দেড় বছরে পুলিশ ও র্যাবের ১৭ সোর্স খুন
দেড় বছরে ঢাকাসহ সারা দেশে পুলিশ ও র্যাবের ১৭ জনের মতো সোর্স খুন হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের দাবি, অপরাধীদের ধরিয়ে দিতে পুলিশ-র্যাবকে সহযোগিতা করতে গিয়ে জীবন হারাতে হয়েছে তাঁদের। তবে পুলিশ ও র্যাব সূত্রের দাবি, বিরোধ ও অপরাধে জড়িয়ে প্রতিপক্ষের হাতে খুন হতে পারেন তাঁরা।
পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র জানায়, খুন হওয়া ১৭ জনের মধ্যে ১৫ জন পুলিশের সোর্স।
দুজন র্যাবের। অপরাধীদের বিষয়ে নিয়মিত তথ্যদাতারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছে ‘সোর্স’ বা অনুচর হিসেবে পরিচিত। যদিও পুলিশের কাগজপত্রে ‘সোর্স’ বলে কিছু নেই।
সর্বশেষ রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় গত সোমবার ‘সোর্স’ আশরাফুর রহমান (৬০) খুন হন। তিনি পুলিশের সোর্স ছিলেন বলে দাবি স্বজনদের। আশরাফুরের ভাগ্নে আব্দুর রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার মামা ব্যবসা করতেন। এর পাশাপাশি তিনি যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করতেন। ’
জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা ও যাত্রাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) চঞ্চল বিশ্বাস কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একসময় আশরাফুর পুলিশের সোর্সের কাজ করতেন। এখন না। ’
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটলিয়ন (র্যাব) ও নিহত ব্যক্তিদের পারিবারিক সূত্রে আরো যেসব খুনের তথ্য জানা যায়, তার মধ্যে অন্যতম হলো আলমগীর হোসেন হত্যা। গত ২৯ অক্টোবর রাজধানীর রামপুরার বউবাজার এলাকায় পুলিশের ‘সোর্স’ আলমগীর হোসেনকে হত্যা করা হয়। তিনি খিলগাঁওয়ের হাজীপাড়ায় থাকতেন। আলমগীরের বাবা আতশ আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আলমগীর পুলিশের সোর্স ছিল। সে খুন হওয়ার পর এখন পরিবারের সবাই হুমকির মধ্যে আছি। পুলিশের দেওয়া সোর্স মানির টাকায় সংসার চলত, এখন সেটাও বন্ধ। ’
এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তার রিমন ওরফে লিমন হত্যার দায় স্বীকার করে ডিবিকে জানিয়েছে, ‘একসঙ্গে মাদক কারবার করতে গিয়ে আলমগীরের সঙ্গে আমার বিরোধ হয়। পরে পুলিশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আলমগীর আমাকে ধরিয়ে দেয়। ’ এ কারণে আলমগীরকে খুন করেন তিনি।
গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর শেরেবাংলানগরে র্যাবের ‘সোর্স’ আবুল কাশেমকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার চারজন র্যাবকে জানায়, ঘটনার এক মাস আগে রাজাবাজার এলাকায় তাদের সহযোগী নুরজাহান বেগমকে র্যাবের কাছে ধরিয়ে দেন কাশেম। প্রতিশোধ নিতেই তাঁকে হত্যা করা হয়।
আরো যাঁরা খুন হন
গত বছরের ১২ জানুয়ারি খুলনার বান্দাবাজারে শফিকুল ইসলাম ও সজল হোসেন, ২৪ জানুয়ারি খুলনার দিঘলিয়া উপজেলায় মামুন মোল্যা এবং ২৬ জানুয়ারি গাজীপুরের টঙ্গীর মরকুন পশ্চিম পাড়া এলাকায় জাকির হোসেন খুন হন। তাঁরা সবাই পুলিশের ‘সোর্স’ বলে পরিবার দাবি করেছে। এরপর গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার পূর্ব জুরাইনের নবায়ন গলিতে খুন হন জাকির হোসেন।
গত বছরের ৩১ মার্চ যশোরের ঝুমঝুমপুর চান্দের মোড় এলাকায় আবদুর রহমান রোমান, ২০ মার্চ গাজীপুরের টঙ্গীতে মো. নজির ও ৩০ মার্চ নজরুল ইসলাম, ৬ মে টঙ্গীর এরশাদনগরে রাসেল মিয়া, ২৩ মে টঙ্গী-কালীগঞ্জ সড়কের টিঅ্যান্ডটি গেট এলাকায় কুতুব উদ্দিন, ২২ মে ওই এলাকায় খুন হন মো. মমিন। তাঁরা সবাই পুলিশের ‘সোর্স’। এ ছাড়া রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় মুরাদ খুন হন গত বছরের মে মাসে। ওই বছরের ১৯ আগস্ট চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় খুন হন আরেক ‘সোর্স’ মনিরুল ইসলাম এবং ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার কেরানীগঞ্জে খুন হন আলমগীর হোসেন।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মো. ফারুক হোসেন বলেন, বিভিন্ন সময়ে পুলিশকে সহযোগিতা করতে গিয়ে অপরাধীদের হাতে ডিএমপিতে বেশ কয়েকজন খুন হয়েছেন। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সোর্স মানে তথ্যদাতা। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে সোর্সদের কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে র্যাব-পুলিশের নাম করে অপরাধে জড়ান। এর দায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নয়। সবচেয়ে বড় কথা ‘সোর্স’ কে হবেন, সেটা কখনো প্রকাশ করা হয় না। কিছু সোর্স নিজেরাই নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করেন। তবে সোর্স ছাড়া আপরাধ নিয়ন্ত্রণ বা অপরাধীদের ধরতে সময় লাগে। খন্দকার আল মঈন বলেন, গত দেড় বছরে তাঁদের দুজন ‘সোর্স’ খুন হওয়ার তথ্য রয়েছে।
