দুই-তৃতীয়াংশই ভুয়া এতিম!

রাজধানীর আজিমপুরের স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা। প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে ১৮২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি রয়েছে, তবে এর মধ্যে ১২১ জনেরই বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এতিম প্রমাণে তাদের অনেকেরই বাবার মৃত্যু সনদ জমা দেওয়া হয়নি। সংশ্লিষ্ট এলাকার সমাজসেবা অফিসের সুপারিশও নেই কারো কারো। কয়েকজনের কাগজপত্রও পাওয়া যাচ্ছে না। এরই মধ্যে নতুন করে এতিম ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে কর্তৃপক্ষ।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এভাবে বছরের পর বছর ভুয়া এতিমের দাপটে সত্যিকারের এতিমরা বঞ্চিত হচ্ছে। তবে এতিমখানা নিয়ে বিভিন্ন জালিয়াতির অভিযোগে এরই মধ্যে কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়ে জেলে আছেন। ভুয়া এতিমদের তাড়াতে সব ধরনের চেষ্টা চলছে বলে কর্তৃপক্ষের দাবি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৭ সালে ১৮ বছর পার করা এতিমখানাটির ৬১ শিক্ষার্থীকে এক অফিস আদেশে বহিষ্কার করা হয়। তবে এর পরও হারুন অর রশিদ নামের এক শিক্ষার্থীর নেতৃত্বে ইউসূফ মোল্লা, জুয়েল আহমেদ, নজরুল ইসলাম প্রমুখ ১৫ জন থেকে যান। তাঁরা এতিমখানার কর্মচারীদের থাকার জায়গা দখল করে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এতিমখানার একাধিক কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ভুয়া রসিদে এতিমখানার দোকান ভাড়া আদায়সহ বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করে হারুন অর রশিদের নেতৃত্বাধীন বাহিনী। তাঁরাই ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রমাণপত্র ছাড়াই এতিম শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে ভূমিকা রাখেন। তাঁরা ওই সব শিক্ষার্থীকে দিয়ে বিভিন্ন সময় আন্দোলনের ভয় দেখাতেন। এতিমখানার সম্পদ ভাঙচুরসহ নানা অঘটনে বৈধ শিক্ষার্থীদের ভর্তি বা রাখা কঠিন হয়ে পড়েছিল। সম্প্রতি তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করে কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে হারুনসহ তিনজন গ্রেপ্তার হয়ে জেলে আছেন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এতিমখানার ৭৬ জন ছেলে এবং ১০৬ জন মেয়ে শিক্ষার্থীর মধ্যে ১২১ জনেরই কাগজপত্র ঠিকঠাক নেই। এর মধ্যে ৯১ জনের বাবার মৃত্যু সনদ নেই। তাদের মধ্যে ৪১ জনের স্থানীয় সমাজসেবা অফিসের সুপারিশও নেই। এর বাইরেও ৩০ জনের সমাজসেবা অফিসের সুপারিশ জমা দেওয়া হয়নি। কারো কারো ভর্তি ফরমে ভর্তি কমিটির সভাপতি ও সম্পাদকের সইও নেই। তিনজন মেয়ে শিক্ষার্থীর কোনো ধরনের কাগজপত্রই খুঁজে পায়নি কর্তৃপক্ষ।

এতিমখানা সূত্র বলছে, মেয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫০ জনের বাবার মৃত্যু সনদ জমা দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে ৪১ ছেলে শিক্ষার্থী তাদের বাবার মৃত্যু সনদ দেয়নি। আর তিন মেয়ে শিক্ষার্থীর কোনো ধরনের কাগজপত্রই পাওয়া যাচ্ছে না।

সম্প্রতি এতিমখানার এক মেয়ে শিক্ষার্থীর ভর্তি ফরমে দেওয়া ঠিকানায় (৩৭/১, বেগমগঞ্জ লেন, সূত্রাপুর) গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, মেয়েটির পরিবার এখন এখানে থাকে না, থাকে কামরাঙ্গীর চরে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী জানান, মেয়েটির বাবাকে বছর দুয়েক আগেও তিনি দেখেছেন। যদিও মেয়েটি ছোট থেকেই এতিমখানায় থাকে। পরে মেয়েটির মায়ের মোবাইল নম্বরে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘ভর্তির সময় ইলমার বাবার মৃত্যুর সনদ দেওয়া হইছিল, কিন্তু পরে কয়েক দিন আগে কর্তপক্ষ কইলো নাকি ওইটা নাই। পরে গত মাসে আবার দিয়া আসছি।’ আপনার স্বামী জীবিত থাকার পরও কেন মেয়েকে এতিমখানায় দিয়েছেন? এর জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী নাই। এইটার প্রমাণও দিছি। তার পরও মাইনসে কইলে কী করমু?’

এ বিষয়ে এতিমখানার নতুন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা নূসরাত আলম বলেন, ‘মেয়েটির বাবার মৃত্যু সনদ জমা দেওয়া হয়নি। বারবার চাওয়ার পর গত ২৪ ডিসেম্বর কবরস্থানে দাফনের একটি সনদ দিয়েছে, যেটি এতিম প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয়। মৃত্যু সনদ সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন, কাউন্সিলর বা পৌরসভা কর্তৃক প্রমাণ হিসেবে জমা দেওয়া হয়।’

আরেক মেয়ে শিক্ষার্থীর স্থায়ী ঠিকানা কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা এলাকার চুনকুটিয়া পশ্চিমপাড়ায় গিয়েও কাউকে পাওয়া যায়নি। স্থানীয় লোকজন জানায়, মেয়েটির বাবা এলাকায় ফেরি করে ফল বিক্রি করতেন। কয়েক বছর আগে মেয়েকে এতিমখানায় ভর্তি করিয়ে দিয়ে চলে গেছেন। তাঁর কোনো খোঁজ নেই। অন্য দুই মেয়ে শিক্ষার্থীকে এতিমখানায় ভর্তি করিয়েছেন তাদের নানি। মেয়ে দুটির মা নানির সঙ্গে থাকেন। কেরানীগঞ্জের বেগুনবাড়ী এলাকায় তাদের বাড়িতে গেলে তাদের নানি বলেন, ‘আমার মাইয়ার জামাই অনেক বছর আগে সবাইরে ফালাইয়া চইলা গেছে। তারপর মাইয়া দুইডারে আমরা এতিমখানায় ভর্তি করছি। এহন ওগো বাপ কি বাইছা আছে না মইরা গেছে, জানি না। এতিমখানাওয়ালার না রাখলে নিয়া আমু।’

কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে আরো দুই মেয়ে শিক্ষার্থীর বাবার জীবিত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাদের একজনের বাবা নারায়ণগঞ্জ লক্ষার চরের একটি মুদি দোকানে কাজ করেন। আর অন্য মেয়েটির বাবা মুন্সীগঞ্জে নিজেই ব্যবসা করেন।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার তত্ত্বাবধায়ক আবদুল্লাহ আল মামুন গত বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এতিমখানার অনেক সমস্যার মধ্যে সত্যিকারের এতিম শিক্ষার্থীর চেয়ে ভুয়া এতিম ভর্তির বিষয়টি ভয়ংকর। অনেকের কাগজপত্র পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যাদের আছে, সেখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাগজ নেই। এতিমখানা নিয়ে বিভিন্ন জালিয়াতি করা তিনজন গ্রেপ্তার হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *