গভীর সংকটে কোণঠাসা সরকার পতন অনিবার্য

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার এখন পুরোপুরিভাবে গভীর সংকটের মধ্যে রয়েছে। কোণঠাসা হয়ে পড়েছে তারা। একদিকে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে বিভিন্ন খাত সামাল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার। তারা জনগণের সমস্যা সমাধানে ফেল করেছে। দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী। সরকারের ভয়াবহ দুর্নীতিতে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ফলে তারা এর কোনো সমাধান দিতে পারবে না। আমরা অত্যন্ত আশাবাদী ও আত্মবিশ্বাসী, এবার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে এ সরকারের পতন অনিবার্য।

শনিবার দুপুরে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘মিট দ্য ওকাব’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা জানান। বিদেশি গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন ওভারসিজ করেসপনডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ওকাব) আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন বিএনপির মহাসচিব। এর আগে তিনি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সরকারের অপশাসন, নির্বাচনের বিষয়ে দলের অবস্থানসহ নানা বিষয় তুলে ধরেন।

মির্জা ফখরুল বলেন, এক সময় এই সরকার বিদ্যুৎ শতভাগ লোডশেডিংমুক্ত বলে উৎসব করেছে, আতশবাজি করেছে। অথচ এখন গ্রামে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। ঢাকায় ১-২ ঘণ্টা করে লোডশেডিং হয়। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা গ্রামাঞ্চলে, সেখানে এই মুহূর্তে সেচের খুব প্রয়োজন। সেখানে ৭-৮ ঘণ্টা লোডশেডিং।

সেচের জন্য বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। এর ফলে বন্যার পরে খাদ্য উৎপাদন প্রচণ্ডভাবে ব্যাহত হবে। দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহির অভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, লোডশেডিং জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।

বিএনপির মহাসচিব বলেন, আরেকটি বড় বিষয় হলো, বড় দুটি সার কারখানা বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিছুদিন পর সেচের পানির জন্য এ বিদ্যুৎ বেশি প্রয়োজন হবে। তখন সমস্যাটা আরও বেশি হবে। সার সংকটের কারণে খাদ্যশস্য উৎপাদন ব্যাহত হবে। এসব সমস্যা সরকার তৈরি করেছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

‘নির্বাচনকালীন সরকার’র দাবি না মানলে রাজপথেই সরকার পরিবর্তন করা হবে বলেও মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ক্ষমতা থেকে কেউ নিজে নিজে যায় না। সরকারের পদত্যাগ, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ইত্যাদি দাবি না মানলে রাজপথেই একমাত্র সমাধান হবে।

দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্ভব নয় উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, নির্বাচন তখনই সম্ভব হবে, যখন দেশে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার থাকবে। ওই সরকারের অধীনে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে। সেই কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করবে।

নির্বাচনকালীন সরকারের জন্য সরকারকেই সংসদে আইন আনতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা তো তাই করেছিলাম। ১৯৯৬ সালে নতুন সংসদ হওয়ার পরে সারা রাত জেগে সংসদে আইন পাশ করে আমরা পদত্যাগ করেছিলাম। সংসদ বাতিল করা হয়েছিল। সেই নির্বাচনে দেশনেত্রী খালেদা জিয়া ১১৬টা আসনে বিরোধী দলে বসেছিলেন। আমরা মেনে নিয়েছি। এটাই হচ্ছে গণতন্ত্র। এতে আপত্তিটা কোথায় এ সরকারের?

ব্যাক ডোরে সংলাপ নেই উল্লেখ করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ব্যাক ডোর বলে কোনো কথা নেই। আমাদের যা কিছু সব ফ্রন্ট ডোর। আমরা সব সময় সামনে থেকে প্রকাশ্যে, একেবারে জনসভার মধ্য দিয়ে ঘোষণা দিচ্ছি যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বা নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া বিএনপি কোনো নির্বাচনে যাবে না। শুধু বিএনপি নয়, অনেক রাজনৈতিক দল আছে তারা ইতোমধ্যে বলে দিয়েছে কোনো নির্বাচনে যাবে না।

তাহলে সামনে দেশ কোনো সহিংসতার দিকে যাচ্ছে কিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এটা তো নির্ভর করবে সরকারের ওপর। এই সরকার এখন ড্রাইভিং সিটে। প্রত্যেকবারই সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হয় যে কোনো রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করার জন্য। যদি মারামারি, কাটাকাটি দেখতে না চায় তাহলে সরকারকে অবশ্যই আমাদের দাবিগুলো মানতে হবে।

আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান কি হবে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব বলেন, আমরা সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলছি একটা জাতীয় ঐক্য তৈরি করার জন্য। সেখানে এখন পর্যন্ত যত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলেছি সবাই একমত হয়েছি যে, আমরা যুগপৎ আন্দোলনে যাব। সুতরাং এখানে এ বিষয়ে কোনো বিভ্রান্তির সুযোগ নেই।

সরকারের বিকল্প বিএনপিই বলে মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল। আগামী নির্বাচনে বিএনপি গেলে নেতা কে হবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ দলের নেতৃত্ব তো নির্ধারিত হয়ে আছে। দেশনেত্রী বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আমাদের নেত্রী। তার অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আমাদের নেতা। সুতরাং এখানে কোনো অস্পষ্টতা নেই।

যুগপৎ আন্দোলন প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, যুগপৎ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। ১৯৯০ সালেও যে আন্দোলন হয়েছিল-৫ দল, ৭ দল ও ৮ দল। সেখানে কিন্তু যুগপৎ আন্দোলন হয়েছিল। সেই মডেলে সব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলছি। সবাই যার যার অবস্থান থেকে আন্দোলন শুরু করবে।

এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির মহাসচিব বলেন, নির্দলীয় সরকারের প্রশ্নে আমরা ২০১৪ সাল থেকে আন্দোলন করছি। সেই আন্দোলনেই আছি। আমরা যখন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় নামব, আন্দোলনই বলে দেবে আন্দোলনের ধারা কোন পথে যাবে।

দাবি না মানলে কোনো সংলাপও নয় জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, নির্দলীয় সরকারের রূপরেখার প্রশ্ন তখনই আসবে যখন সরকার আমাদের সঙ্গে নিরপেক্ষ সরকার গঠনের বিষয়ে একমত হবে। তার আগে নয়। সরকার যদি বলে যে, নির্বাচনকালীন সরকার, নিরপেক্ষ সরকার বা সহায়ক সরকার গঠন করা হবে-আমরা একমত। তখন কিভাবে হবে সেটা নিয়ে আমরা চিন্তা করে দেখব।

‘বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে ভারতের একটি প্রচ্ছন্ন ভূমিকা রয়েছে, এক্ষেত্রে বিএনপি দেশটির কাছে কি প্রত্যাশা করে’-সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, সরকার দেশের গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত করেছে। এমন পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আমরা সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কার্যকর ভূমিকা প্রত্যাশা করি।

বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রীলংকার অনেক মিল দেখতে পাচ্ছেন জানিয়ে বিএনপির মহাপসচিব বলেন, আমদানি করা গ্যাসের দাম বেড়ে যাচ্ছে, ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে, এখন একটা বড় রকমের ক্রাইসিস শুরু হয়ে গেছে। সার কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পোশাক কারখানাগুলোর অনেকে বিপদে পড়েছেন গ্যাস না পাওয়ার কারণে। ফলে প্রতিযোগিতার মধ্যে বেকায়দার মধ্যে পড়েছে।

তিনি বলেন, অন্যান্য শিল্পকারখানাগুলো জ্বালানি সংকটে পড়েছে। পরিবহণ ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, বৈদেশিক মজুতের পরিমাণ নিচের দিকে যাচ্ছে, রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে। শ্রীলংকার মূল ক্রাইসিস ছিল রিজার্ভ শূন্যের কোঠায় গিয়েছে। আজকে এ সরকার এমনভাবে প্রতারণা করে যে, রিজার্ভ ৪২ বিলিয়নের কথা বলে। এর মধ্যে সাড়ে ৭ বিলিয়ন এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের নামে তারা এ দেশের যারা রপ্তানি করে তাদের ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে দিয়েছে। এই টাকা ফেরত আসার সম্ভাবনা নেই। রপ্তানি কমে আসছে, উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। ফলে ওই ক্রাইসিসগুলো এখন গভীর হচ্ছে। সেজন্য আমরা আশঙ্কা করছি এখানে শ্রীলংকার মতো একটা অবস্থা তৈরি হতে পারে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে।

ওকাবের সদস্য সচিব নজরুল ইসলাম মিঠুর সঞ্চালনায় মূল মঞ্চে ছিলেন-সংগঠনটির আহ্বায়ক কাদির কল্লোল ও সিনিয়র সদস্য ফরিদ আহমেদ। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন-বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন, সদস্য সচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী ও সদস্য শায়রুল কবির খান।