এই ‘সোর্স’ কারা
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাধারণত মামলার আসামি, মাদক কারবারি ও সন্ত্রাসীদের মধ্যেই কেউ কেউ ‘সোর্স’ হিসেবে কাজ করেন। এ ছাড়া অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আগাম তথ্যের জন্য রাজনৈতিক কর্মী, ছোটখাটো অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, জেল থেকে ছাড়া পাওয়া আসামি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের পুলিশ-র্যাব সোর্স হিসেবে কাজে লাগায়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা বলেন, একজন সাধারণ মানুষও সোর্স হতে পারেন। আবার কোনো বিজ্ঞজনও হতে পারেন সোর্স। তবে সোর্সরা কোনো বাহিনীর স্বীকৃত কোনো সদস্য নন। বড় ধরনের অপরাধীর তথ্য বের করতে পুলিশ সোর্স নিয়োগ দেয়। সে ক্ষেত্রে তাঁকে আর্থিক সুবিধা দিতে হয়, যা সোর্স মানি হিসেবে পরিচিত। যদিও কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে যখন এই টাকা দেওয়া হয়, তখন তাকে বলা হয়ে থাকে ‘অপারেশন মানি’।
তবে সুনির্দিষ্ট কোনো বিধি বা প্রবিধান না থাকায় পুলিশের সোর্সরা সব সময়ই জবাবদিহির বাইরে থেকে যান।
এ বিষয়ে ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার (গোয়েন্দা) এবং সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত ডিআইজি মাহবুব আলম বলেন, প্রকৃতপক্ষে পুলিশে ‘সোর্স’ বলে কিছু নেই। তবে মামলা তদন্ত ও অপরাধীদের ধরতে অনেক সময় অনেকের সহযোগিতা নেয় পুলিশ। তাদেরই ‘সোর্স’ মনে করা হয়। তবে সত্য এটাই যে সোর্সদের সহযোগিতা ছাড়া আসামিদের ধরা কঠিন।
এই সোর্সরা কাজ করতে গিয়ে খুন হলে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়, জানতে চাইলে মাহবুব আলম বলেন, আইন সবার জন্য সমান। যে কেউ হত্যার শিকার হলে তদন্ত করে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
কেন সোর্স খুন হন
বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা পর্যালোচনা করে এবং কয়েকজন সোর্সের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অপরাধীদের গ্রেপ্তারের পেছনে কাজ করার তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে সোর্সদের জীবন হুমকির মুখে পড়ে। এরপর সন্ত্রাসীদের টার্গেটে পরিণত হন সোর্স। তবে পুলিশ ও র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, র্যাব-পুলিশকে সহযোগিতা করতে গিয়ে নিজেরা অপরাধকর্মে জড়িয়ে প্রতিপক্ষের হাতে নির্যাতন বা খুন হতে পারেন তাঁরা।
তবে এমন বক্তব্য মানতে নারাজ সোর্সরা। একজন সোর্স অক্ষেপ করে বলেন, কাজের সময় অর্থাৎ জীবিত থাকলে পুলিশ তাঁদের বন্ধু মনে করে। প্রয়োজন ফুরালে, বিশেষ করে খুন হলে সন্ত্রাসী বলে পরিচয় দেয়।
সোর্সদের বিরুদ্ধেও আছে অভিযোগ
অভিযোগ রয়েছে, অপরাধী শনাক্ত ও মামলা তদন্তে পুলিশকে যতটা সহযোগিতা করেন সোর্সরা, এরও বেশি ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করে থাকেন তাঁরা। অনেক সময় সোর্সদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারাও বিপদে পড়ে যান। আবার অনেক সময় পুলিশ জেনে-শুনে সোর্সদের দিয়ে সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি, হয়রানি, চাঁদাবাজি, জমি দখলসহ নানা অপরাধে জড়ায়।
কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা গেছে, অনেক সময় পুলিশের সোর্সদের কাছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র, হাতকড়া ও পুলিশের ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জামও দেখা যায়। এলাকায় মাদক কারবার থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করার অভিযোগ আছে সোর্সদের বিরুদ্ধে। আবার আর্থিক সুবিধা বা অনৈতিক সুবিধা পেতে অনেক সময় পুলিশকে মিথ্যা তথ্য দেন তাঁরা।
২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পল্লবী থানায় পুলিশের হেফাজতে জনি নামের এক ব্যক্তির মৃত্যুর মামলায় তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও দুজনকে সাত বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। যে দুজনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তাঁরা মূলত পুলিশের ‘সোর্স’ হিসেবে কাজ করছিলেন।
জানতে চাইলে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মহাসচিব নূর খান কালের কণ্ঠকে বলেন, সোর্সদের বিরুদ্ধে পুলিশ-র্যাবের নাম ভাঙিয়ে নানা অপরাধে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তবে সোর্স হোক বা অপরাধী হোক, কেউ ‘খুন’ হলে তদন্ত করে আইনগত সহযোগিতা করা পুলিশের দায়িত্ব। সোর্সদের তাদের কাজ, পরিচয় গোপন রাখার কৌশলসহ অপরাধে না জড়ানোর বিষয়ে উৎসাহ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।