শোকে শেষ সুদিনের স্বপ্ন
চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমিতে হাদিসুর রহমানকে ভর্তি করতে ২০১৪ সালে জমি বন্ধক রেখেছিলেন বাবা মো. আব্দুর রাজ্জাক। ২০১৮ সালে থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজে যোগ দেওয়ার পর থেকে সুদিন ফেরার আশায় ছিলেন পরিবারের সদস্যরা। হাদিসুরের বিয়ে ঠিক ছিল।
বুধবার ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা ১০ মিনিটে বাংলাদেশি পণ্যবাহী জাহাজ ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’তে গোলা আঘাত হানে।
মারা যান হাদিসুর (২৮)। নিমেষেই ধূলিসাৎ হয়ে যায় হাদিসুরের পরিবারের সব স্বপ্ন। সেখানে এখন চলছে মাতম।
স্বজনরা জানান, হাদিসুর সর্বশেষ বাড়িতে এসেছিলেন মাস ছয়েক আগে। পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল তাঁর। বুধবার সকালেও বাড়িতে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন হাদিসুর। স্বজনদের বলেছিলেন, আটকে থাকা জাহাজ ছাড়া পেলে শিগগিরই বাড়ি ফিরবেন। আর আগামী ঈদের সময় বাড়ি ফিরলে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।
হাদিসুর বরগুনার বেতাগী উপজেলার কদমতলা গ্রামের বাসিন্দা ও দক্ষিণ বেতাগী নাদেরিয়া দাখিল মাদরাসার অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে। মা আমেনা বেগম গৃহিণী। হাদিসুর সম্পর্কে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাকসুদুর রহমান ফোরকানের চাচাতো ভাই। হাদিসুরের মেজো ভাই তরিকুল ইসলাম পটুয়াখালী সরকারি কলেজের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী। ছোট ভাই গোলাম মাওলা ঢাকার কবি নজরুল কলেজের স্নাতক শিক্ষার্থী।
স্বজনরা জানান, হাদিসুরের বাবা একটি মাদরাসায় চাকরি করতেন। ওই মাদরাসা থেকে যতটুকু বেতন পেতেন তা দিয়ে তিনি তাঁর তিন ছেলে ও এক মেয়েকে লেখাপড়া করান। আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে হাদিসুর এসএসসি ও এইচএসসি পাস করার পর মেরিন একাডেমিতে ভর্তি হন। এ জন্য সে সময় আব্দুর রাজ্জাক জমি বন্ধক রেখেছিলেন। হাদিসুরের বড় বোন সানজিদা আক্তার পটুয়াখালী হাসপাতালে নার্স হিসেবে কর্মরত।
গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর ছুটিতে বাড়িতে এসেছিলেন হাদিসুর। বাড়িতে অসুস্থ মা-বাবার চিকিৎসা করান। সে সময় মা-বাবাকে জানান, ঈদের আগেই বাড়িতে ঘর তোলা হবে। ঈদের পরই মা-বাবার পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে করবেন।
স্বজনরা জানান, বুধবার জাহাজ থেকে ছোট ভাই গোলাম মাওলা প্রিন্সকে ফোন করেন হাদিসুর। তবে বিকট শব্দের কারণে কিছুই শুনতে পারেননি তিনি।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম হাদিসুরকে হারিয়ে বাবা আব্দুর রাজ্জাক বাকরুদ্ধ। মা আমেনা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। মেজো ভাই তরিকুল কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার বৃদ্ধ মা-বাবাকে কে দেখাশোনা করবে? পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম আমার ভাইয়া, সে আমাদের ছেড়ে চলে গেল। এখন আমরা কিভাবে পড়াশোনা করব?’
আমেনা বেগম বলেন, ‘বুধবার হাদিস আমাকে ফোন দিয়েছিল। ডাক্তার দেখিয়েছি কি না জানতে চেয়েছে। এরপর সর্বশেষে ভিডিও কলে কথা হয়। রাতে তার মৃত্যুর খবর পাই।’
বেতাগী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুহুদ সালেহীন বলেন, ‘এরই মধ্যে লাশ উদ্ধার হওয়ার খবর পেয়েছি। তাঁকে ওই জাহাজেই হিমঘরে সংরক্ষিত করা হয়েছে এবং পরিবার যাতে লাশ তাড়াতাড়ি ফিরে পায় তার ব্যবস্থা সরকার করবে।’
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মাকসুদুর রহমান ফোরকান বলেন, ‘এরই মধ্যে বৈদেশিক কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে কথা বলা হয়েছে। দ্রুততম সময়ে পরিবার যাতে লাশ ফিরে পায় স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা প্রশাসক সে চেষ্টা করছেন।’