কেনেডি-কিসিঞ্জার-পাকিস্তান-ভুট্টো
এম ডি কামরুল হাসান, যুক্তরাজ্য
মুক্ত হয়েছে কেনেডি হত্যার সব ডক্যুমেন্ট যা প্রায় ৮০ হাজার পৃষ্ঠা। এই সব দলিলে অনেক সত্য যেমন আছে, অনেক মিথ্যাও আছে কেনেডি হত্যা তদন্তকে ভুল পথে পরিচালিত করার জন্য বা এমনকি খোদ মার্কিন সরকারকে বিভ্রান্ত করার জন্য। এই ডক্যুমেন্টগুলো মুক্ত করার ফলে কেনেডি হত্যার বিষয়ে মানুষ কতটুকু স্বচ্ছ সত্য খুঁজে পাবে সেটা এখনও অজানা। তবে মার্কিন সরকারের পেছনের ক্ষমতা চক্র এবং অনেক ডিপ স্টেট খেলোয়ার ও দালালদের মুখোশ খুলবে এখন থেকে সেটা পরিষ্কার।
এর মধ্যেই প্রমান পাওয়া গেছে যে সিআইএ নিয়ন্ত্রিত হত একটি গোপন চক্র দ্বারা যারা সরাসরি যুক্ত ইসরাইলের গোয়েন্দা দপ্তর মোসাদের সাথে। কেনেডি হত্যার পেছনে কেনেডির রাশিয়ার সাথে সুসম্পর্ক, ক্যাস্ট্রো, কিউবা ও ভিয়েতনামে কঠোর কার্যক্রম নিয়ে কেনেডির সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপ স্টেটের সংঘাতের নানা বিষয় জড়িত থাকলেও ইসরাইলকে পারমানবিক অস্ত্র দেওয়া নিয়ে একটি নতুন তথ্য সামনে এসেছে যার বিরোধী ছিলেন কেনেডি।
১৯৭১ এর যুদ্ধে পাকিস্তানের শোচনীয় পরাজয়ের আগে থেকেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো জানতেন যে প্রচলিত অস্ত্রের অল আউট যুদ্ধে ভারতের সাথে কখনই দাঁড়াতে পারবে না পাকিস্তান। ভুট্টো ক্ষমতা পাবার সাথে সাথেই পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমা তৈরির লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন।
১৯৭২ সালে প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের বিজ্ঞানীদের একটি গোপন সভায় ডেকে পারমানবিক অস্ত্র তৈরির পরিকল্পনা শুরু করেন। তিনি বলেন, “আমরা ঘাস খাব, কিন্তু বোমা বানাব।” এই সভায় ড. আব্দুল কাদির খানের নাম উঠে আসে। ১৯৭৪ সালের ১৮ মে ভারত তার প্রথম পারমানবিক পরীক্ষা “স্মাইলিং বুদ্ধা” সফলভাবে সম্পন্ন করে। এটি পাকিস্তানের জন্য একটি বড় উদ্দীপনা হয়ে ওঠে। একই বছর ড. আব্দুল কাদির খান নেদারল্যান্ডস থেকে পাকিস্তানে ফিরে আসেন এবং পারমানবিক প্রকল্পে যোগ দেন। তিনি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রযুক্তি সাথে নিয়ে আসেন। ১৯৭৬ সালে পাকিস্তান কাহুতায় “ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ল্যাবরেটরিজ” (বর্তমানে কাদির খান রিসার্চ ল্যাবরেটরিজ) প্রতিষ্ঠা করে। এটি পারমানবিক অস্ত্র তৈরির মূল কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
গোয়েন্দা সূত্রে পারমানবিক অস্ত্র তৈরির এ খবর পশ্চিমাদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। ইসরাইল এর বিরোধীতা করে। তারা আমেরিকাকে বলে যে, পাকিস্তান যে বোমা বানাচ্ছে সেটি হবে “ইসলামীক অ্যাটম বোম্ব”। এর চূড়ান্ত টার্গেট হবে ইসরাইল। আমেরিকার দক্ষিন এশিয়া পলিসি ও ইসরাইলের চাপে আমেরিকা ভুট্টোকে বোমা নির্মাণ কর্মসূচী থেকে সরে আসার পরামর্শ দিচ্ছিল। সেটিতে কাজ না হলে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ভুট্টোকে হুমকিও দেয়া মুরু করেন।
কিসিঞ্জার প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোকে বলেছিলেন, আপনারা যদি বোমা বানানো থেকে নিবৃত্ত না হোন, তাহলে আপনাকে এবং আপনার দেশকে ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে।
এর পর পরই পাকিস্তানে জিনারেল জিয়া-উল-হকের এক সামরিক ক্যু’তে ক্ষমতা হারান ভুট্টো। এবং শুধু সেটাই নয়, একটি পুরোনো দুুর্বল রাজনৈতিক খুনের মামলায় তড়িঘড়ি সামরিক আইনে বিচার করে ভুট্টোকে ফাঁসীতে ঝুলানো হয় যেটা ছিল স্রেফ একটি রাষ্ট্রীয় হত্যাকান্ড।
১৯৮৩-৮৪ সালে জিয়াউল হকের পাকিস্তান আবার পারমানবিক অস্ত্রে আগ্রহী হয়। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে তারা সফলতা অর্জন করে। ড. আব্দুল কাদির খানের নেতৃত্বে সেন্ট্রিফিউজ প্রযুক্তি ব্যবহার করে অস্ত্র-গ্রেড ইউরেনিয়াম উৎপাদন শুরু হয়। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা এবং বিজ্ঞানীরা দাবি করেন যে তারা একটি পারমানবিক যন্ত্র তৈরির ক্ষমতা অর্জন করেছে। তবে এটি এখনো পরীক্ষা করা হয়নি।
১৯৮৭ সালের জুলাই মাসে আমেরিকায় একজন পাকিস্তানি নাগরিক, আরশেদ পারভেজের গ্রেপ্তার হন, যিনি অবৈধ পারমানবিক ধাতব সংগ্রহের অভিযোগে ধরা পড়েছিলেন। এই ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্কে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল এবং রিগান প্রশাসনের মধ্যে বিভক্তি আরও তীব্র করেছিল। এই তথ্য জাতীয় নিরাপত্তা আর্কাইভ এবং নিউক্লিয়ার প্রলিফারেশন ইন্টারন্যাশনাল হিস্ট্রি প্রজেক্ট কর্তৃক আজ প্রকাশিত সম্প্রতি গোপনীয়তা মুক্ত নথিগুলো থেকে জানা গেছে।
আমেরিকা সরকার আবার বিষয়টিতে সতর্কতা জারী করে। তারা জিয়া-উল- হককে পারমানবিক অস্ত্র তৈরিতে বিরত থাকতে বলে।
১৭ আগস্ট ১৯৮৮ পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে প্রায় ৩৩০ মাইল দক্ষিণে বাহওয়ালপুর টেস্ট ফিল্ড। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়া-উল হক সেখানে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিনের তৈরি এম-৩১ ট্যাংকের মহড়া দেখতে। ট্যাংকের মহড়া দেখে ফেরার পথে বিধ্বস্ত হয় তাকে বহন করা লকহিড মার্টিনের তৈরি সি-১৩০বি বিমানটি। জেনারেল জিয়াউল হকের সাথে নিহত হন পাকিস্তানে তখনকার আমেরিকান রাষ্ট্রদূত আরনল্ড রাফেল ও মিলিটারি অ্যাটাশে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হারবার্ট এম ওয়াসম যাদের ঐ বিমানে ওঠার কথা ছিল না। মধ্যান্নভোজের পর জিয়া-উল হক তাদের অনুরোধ করে সাথে নেন।
জেনারেল জিয়াউল হকের সি-১৩০বি বিমানটি দুর্ঘটনার পর ১১ মাস কোন মার্কিন তদন্ত হয়নি যদিও মার্কিন আইন আছে ৭২ ঘন্টার মধ্যে তদন্ত শুরু করতে হবে যদি বিদেশে কোন দুর্ঘটনায় মার্কিন নাগরিক প্রাণ হারায়। রাজনৈতিক চাপে ১১ মাস পরে তদন্ত শুরু হলেও আমেরিকান রাষ্ট্রদূত আরনল্ড রাফেল ও মিলিটারি অ্যাটাশে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হারবার্ট এম ওয়াসমের পরিবারের সদস্যরা ও মার্কিন কতৃপক্ষ তদন্তে অসহযোগীতা করে।