং এ জন্য তাঁকে বিশ্বাস করা যায় না।
এর বিপরীতে আরো বাস্তববাদী ইউরোপীয়রা। বিশেষ করে জার্মানরা রুশ আত্মা ও মানসিকতা নিয়ে ভাবে না; তারা রাশিয়ার গ্যাস ও পারমাণবিক অস্ত্রের কথা চিন্তা করে। পুরো ইউরোপই মূলত রাশিয়ার জ্বালানির উৎসর ওপর নির্ভরশীল এবং এর পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের একটি স্বল্প পরিসীমার মধ্যে অবস্থিত। আবার ইইউ রাশিয়ার বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদারও বটে, যা তার মোট বাণিজ্যের এক-তৃতীয়াংশের বেশি।
এ প্রেক্ষাপটেই ফ্রান্স ২০০৮ সালে রাশিয়া ও জর্জিয়ার মধ্যে যুদ্ধবিরতিতে সহায়তা করেছিল এবং রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে মুখোমুখি আলোচনার সুবিধার্থে জার্মানিকে সঙ্গে নিয়ে ২০১৪ সালে ‘নরম্যান্ডি ফরম্যাট’ প্রতিষ্ঠা করেছিল, যা ইউরোপে নিরাপত্তা ও সহযোগিতা সংস্থার (ওএসসিই) কাঠামোর মধ্যেই মিনস্ক চুক্তির পথ প্রশস্ত করেছিল।
প্রকৃতপক্ষে রাশিয়ার ব্যাপারে পশ্চিমারা দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে ঐক্যবদ্ধ নয়, এমনকি ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ হলেও নয়। তাই ক্রেমলিন তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পশ্চিমা মতানৈক্যকে কাজে লাগাচ্ছে, যার শুরুটা করেছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অঞ্চল থেকে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার ১৬ বছর পর ২০০৭ সালে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে এক যুগান্তকারী ভাষণে পুতিন তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘সব উপায়ে’ রাশিয়ার জাতীয় সীমানা অতিক্রম করার জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন। এ জন্যই ১৫ বছর ধরে জর্জিয়া থেকে সিরিয়া পর্যন্ত পুতিনের কৌশলের যৌক্তিকতা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করা।
ইউক্রেনের জন্য ইউরোপ সহায়ক হতে পারে, কিন্তু শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই রাশিয়াকে ন্যাটোর সম্প্রসারণ, ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় গ্যারান্টি দিতে পারে। সম্ভবত এই চিন্তা থেকেই রাশিয়া এখন বলছে যে তারা সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহার করছে, যা তার নিজের ভাষায় একটি সম্ভাব্য কূটনৈতিক পথ খোলার ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা পশ্চিমকে আরো বিভক্ত করতে পারে।
বাইডেন এখন পর্যন্ত পুতিনের মূল নিরাপত্তা দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি নিশ্চিত যে রাশিয়ার ওপর আরো চাপ সৃষ্টি করতে হবে এবং ফল যা-ই হোক না কেন, ইউরোপীয়রা কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের সব পরিকল্পনা পরিত্যাগ করবে এবং রাশিয়া ও তার নতুন সেরা বন্ধু চীনের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্টে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেছনে থাকবে। এর নগদ লাভ হচ্ছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটোকে একদা অপ্রাসঙ্গিক বা ‘ব্রেনডেড’ ভাবা হলেও এটি এখন পুতিনের আগ্রাসী নীতির কারণে পশ্চিমা নিরাপত্তা কেন্দ্রে ফিরে এসেছে।
এ অবস্থায় দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মধ্যে চাপা পড়ে এবং নিজেরা বিভক্ত হয়ে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের পর তৃতীয় শক্তি হওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা ইউরোপের রয়েছে, সেটি দূরের স্বপ্নে পরিণত হতে দেওয়া তাদের উচিত হবে না।
সূত্র : আলজাজিরায় প্রকাশিত নিবন্ধের ভাষান্তর
লেখক : আন্তর্জাতিক বিষয়ক লেখক এবং আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব প্যারিসের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক