ঐক্যের ডাক দেওয়া বাইডেনের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ
জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথগ্রহণ করেছেন এমন সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি এবং সমাজে বিভক্তি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। কিন্তু তার চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রই এক বড় সংকটে উপনীত হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের চার বছরে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের পশ্চাৎযাত্রার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে ৬ জানুয়ারি ট্রাম্পের উসকানিতে তাঁর সমর্থকদের ক্যাপিটলে সশস্ত্র হামলা। তাই জো বাইডেন তাঁর ভাষণে যখন বলেন যে, গণতন্ত্র মূল্যবান, গণতন্ত্র ভঙ্গুর, এই মুহূর্তে গণতন্ত্রই বিজয়ী হয়েছে, তখন তা পরোক্ষভাবে মার্কিনিদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, গণতন্ত্র রক্ষা করার দায়িত্ব তাঁদের।
যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ইতিহাসে আর কোনো প্রেসিডেন্ট এত কঠিন অবস্থায় দায়িত্ব নিয়েছিলেন বলে মনে হয় না। সম্ভবত এর সঙ্গে তুলনা হতে পারে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের দ্বিতীয় মেয়াদের সূচনাকাল। বাইডেন যে এই পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পারেন, তা কেবল তাঁর বক্তৃতায় লিংকনের উদ্ধৃতি থেকেই বোঝা যায় না, বোঝা যায় এই বক্তব্যেও যে, ‘আমরা এখন যে সময়ে আছি আমাদের ইতিহাসে খুব কম লোকই এমনভাবে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে অথবা এমন সময়ের মোকাবিলা করেছে যা এখনের চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং বা দুরূহ সময়।’
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন যে, ‘রাজনৈতিক উগ্রবাদ, শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ এবং অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদ’কে মোকাবিলা করতে হবে। এর আগে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট এতটা সুনির্দিষ্ট করে মার্কিন সমাজ ও রাজনীতির এই সব ভয়াবহ প্রবণতার দিকে অঙ্গুলিসংকেত করেননি। যদিও এসব প্রবণতা মার্কিন সমাজের অংশ হিসেবেই বজায় থেকেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব ভয়াবহ প্রবণতাকে কীভাবে মোকাবিলা করা হবে? এসব প্রবণতাকে যারা উসকানি দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন, তাঁরা মূল ধারার রাজনীতির ভেতরেই আছেন। রিপাবলিকান দলের এক বড় অংশ যে এগুলোকে সমস্যা বলেই মনে করেন না, সেটা তাঁদের আচরণেই স্পষ্ট। তাঁদের সহযোগিতা ছাড়া বাইডেন প্রশাসন এই সব সমস্যা কীভাবে মোকাবিলা করবে—সেটা একটা বড় প্রশ্ন হয়ে থাকল। ইতিমধ্যে রিপাবলিকান দলে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে।
কিন্তু তাঁর পরিণতি কী হবে, সেটা খুব শিগগিরই দেখা যাবে না। তদুপরি বাইডেন প্রশাসনের জন্য আশু চ্যালেঞ্জ হচ্ছে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করা এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধার।
বাইডেন তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন, ‘সাম্প্রতিক সপ্তাহ এবং মাসগুলো আমাদের একটি দুঃখজনক শিক্ষা দিয়েছে। সত্য আছে, আছে মিথ্যা। ক্ষমতা এবং মুনাফার জন্য মিথ্যা বলা হয়। একজন নাগরিক হিসেবে, একজন আমেরিকান হিসেবে, বিশেষ করে নেতা হিসেবে, সেই সব নেতা যারা সংবিধান এবং জাতিকে রক্ষার শপথ নিয়েছেন, তাঁদের দায়িত্ব হচ্ছে সত্যকে রক্ষা করা এবং মিথ্যাকে পরাজিত করা।’ বলাই বাহুল্য যে গত চার বছরে, বিশেষ করে ৩ নভেম্বরের নির্বাচনের পরে ট্রাম্প এবং রিপাবলিকান দলের পক্ষে থেকে যেভাবে মিথ্যাচার করা হয়েছে এবং নির্বাচনে জালিয়াতির মিথ্যাচার করে যেভাবে সহিংসতার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার দিকেই ইঙ্গিত করলেন। এটি রিপাবলিকান দলের প্রতি তাঁর হুঁশিয়ারি বলে বিবেচনা করলে ভুল হবে না।
জো বাইডেনের বিজয় বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের জন্য স্বস্তি বয়ে এনেছে। বাইডেনের শপথ গ্রহণ এবং বক্তৃতা যে সারা বিশ্বের মানুষ আগ্রহ নিয়ে দেখেছেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের নেতারা এর মধ্যে বাইডেন ভবিষ্যতে কী করবেন সেটা বুঝতে চেয়েছেন, সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বাইডেনের বক্তৃতায় সবচেয়ে কম যে বিষয়ে বলা হয়েছে তা হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, পররাষ্ট্র নীতি।
সাম্প্রতিককালে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের অভিষেক বক্তৃতায় আন্তর্জাতিক বিষয় এতটা কম ছিল কিনা, সেটা তুলনা করে দেখা যায়। বাইডেন বলেছেন, ‘আমরা আমাদের জোটগুলোকে মেরামত করব। আবার বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হব। কিন্তু তা গতকালের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য নয়, আজকের এবং আগামী কালের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য।’
বৈশ্বিক রাজনীতি বিষয়ে বিস্তারিত বক্তব্যের অনুপস্থিতি বলে দিচ্ছে যে, গত চার বছরে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি এবং প্রভাব যে হ্রাস পেয়েছে, তা বাইডেন প্রশাসন ভালো করেই উপলব্ধি করেন। এই ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার বাইডেন প্রশাসনের জন্য একটি বড় কাজ।
একার্থে এই উপলব্ধি এবং বক্তৃতায় আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গের অনুপস্থিতিই বলে দিচ্ছে যে, বাইডেন ঘর গোছানোর দিকে মন দেবেন। কিন্তু ঘর গোছানোর পাশাপাশি বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার শেষ হবে না। ‘বিশ্বকে আমরা আমাদের শক্তি দিয়ে নয়, নেতৃত্ব প্রদান করব উদাহরণ সৃষ্টি করে’—বাইডেনের এই প্রতিশ্রুতি বিশ্ব শুনেছে। এখন অপেক্ষা তার বাস্তবায়ন কীভাবে হয়, তা দেখার জন্য।