আদালতের নির্দেশ পুলিশের কাছে পৌঁছাতেই দেড় মাস

সৌদি আরবে কিশোরী নদী আক্তার লাশ হয় গত বছরের ১৪ আগস্ট। ঢাকায় তার দাফন হয় ৩০ অক্টোবর। আদালত নদীর মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ উত্তোলনের নির্দেশ দেন গত ৩ ডিসেম্বর। অথচ লাশ উত্তোলনের এই আদেশ পুলিশের হাতে পৌঁছাতে লেগে গেছে দেড় মাসের বেশি।

নদীর স্বজনেরা এই সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দপ্তর ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ে আবেদন করেও কোনো প্রতিকার পাননি। এত দিন পর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে নদী আক্তারের মৃত্যুর সঠিক কারণ খুঁজে পাওয়া নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। পুলিশ বলছে, মরদেহ উত্তোলনের চিঠি জেলা প্রশাসন ঘুরে তাদের হাতে এসেছে দিন দুয়েক আগে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সোমবার (২৫ জানুয়ারি) তার মরদেহ তোলা হবে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আলামত নষ্টের আশঙ্কা বাড়ে। গুলি লাগলে বা হাড়গোড় ভাঙা থাকলে মৃত্যুর অনেক দিন পরও সহজেই ময়নাতদন্তে মৃত্যুর কারণ জানা যায়। নদী আক্তারের ক্ষেত্রে দেখতে হবে কতটা ভালোভাবে তার লাশ সংরক্ষণ করা হয়েছে এবং কীভাবে কাফন–দাফন করা হয়েছে।বিজ্ঞাপন

নদী আক্তারের মা বিউটি বেগম প্রথম আলোকে বলেন, নদীর বুকের মাঝখান থেকে কাটা ছিল (সৌদি আরবে নদীর ময়নাতদন্ত হয়েছে। ওই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে আত্মহত্যার কথা বলা হয়েছে)। আর সারা শরীরে আঘাতের অজস্র চিহ্ন ছিল। কী করবেন বুঝে উঠতে না পেরে তাঁরা মৃতদেহটি কবর দিয়ে ফেলেন। পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩ ডিসেম্বর নদী আক্তারের মরদেহ উত্তোলন করে ময়নাতদন্তের নির্দেশ দেন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত। সৌদি আরবের মদিনায় গৃহকর্মী হিসেবে কর্মরত নদী মারা যায় গত বছরের ১৪ আগস্ট। ওই বছরের ৩০ অক্টোবর ঢাকায় পরিবারের কাছে মৃতদেহটি হস্তান্তর করা হয়। ওই দিনই তাকে দাফন করা হয় রাজধানীর খিলগাঁও কবরস্থানে।

সৌদি আরবে নদী আক্তারের মৃত্যুর পর তার মা বিউটি বেগম গত ১৪ অক্টোবর কলাবাগান থানায় হত্যা এবং মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা করেন। এ মামলার আসামিরা হলেন মেসার্স ঢাকা এক্সপোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ রহমান লালন এবং একই প্রতিষ্ঠানের মো. আবদুল মালেক, মো. মাসুমসহ অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজন। বিউটি বেগম অভিযোগ করেন, পরস্পর যোগসাজশে তাঁরা নদীকে জবরদস্তি শ্রমে বাধ্য ও হত্যা করেছেন।

যা ঘটেছে

বিউটি বেগম প্রথম আলোকে বলেন, নদী সৌদি আরবে গিয়েছিল রিক্রুটিং এজেন্সি ঢাকা এক্সপোর্ট আরএলের মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে তাঁদের কথা ছিল মা-মেয়ে দুজনকেই তারা সৌদি আরবে একই বাসায় কাজের ব্যবস্থা করে দেবে। সেই মতো ২০১৯ সালের ৩ মার্চ তাঁরা মদিনার উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছিলেন। বিমানবন্দরে নামার পর বিউটি বেগম জানতে পারেন তাঁকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এর আগে সৌদি আরবে গিয়ে তিনি পুরো মেয়াদ কাজ না করায় মালিকপক্ষ অভিযোগ করেছিল। সে কারণে তাঁকে যে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে বিষয়টি জানা ছিল না বলে দাবি করেন বিউটি।

নদীকে রেখেই এক দিন পর দেশে ফেরেন বিউটি। মাস কয়েক পর ওই বছরের ৭ নভেম্বর একই রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে বিউটি ওমানে যান। যে টাকা দেওয়া হবে বলে রিক্রুটিং এজেন্সি জানিয়েছিল, সে টাকা না দেওয়ায় তিনি দেশে ফিরে আসেন কয়েক মাস পর। তবে পুরো সময়ই মেয়ের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ ছিল তাঁর।

বিউটি বেগম বলেন, মেয়ের সঙ্গে তাঁর সর্বশেষ কথা হয় গত ১৩ আগস্ট। নদী তার ওপর অমানুষিক নির্যাতনের কথা বলে। তাকে মেরে ফেলা হতে পারে—এমন কথাও জানায়। ওই দিন দুপুর থেকে বিউটি বেগম আর মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। মেয়ের সঙ্গে তাঁর কথা হতো অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যম ইমোতে। ইমোতে তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না। এর আগেও একবার নদীর সঙ্গে দিন সাতেক যোগাযোগ করতে পারেননি বিউটি। ইন্টারনেট সংযোগ নেই বলে ধরে নিয়েছিলেন নদীর আত্মীয়স্বজন। এর মধ্যে নদীর মুঠোফোন নম্বরেও যোগাযোগ করেন তাঁরা। রিং হলেও কেউ ফোন ধরছিল না। দিন সাতেক পর ওই বাড়ির গৃহকর্ত্রীর নম্বরে ফোন করেন বিউটি। ফোন ধরেন তাঁর ছেলে। তিনি বলেন, নদী বাসায় নেই। তাকে অফিসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেন, সে প্রশ্নের জবাব আর ছেলেটি দেননি। ফোন রেখেই সৌদি আরবের সেই অফিসে ফোন করেন বিউটি বেগম। সঙ্গে সঙ্গে বিউটি বেগম এদেশীয় রিক্রুটিং এজেন্সি ও সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠানে ফোন করেন। পরদিন বিউটি বেগমের এক আত্মীয়কে ঢাকা এক্সপোর্টের লালন ফোন করে জানান, নদী আক্তার আত্মহত্যা করেছে।

নদীর মরদেহ দেখে বিউটি বেগমের মনে হয়েছে তাঁর মেয়ে আত্মহত্যা করেনি, তাকে হত্যা করা হয়েছে। এ জন্য তিনি আইনের আশ্রয় নেন।বিজ্ঞাপন

প্রশাসন যা বলছে

নিয়ম অনুযায়ী মরদেহ কবর থেকে তোলার আদালতের আদেশ প্রথমে যাবে জেলা প্রশাসনে, এরপর পুলিশের কাছে। পরে পুলিশ সেই লাশ উত্তোলন করবে।


চিঠিপত্রে দেখা গেছে, আদালতের ৩ ডিসেম্বরের সেই আদেশের পর গত ১৯ জানুয়ারি ঢাকা জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ভাস্কর দেবনাথ এই লাশ উত্তোলনের জন্য একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে মনোনয়ন দিয়েছেন।


রোববার ভাস্কর দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, আদালত থেকে আদেশ এসে পৌঁছানোর দিন দু-একের মধ্যেই তাঁরা ম্যাজিস্ট্রেটের নাম চূড়ান্ত করে চিঠি দিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের কাছে এই আদেশ পড়ে ছিল না।

কলাবাগান থানার উপপরিদর্শক জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আদালতের নির্দেশ জেলা প্রশাসন হয়ে পুলিশের হাতে পৌঁছায়। তারপরই তাঁরা মরদেহ উত্তোলন করেন। নদী আক্তারের ব্যাপারে তাঁরা চিঠি পেয়েছেন ২০ জানুয়ারি। সোমবার (২৫ জানুয়ারি) মরদেহ তোলা হবে। তাঁর সঙ্গে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কথা হয়েছে।

জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি ও রমনার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মোশারেফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ যেদিন মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করবে সেদিন তাঁকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত পুলিশ তাঁকে তারিখ চূড়ান্ত করে কিছু জানায়নি। কেন এত দেরি হলো, সে সম্পর্কে তিনি জানেন না। তিনি অল্প কদিন আগে চিঠিটি হাতে পেয়েছেন।

নদীর বয়স নিয়ে সন্দেহ

জানা গেছে, নদীকে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোয় তথ্য জালিয়াতি করেছিল তার পরিবারও। জন্মসনদ অনুযায়ী নদীর জন্ম ২০০৭ সালের ১ ডিসেম্বর। সেই হিসাবে তার বয়স এখন ১৩ বছর ২ মাস। কিন্তু পাসপোর্টে জন্মতারিখ ১৯৯৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। বাবা দুলাল শেখের বাড়ি বাগেরহাট, মায়ের বাড়ি কুমিল্লা। কিন্তু তার পাসপোর্ট করা হয়েছিল ময়মনসিংহ থেকে।

বিউটি বেগমের ভাষ্য, তাঁর স্বামী ভুল করে জন্মসনদে মেয়ের বয়স কম দিয়েছেন।

নারীদের লাশ হয়ে ফেরা

বিমানবন্দরের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চার বছরে বিভিন্ন দেশে কাজ করতে যাওয়া ৪১০ জন নারী লাশ হয়ে দেশে ফিরেছেন। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই মারা গেছেন ১৫৩ জন। ৪১০ জনের মধ্যে ৬৭ জন আত্মহত্যা করেছেন। শুধু সৌদি আরবেই আত্মহত্যা করেছেন ৩৯ জন। তবে তাঁদের মধ্যে ১৮ বছরের কম বয়সী কতজন ছিল, সে তথ্য আলাদা করে নেই। কেননা, কাগজে-কলমে তো তারা প্রাপ্তবয়স্ক।

মধ্যপ্রাচ্য থেকে নারী কর্মীদের মৃতদেহ ফেরত আসা প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ২০১৯ সালে মন্তব্য করেছিলেন, ‘সৌদি আরবে কর্মরত ২ লাখ ২০ হাজার নারীর মধ্যে ৫৩ নারীর মরদেহ ফিরেছে, যা খুবই নগণ্য। সেখান থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে আসা নারীর সংখ্যা মাত্র ৮ হাজার, সংখ্যার দিক থেকে যা খুবই ছোট। তাঁরা দূতাবাসের শেল্টার হোমে অভিযোগ না করে দেশে এসে অত্যাচারের কথা বলেন।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *