এলপিজি বাজার অস্থির

এলপিজি, তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা সিলিন্ডার গ্যাসের মূল ব্যবসায়ীরা অধিকাংশই নীতিমালা মানছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। শর্ত অনুসারে প্রতিটি কোম্পানির কমপক্ষে পাঁচ হাজার টন এলপি গ্যাস মজুদ ক্ষমতা থাকতে হবে। দেশে বিদ্যমান ২৮টি এলপিজি কোম্পানির মাত্র ছয়টি এ শর্ত পালন করছে। খরচ কমাতে অনেক অপারেটর বা উদ্যোক্তা মানসম্মত সিলিন্ডার ব্যবহার করছে না। অনেকে সিলিন্ডারের রক্ষণাবেক্ষণ, গ্যাস বোতলজাতকরণ, সিলিন্ডার পরিবহনসহ অন্য অবকাঠামো খাতে নিরাপত্তাবিধি ঠিকমতো মানছেন না। বিনিয়োগ কমাতেই অভিযুক্ত কোম্পানিগুলো নীতিমালা মানছে না। মার্কেট ধরতে অনেকেই এসব ব্যয় কমিয়ে বাজারে অল্প দামে এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি করছে। ফলে বড় সৎ ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়ছেন। এতে সিলিন্ডার গ্যাস নিয়ে একটা অশুভ প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে। অস্থির হয়ে উঠছে এলপিজির বাজার। যা এ খাতের জন্য মঙ্গলজনক নয় বলে মনে করছেন এ খাতের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীরা।
আবাসনে পাইপলাইন গ্যাস দেওয়া বন্ধ বহু বছর ধরে। এ জন্য সিলিন্ডার গ্যাস বা এলপিজির চাহিদা বেড়েই চলেছে। সরকারও পাইপলাইন গ্যাসের বদলে সিলিল্ডার গ্যাসের ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে চাইছে। সরকারের সহায়তামূলক নীতির কারণে দেশে এলপিজি অপারেটরের সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে। এতে বাজারে প্রতিযোগিতা বেড়েছে। ফলে কমে এসেছে রান্নার সিলিন্ডার গ্যাসের দাম।
তবে উদ্যোক্তারা এটিকে নেতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন, বাজারে কোম্পানির সংখ্যা বৃদ্ধি ভালো। তবে তা হওয়া উচিত নিয়ন্ত্রিত। অপারেটর এত বেশি হয়েছে যে, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ এখন বেশি। মার্কেট ধরতে অনেকেই ব্যয়ের চেয়ে কম দামে গ্যাস ছাড়ছে। বিনিয়োগ কমাতে অনেক অপারেটর নীতিমালা মানছে না। এতে সম্ভাবনাময় এলপিজি খাত অস্থির হয়ে উঠছে।
এলপিজি আসলে কী? :এলপি গ্যাস মূলত হাইপ্রোকার্বন গ্যাসের মিশ্রণ। শুধু প্রোপেন বা শুধু বিউটেন অথবা বিউটেন ও প্রপেনের সংমিশ্রণ। এতে অতি সামান্য পরিমাণ ইথেনও থাকে। তেল ও গ্যাসক্ষেত্রের সহজাত হিসেবে প্রাপ্ত কনডেনসেট অথবা অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ক্রুড অয়েল পরিশোধন করে এলপিজি করা যায়। তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে বিভিন্ন দেশে প্রোপেন ও বিউটেনের অনুপাত ভিন্ন হয়। ভারতে প্রোপেন ও বিউটেনের অনুপাত ৪০:৬০, যুক্তরাষ্ট্রে সারাবছর ১০০ ভাগ প্রোপেন আর ফ্রান্সে নভেম্বর থেকে মার্চে ১০০ ভাগ প্রোপেন ও গ্রীষ্ফ্মকালে ৩০:৭০। বাংলাদেশে নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই অনুপাত ৩০ :৭০ কোনো ক্ষেত্রে ৪০ :৬০, দু-একটি কোম্পানি ৫০ :৫০ অনুপাতে মেশায়।
বিশ্বে এলপিজি উৎপাদন :এলপিজির উৎপাদক প্রথম সারির দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব, কাতার এলপিজির অন্যতম উৎপাদক ও রপ্তানিকারক। এলপিজি ব্যবহারে ওপরের দিকে আছে জাপান, মাথাপিছু ৫৯ কেজি। প্রতিবেশী ভারতে মাথাপিছু ব্যবহার ১৬ কেজি। বাংলাদেশে এ হার মাত্র ৬ কেজি।
দেশে এলপিজির ব্যবহার :রান্নার কাজে বাংলাদেশে এলপিজির ব্যবহার শুরু হয় ২০০৫ সালে। পাইপলাইনের গ্যাসের ঘাটতির কারণে ২০১৫ সালের পর এটি দেশব্যাপী জনপ্রিয় হয় দ্রুতগতিতে। বাংলাদেশে সাড়ে ১২ কেজি, ৩০ কেজি, ৩৫ কেজিসহ বিভিন্ন মাপের সিলিন্ডারে এলপি গ্যাস বিক্রি হয়। এর মধ্যে বাসাবাড়ি, হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক কাজে সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডারের জনপ্রিয়তা বেশি।
বর্তমানে বাসাবাড়িতে গ্যাসের নতুন সংযোগ দেওয়া বন্ধ থাকায় এলপি গ্যাস আবাসিকের বিকল্প জ্বালানি হয়ে উঠছে। পরিবহনেও সিএনজির (কম্প্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস) পরিবর্তে এলপিজির ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বহু এলপিজি (অটোগ্যাস) ফিলিং স্টেশন গড়ে উঠেছে। অনেক কলকারখানার জ্বালানি হিসেবেও এলপি গ্যাস ব্যবহূত হচ্ছে। গত পাঁচ বছরে বোতলজাত এই গ্যাসের চাহিদা দ্বিগুণ বেড়েছে। দেশে এখন দুই কোটির বেশি এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহূত হচ্ছে। বছরে বাংলাদেশে ১০ লাখ টন এলপিজি পুড়ছে। পরিবেশবান্ধব এই জ্বালানির ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল। এলপিজি ব্যবসায়ীদের মতে, সম্ভাবনার মাত্র ৪০ শতাংশ এখন পর্যন্ত উন্মোচিত হয়েছে।
ফলে দেশে এলপিজির একটা বড় বাজার সৃষ্টি হয়েছে। এটা ধরতে বড় বড় ব্যবসায়ীদের অনেকেই এলপিজি ব্যবসায় নামছেন। এ খাতে বর্তমানে বিনিয়োগ প্রায় দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সামনে এটা আরও বাড়বে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মোংলায় রয়েছে বসুন্ধরা, যমুনা, সেনাকল্যাণ সংস্থার সেনা এলপিজি, ওমেরা এলপিজি ও প্রেট্রিগ্যাজ (সাবেক ক্লিনহিট, বিদেশি কোম্পানি); চট্টগ্রামে রয়েছে সুপার গ্যাস (টিকে গ্রুপ), বিএম এনার্জি, প্রিমিয়ার এলপি (সাবেক টোটাল গ্যাস, বিদেশি কোম্পানি), বিন হাবিব, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ইউনিভার্সেল ইত্যাদি। নাভানা, ওরিয়ন, এনার্জিপ্যাক, বেক্সিমকোর মতো বড় প্রতিষ্ঠানও এলপি ব্যবসায় এগিয়ে এসেছে।
বর্তমানে দেশে একটি সরকারিসহ মোট ২৮টি কোম্পানি এলপিজি আমদানি, মজুদ ও বিতরণ করছে। এর মধ্যে ২০টি কোম্পানি সরাসরি গ্যাসের কাঁচামাল আমদানি করে। সরকারি প্রতিষ্ঠান এলপিজিএল আরপিজিসিএলের উৎপাদিত এলপিজি বাজারজাত করে। টিকে গ্রুপের সুপার পেট্রোকেমিক্যাল ইস্টার্ন রিফাইনারি থেকে ন্যাপথা কিনে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে উৎপাদিত এলপিজি বিক্রি করে। বাকি ছয় প্রতিষ্ঠান পদ্মা, অর্কিড, বিন হাবিব, এসএল কর্ণফুলী, এইচএম রহমান, হাজি নজির আমদানিকারক বড় উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে গ্যাস কিনে সিলিন্ডারে করে বিক্রি করে। বেসরকারি উদ্যোক্তারা বছরে প্রায় ১০ লাখ টন এলপিজি আমদানি করে, যা দেশের মোট সরবরাহের ৯৮%। বাকি ২% বা ১৭ হাজার টন দেশে উৎপন্ন হয়। এলপি গ্যাস আমদানির জন্য টার্মিনাল রয়েছে ১৪টি। দেশে এলপি গ্যাসের ডিলার রয়েছে প্রায় তিন হাজার। খুচরা বিক্রেতার সংখ্যা ৩৮ হাজারের ওপরে। এলপিজি ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩৮ লাখ। এলপি গ্যাসের ৮৪% ব্যবহূত হয় রান্নার কাজে। বাকি ১৬%-এর একটা বড় অংশ যায় কলকারখানায়। গাড়িতেও এলপিজির ব্যবহার বাড়ছে। মোট এলপি গ্যাসের ৩৭% ঢাকায়, ১৮% চট্টগ্রামে, ১২% খুলনায়, ৮% রংপুরে, ৬% ময়মনসিংহে, ৪% বরিশালে এবং ৩% সিলেটে ব্যবহূত হয়।
অধিকাংশের মজুদ ক্ষমতা কম : সূত্র জানায়, এলপিজি বিপণন নীতিমালা-২০১৭ অনুসারে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রতিটি কোম্পানিকে ৫ হাজার টন ক্ষমতার মজুদ গড়ে তোলার কথা। কিন্তু তালিকার মাত্র ছয়টি কোম্পানি এই শর্ত পূরণ করছে। দেশের সরকারি-বেসরকারি কোম্পানিগুলোর মজুদ ক্ষমতা মোট ৮৮ হাজার টন। এর মধ্যে পেট্রোম্যাক্সের পাঁচ হাজার ৪০ টন, মেঘনা ফ্রেশ এলপিজির ছয় হাজার টন, জেএমআই এলপিজির ছয় হাজার ৩০০ টন, ইউনিট্যাক্স এলপিজির পাঁচ হাজার টন, বিএম এনার্জির নয় হাজার ২০০ টন ও ওমেরা এলপিজির নয় হাজার ১৬২ টন মজুদ করার ট্যাঙ্ক রয়েছে। বাকিদের কারও মজুদ ক্ষমতা চার হাজার টন, কারও তিন হাজার টন। আবার কয়েকটির মজুদ ক্ষমতা শতকের ঘরে। এ বিষয়ে একাধিক উদ্যোক্তা সমকালকে বলেন, তারা সরকারের শর্ত মেনে মজুদ ক্ষমতার ট্যাঙ্ক বানিয়েছেন। এতে শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হয়েছে। কিন্তু অনেকে কম বিনিয়োগ করেই সমানভাবে ব্যবসা করতে চাইছে। এখানে বৈষম্য হচ্ছে। প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসায়িক পরিবেশ আর থাকছে না। ফলে এলপিজির বাজারে অস্থিরতা আরও বাড়বে।
এলপিজির ঝুঁকিপূর্ণ বিকিকিনি : এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার জীবনকে যেমন সহজ করেছে, তেমনি বাড়িয়ে দিয়েছে নিরাপত্তা ঝুঁকি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়া এবং অব্যবস্থ্থপনা ও অবৈধ ব্যবহারের ফলে বহু সিলিন্ডার বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। স্থানীয় পর্যায়ে অনেক ব্যবসায়ী নিজেরাই সিলিন্ডার ভরে গ্যাস বিক্রি করছে। এটাকে বলা হচ্ছে ক্রসফিলিং। এটা অনিরাপদ। কারণ এলপিজি কোম্পানিতে আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সিলিন্ডারে গ্যাস ভরা হয়। সিলিন্ডার পরীক্ষা করে ভাল্ক্ব ও সেফটি ক্যাপ বসানো হয়। আর ক্রস ফিলিংয়ে হাতের সাহায্যে ভাল্ক্ব বসানো হয়, যা সিলিন্ডারগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। আবার অনেক ছোট কোম্পানি বড় উদ্যোক্তাদের সিলিন্ডারে গ্যাস ভরে অবৈধভাবে বাজারজাত করছে। যাতে ক্ষতির মুখে পড়ছে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলো। একাধিক উদ্যোক্তা অভিযোগ করেন, নীতিমালা অনুসারে নিরিাপত্তাবিধি মেনে ব্যবসা করতে গিয়ে তাদের অধিক বিনিয়োগ করতে হয়েছে। কিন্তু কিছু অপারেটর নীতিমালার তোয়াক্কা না করেই অল্প বিনিয়োগে ব্যবসা করে বেশি মুনাফা তুলছে। এটা তো অনৈতিক। বাজারে একটা অসম প্রতিযোগিতা চলছে, যা এলপিজি খাতকে ভবিষ্যতে আরও অস্থির করে তুলবে।
বাজারে এলপিজি কোম্পানিগুলোর অবস্থান :খাত-সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুসারে সবচেয়ে পুরোনো ব্র্যান্ড বসুন্ধরা এলপি প্রায় ২৫ শতাংশ বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। ১৩ শতাংশ বাজার নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে আজম জে চৌধুরীর ওমেরা এলপিজি, ১১ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে বিএম এলপি গ্যাস। এর পরে রয়েছে যথাক্রমে যমুনা এলপি গ্যাস ৯ শতাংশ, পেট্রোম্যাক্স এলপিজি ৭ শতাংশ, লাফ্‌স গ্যাস ৬ শতাংশ, টোটাল গ্যাস ৬ শতাংশ, জি গ্যাস ৪ শতাংশ, নাভানা এলপিজি ৪ শতাংশ, বেক্সিমকো এলপিজি ৩ শতাংশ, সেনা গ্যাস ৩ শতাংশ, ওরিয়ন গ্যাস ৩ শতাংশ, ইউনিভার্সাল এলপিজি ২ শতাংশ, ইউরো এলপিজি ২ শতাংশ ও প্রমিতা এলপিজি ১ শতাংশ।
একমাত্র সরকারি কোম্পানি এলপি গ্যাস লিমিটেড বছরে দেশে উৎপাদিত ১৭ হাজার টন এলপি সরবরাহ করে। বাকিটা আমদানি করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *