ভর্তুকি ও মূল্যস্ফীতিই চ্যালেঞ্জ
আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে মোট ব্যয়ের আকার ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি চলতি বাজেটের তুলনায় ৭৪ হাজার ৩ কোটি টাকা বেশি। নতুন বাজেটের আকার জিডিপির ১৫.৪ শতাংশ।
প্রাপ্তির অঙ্কে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। আয় ও ব্যয়ের ব্যবধানে মোট ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৪৪ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। যা জিডিপির ৫.৫ শতাংশের মধ্যে রাখা হয়েছে।
এছাড়া ভর্তুকি ও প্রণোদনায় বরাদ্দ থাকছে ৭২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। এটি চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৩ হাজার ৯২০ কোটি টাকা বেশি। এ বছর ভর্তুকিতে বরাদ্দ আছে ৫৮ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা।
রোববার আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হারসংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের ভার্চুয়াল বৈঠকে প্রস্তাবিত বাজেট চূড়ান্ত করা হয়েছে। ভর্তুকির ব্যবস্থাপনা ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাই আগামী বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ-এমন মন্তব্য সরকারসংশ্লিষ্টদের।
সূত্র জানায়, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে বলা হয়, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে।
এর প্রভাবে দেশে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারের ভর্তুকির অঙ্ক লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে গিয়ে ভর্তুকির অঙ্ক বাড়িয়ে মোকাবিলা করা হবে।
পাশাপাশি সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে করোনা মহামারি ঢেউয়ের ধাক্কা অনেকটা কাটিয়ে ধীরে ধীরে ছন্দে ফিরছে অর্থনীতি। এ ধারাকে ধরে রাখতে প্যাকেজের বাকি অর্থের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে বাজেটে।
যা অর্থনীতিকে চাঙা করে প্রবৃদ্ধির নতুন লক্ষ্যমাত্রা ৭.৫ শতাংশ অর্জনের ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, প্রতিবছর বাজেটে সরকারি ব্যয়ের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়, সেটি বর্তমান জিডিপির অনুপাতের তুলনায় কম।
এক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ কিংবা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আকার বাড়িয়ে সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে। এছাড়া রাজস্ব আহরণ এখনো জিডিপির অনুপাতে বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় আমাদের কম। এটি আরও বাড়াতে হবে। ঘাটতি বাজেট জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে রাখতে হবে।
এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি চাকরি উপযোগী শিক্ষা কারিকুলাম তৈরি করে এর মান বাড়ানো দরকার।
সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, আগামী বাজেটে মূল চ্যালেঞ্জ হবে প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির মধ্যে ব্যালেন্স করা। আমরা কি উচ্চ প্রবৃদ্ধির দিকে যাব, না উচ্চ প্রবৃদ্ধি কমিয়ে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে রাখার দিকে যাব, সেটি ঠিক করতে হবে।
তবে জিডিপির হার সামান্য কম হলে ক্ষতি হবে না। কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেখে জনজীবনে স্বস্তি আনা জরুরি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জোর দিতে হবে বাজেটে।
সূত্র জানায়, অর্থ বিভাগ ধারণা করছে আগামী বছরে অর্থনীতি আরও চাঙা হবে। করোনার কারণে অর্থনীতির আকাশে যে ‘কালো মেঘ’ ছিল সেটিও কেটে যাবে। আরও চাঙা হবে ব্যবসা-বাণিজ্য।
যে কারণে আসন্ন বাজেটে প্রস্তাবিত মোট রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এটি চলতি বাজেটের চেয়ে ৪৪ হাজার কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা।
নতুন বাজেটে এনবিআর কর বাবদ আয় ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা, নন-এনবিআর বাবদ ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং কর ছাড়া রাজস্ব (এনটিআর) বাবদ আদায় করা হবে ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্র জানায়, এই রাজস্ব আহরণের জন্য নতুন করে করের বোঝা জনগণের ওপর চাপানো হবে না। এক্ষেত্রে কর আহরণের নতুন নতুন ক্ষেত্র অনুসন্ধান করা হবে। করের আওতা বাড়িয়ে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা হবে।
নতুন বাজেটে মোট ব্যয় ও আয়ের ব্যবধান অর্থাৎ ঘাটতি বাজেট জিডিপির ৫.৫ শতাংশের মধ্যে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। টাকার অঙ্কে এ ঘাটতি (অনুদানসহ) ২ লাখ ৪৪ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা।
যদিও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী অর্থনীতি ভালোর জন্য এটি ৫ শতাংশের মধ্যে রাখা উত্তম। চলতি অর্থবছরে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ধরা আছে ৬ দশমিক ২ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টদের মতে, করোনার মধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়েছেন। অর্থনীতি কিছুটা সঙ্কুচিত ছিল। ফলে চলতি অর্থবছরে ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন নিয়ে শঙ্কা আছে।
এরই মধ্যে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে অর্থনীতিকে কিছুটা হলেও প্রভাবিত করছে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী এসব সংকটের মধ্যেও আশা দেখছেন প্রবৃদ্ধির। আগামী অর্থবছরে ৭ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হবে বলে প্রাক্কলন করেছেন তিনি।
এজন্য বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন জিডিপির ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। এর মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ ২৪ দশমিক ৯ শতাংশ এবং সরকারি বিনিয়োগ ৬.৬ শতাংশ।
আর টাকার অঙ্কে নতুন জিডিপির আকার হচ্ছে ৪৪ লাখ ১২ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা। চলতি বছরে টাকার অঙ্কের জিডিপির আকার ৩৪ লাখ ৫৬ হাজার ৪০ কোটি টাকা।
এদিকে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে বাংলাদেশে। চলতি অর্থবছরে সংশোধিত মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৫.৭ শতাংশ এরই মধ্যে অতিক্রম করেছে।
এমন পরিস্থিতিতে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫.৫ শতাংশ। অর্থ বিভাগের ধারণা ব্যাপক ভর্তুকির কারণে জিনিসপত্রের দাম সহনীয় থাকবে। এতে নিয়ন্ত্রণ থাকবে মূল্যস্ফীতির।
করোনায় অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। তাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বেষ্টনীতে আনতে এ বছর এর আওতা বাড়ানো হবে। তবে কোনো কর্মসূচির ভাতার অঙ্ক বাড়ানো হবে না।
নতুন করে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে আরও ১১ লাখ ব্যক্তিকে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য সরকারের অতিরিক্ত আরও ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে এ খাতে।
নতুন বাজেটে প্রস্তাবিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৬ হাজার ২০৭ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৫.৬ শতাংশ। এটি চলতি এডিপির চেয়ে ২০ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা বেশি। চলতি এডিপির আকার ২ লাখ ৩৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা।