সেনাবাহিনী দেশ সামলায় না ব্যবসা করে?
এম ডি আসাদ উজ্জামান খান, যুক্তরাজ্য থেকে
দেশ রক্ষার জন্য আমাদের সেনাবাহিনী তৈরি হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের সেনাবাহিনী দেশ রক্ষা তো দূরে থাক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সামলাতে আর ব্যবসা করতে ব্যস্ত। সম্প্রতি কয়েকটি সংবাদ দেখে আমার তো সেনাবাহিনীর নামই পরিবর্তন করতে ইচ্ছে করছে। শুধু যে ব্যবসা করছে তাই নয়, তারা ব্যবসার নামে জায়গা দখল করছেন, ব্যাংক থেকে টাকা লুট করছেন।
আর সরকার তাদের টিকিয়ে রাখার জন্য ব্যাংক, হোটেল, খাবার, গার্মেন্টস, ইলেকট্রনিক, রিয়েল এস্টেট, পরিবহনখাত সহ সব খাতেই বসিয়ে রাখা হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে। আজকাল সব ধরনের ব্যবসার সঙ্গেই যুক্ত এই বাহিনী। আর এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো চলে আবার ‘আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্ট’ আর ‘সেনা কল্যাণ সংস্থা’র অধীনে। তাই মনে হয় নাম পরিবর্তন করে নাম রাখতে ইচ্ছে করে বাংলাদেশ ব্যবসা বাহিনী।
‘সেনা কল্যাণ সংস্থা’ গঠন হয় ১৯৭২ সালে এবং ১৯৯৮ সালে সংস্থাটিকে কোম্পানি আইনে নিবন্ধন করা হয়। ‘আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্ট’ গঠন করা হয় ১৯৯৯ সালে। আর এরপর থেকেই একের পর এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শুরু করেন এই বাহিনী। বর্তমানে ৪৭ টির বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে এই বাহিনীর। সব খাতেই এদের ক্ষমতা দেখানোর জন্য বসে যাচ্ছেন এই বাহিনী। নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও দেশের অনেক শীর্ষস্থানেও বসে আছেন সেনাবাহিনীর প্রাক্তন অনেক কর্মকর্তা বসে আছেন।
খোজ নিলেই দেখা যাবে, আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবি)-এর গভর্নমেন্ট ডিফেন্স অ্যান্টিকরাপশন ইনডেক্স অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থান ‘ব্যান্ড ডি’। এই ‘ব্যান্ড ডি’ বলতে তারা বোঝায় ডিফেন্স সেক্টরে উচ্চমাত্রার দুর্নীতি ঝুঁকির কথা।
টিআইবি সরাসরি সেনাবাহিনীর খাত ধরে দূর্নীতির কথা না বললেও ঝুকির কথা বলেছেন। তবে টিআইবির মতে, সেনাবাহিনী ব্যাংক-হোটেল থেকে শুরু করে ট্র্যাভেল ব্যবসায়ও জড়িয়ে পড়েছে। এটা সেনাবাহিনীর কাজ নয়। দেশে প্রতিটি সেক্টরে তারা জড়িয়ে পরেছে। একের পর এক দূর্নীতি করছে। কিন্তু কারও সাহস হচ্ছে না সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কিছু বলার।
খোজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অধীনে সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানটি হলো ‘ট্রাষ্ট ব্যাংক লি.। বর্তমানে সারাদেশে এদের অন্ততপক্ষে ১০০টি শাখা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতোই কাজ করে। আর এই ব্যাংক থেকে সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতর কর্মকর্তা হাজার হাজার কোটি টাকা তাদের আত্মীয়স্বজনের নামে তোলার অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া সরকারী প্রজেক্টে তাদের অর্থের লেনদেনের নামে টাকা বেহাত হওয়ার ঘটনাও অনেকের জানা
এছাড়া ঢাকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় পাঁচতারা হোটেল র্যাডিসন-ও সেনাবাহিনীর মালিকানায়। রাজধানীর বাইরে চট্টগ্রামেও রয়েছে তাদের আরেকটি পাঁচতারা হেটেল র্যাডিসন ব্লু। আর এই হোটেল গুলোতে ইদানিং যত ধরনের অনৈতিক ব্যবসা চলছে তার পেছনে কিছু সেনাবাহিনীর হাত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনেক হোটেল কর্মকর্তা বলেছেন, দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ন মিটিং এখানে হয়। কিন্তু তারপর অনেক বড় বড় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা তাদের একান্ত সময় কাটান এইসব হোটেল গুলোতে। তাদের মনরঞ্জনের জন্য আলাদা করে কিছু নারীও রয়েছে এখানে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ‘সেনা কল্যাণ সংস্থা’ বা এসকেএস-এর অধীনে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে: ‘মংলা সিমেন্ট ফ্যাক্টরী’, ‘ডায়মন্ড ফুড ইন্ডাষ্ট্রিজ’, ‘ফৌজি ফ্লাওয়ার মিলস’, ‘চিটাগাং ফ্লাওয়ার মিলস’, ‘সেনা কল্যাণ ইলেক্ট্রিক ইন্ডাষ্ট্রিজ’, ‘এনসেল টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড’, ‘স্যাভয় আইসক্রিম’, ‘চকোলেট এন্ড ক্যান্ডি ফ্যাক্টরী’, ‘ইস্টার্ন হোসিয়ারী মিলস’, ‘এস কে ফেব্রিক্স’, ‘স্যাভয় ব্রেড এন্ড বিস্কুট ফ্যাক্টরী’, ‘সেনা গার্মেন্টস’, ‘ফ্যাক্টো ইয়ামাগেন ইলেক্ট্রনিক্স’, ‘সৈনিক ল্যাম্পস ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টার’, ‘আমিন মহিউদ্দিন ফাউন্ডেশন’, ‘এস কে এস কমার্শিয়াল স্পেস’, ‘সেনা কল্যাণ কমার্শিয়াল কমপ্লেক্স’, ‘অনন্যা শপিং কমপ্লেক্স’, ‘সেনা ট্রাভেল লিমিটেড’, ‘এস কে এস ট্রেডিং হাউস’, ‘এস কে এস ভবন খুলনা’, ‘নিউ হোটেল টাইগার গার্ডেন’, ‘রিয়েল এস্টেট ডিভিশন চট্টগ্রাম’ এবং ‘এস কে টেক্সটাইল’।
যেহেতু সেনাবাহিণী কারও কাছে জবাবদিহী করে না। তাই এই সব প্রতিষ্ঠান বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে ‘আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্ট’ বা এডাব্লিউটির প্রতিষ্ঠানগুলো হলো: ‘ট্রাষ্ট ব্যাংক লি’., ‘র্যাডিসন ওয়াটার গার্ডেন হোটেল’, ‘আর্মি শপিং কমপ্লেক্স’, ‘সেনা প্যাকেজিং লিমিটেড’, ‘সেনা হোটেল ডেভলেপমেন্ট লিমিটেড’, ‘ট্রাষ্ট ফিলিং এন্ড সিএনজি ষ্টেশন’, ‘সেনা ফিলিং ষ্টেশন চট্টগ্রাম’, ‘ভাটিয়ারী গলফ এন্ড কান্ট্রি ক্লাব’, ‘কুর্মিটোলা গলফ ক্লাব’, ‘সাভার গলফ ক্লাব’, ‘ওয়াটার গার্ডেন হোটেল লিমিটেড চট্টগ্রাম’, ‘ট্রাষ্ট অডিটোরিয়াম এবং ক্যাপ্টেনস ওর্য়াল্ড’, ‘আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্ট বাস সার্ভিস’ আর ‘ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিস’
এছাড়া রয়েছে ‘আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল’ ও ‘আর্মি ইন্সটিউট অব বিজনেস এ্যাডমিনিষ্ট্রেশন’। এর সঙ্গে সেনাবাহিনী সরাসরি নির্মাণ কাজেও যুক্ত। যেমন ঢাকার ‘হাতির ঝিল’ প্রকল্পটি সেনাবাহিনীই বাস্তবায়ন করে। এমনকি রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান ‘মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি’ এখন পরিচালনা করে সেনাবাহিনীই।
জানা গেছে, এবার ওষুধ ও বীমা কোম্পানিসহ আরো কিছু ব্যবসায় যুক্ত হতে চায় বাংলাদেশের সেনাবাহিনী।
সেনাবাহিনী এতো এতো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছেন। আবার সেখানে কাজ দিচ্ছেন তাদের আত্মীয় স্বজনদের। তাছাড়া এই সব প্রতিষ্ঠানে কাজ দেওয়ার নামে একদল সেনাকর্মকর্তা কোটি কোটি টাকা ঘুষ নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সব মিলিয়ে আমি মোটেও সেনাবাহিনীর এ রকম ব্যবসাকে সমর্থন করি না। ব্যবসার নামে তারা প্রত্যেকেই বাড়ি, গাড়ির মালিক হয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। যেভাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাড়তে শুরু করেছে তাতে একদনি সেনাবাহিনী তাদের আদর্শকে ভুলে গিয়ে দলাদলি করতে পারে, যার প্রভাব সাধারণ জনগণের উপর পড়বে।