পাঁচটি বিচিত্র এবং জনপ্রিয় ফরাসি খাবার
খাদ্যসংস্কৃতিতে ফরাসিদের সুনাম অনেকটাই একচেটিয়া। সেই প্রাচীনকাল থেকে খাবার নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিজ্ঞান এবং নান্দনিকতার সমন্বয়ে খাবার ও রন্ধন শুধু ক্ষুধা নিবারণে সীমাবদ্ধ থাকেনি। আর এখন তা শিল্পের আলাদা মাত্রায় উন্নীত হয়েছে।
বিচিত্র খাবারের প্রতি ফরাসিদের একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। পর্যটকদের অনেকেই ফ্রান্স ভ্রমণে এসে সেসব খাবারের স্বাদ আস্বাদন করে মোটেই হতাশ হননি। তবে খাবার হচ্ছে অনেকটাই অভ্যাসের ব্যাপার। অনেক খাবারের ঘ্রাণ আমাদের স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারি। খাবার আস্বাদনে রং ও রুচির রয়েছে অনেক বড় ভূমিকা। সে কারণেই হয়তো নতুন বর্ণের, ঘ্রাণের বিচিত্র সব খাবার অনেকেরই অপছন্দ হতে পারে এবং তা খুবই স্বাভাবিক।
একঝলকে দেখে নেওয়া যাক ফরাসিদের জনপ্রিয় পাঁচটি খাবার।বিজ্ঞাপন
শামুক
ফরাসিরা শামুক, গুগলি, ঝিনুক ইত্যাদি খেতে খুব পছন্দ করে। এদের মাছের বাজারগুলোর অনেকটাই দখল করে থাকে নানা প্রজাতির শামুক ও ঝিনুক।
প্রতিবছর গড়ে ১৬ হাজার টন শামুক ফরাসিদের খাবার টেবিলে আসে। অন্যভাবে বলা যায়, প্রায় ৭ কোটি ফরাসি বছরে ৪২ কোটি ৪০ লাখ শামুক খেয়ে থাকে। তবে বিভিন্ন প্রজাতির শামুকের মধ্যে যে শামুকটি ফরাসিদের বেশি পছন্দ, তা হচ্ছে প্যারিস থেকে ৩০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে বুরগইন অঞ্চলের হেলিক্স (Helix) প্রজাতির শামুক। আপাতদৃষ্টে রান্না করা খুব সহজ মনে হলেও হেলিক্স নামের শামুকটি রান্না করা মোটেও সহজ নয়। এটি বেশ যত্ন করে পরিষ্কার করতে হয়।
উর্সা
ফ্রান্সের মূল ভূমির সীমানায় অনেকটা জায়গাজুড়ে আছে উপসাগর, সাগর, এমনকি মহাসাগর। আর তাই ফরাসিদের রসনা মেটাতে সামুদ্রিক প্রাণীদের কমতি নেই। এদের একটি হচ্ছে উর্সা বা অর্চিন, ফ্রান্সের প্রায় সব বাজারেই পাওয়া যায়। অনেকটাই গোলাকার, শক্ত এবং প্রচুর বিষাক্ত কাঁটাযুক্ত আবরণের ঢাকা নরম দেহের একটি প্রাণী এটি। বেশির ভাগ ফরাসি রান্না না করেই একটুখানি লেবুর রস দিয়ে তাজা খেতেই বেশি পছন্দ করে এই উর্সা। স্বাদে হালকা মিষ্টি এবং একটুখানি আয়োডিনের ছোঁয়া আছে এতে।
ভূমধ্যসাগরের অর্চিনের স্বাদের বেশ নামডাক আছে। বছরে ছয় মাস জেলেরা নির্দিষ্ট আকারের অর্চিন সংগ্রহ করার অনুমতি পেয়ে থাকে। শেফরা খুব হালকা আঁচে বিভিন্নভাবে খাবারের উপযোগী করে এটি। সমুদ্রতীরের শহরগুলোতে বেড়াতে এলে পর্যটকেরা বেশ মজা করে এমন মাখন নরম সামুদ্রিক খাবারটি চেখে দেখেন।বিজ্ঞাপন
ফোয়া গ্রা
ফোয়া গ্রা বেশ দামি এবং ফরাসিদের খুব পছন্দের একটি খাবার। বিভিন্ন পালা-পার্বণ এবং উৎসবে এদের খাবার টেবিলের অন্যতম আকর্ষণ এই সুস্বাদু খাবার। তা ছাড়া বিভিন্ন বনেদি রেস্তোরাঁ তাদের নিজেদের ফোয়া গ্রার উৎকর্ষ নিয়ে বেশ বড়াই করে।
ফোয়া গ্রার অর্থ হচ্ছে চর্বিযুক্ত মোটা কলিজা। ফোয়া গ্রা আসলে অতিরিক্ত খাবার খাইয়ে মোটাতাজা করা হাঁসের কলিজা বা যকৃৎ। বাছাইকৃত প্রজাতির রাজহাঁস এবং সাধারণ পাতিহাঁসকে নিয়মিত আকণ্ঠ খাবার গিলিয়ে যকৃৎ কলেবরে বৃদ্ধি ও চর্বিসমৃদ্ধ করা হয়। জোর করে অতিরিক্ত খাবার খাওয়ানোর পর হাঁসের যকৃৎ স্বাভাবিক আকারের থেকে প্রায়ই ১০ গুণ বড় হয়। ফোয়া গ্রা তৈরি করার জন্য পাতিহাঁস ও রাজহাঁসকে সাধারণত ভুট্টা খাওয়ানো হয়ে থাকে।
ফোয়া গ্রা পরিবেশনায় নান্দনিকতার ছোঁয়া সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সালাদে, বিভিন্ন খাবারের সঙ্গে অনেকভাবে পরিবেশন করা হয় এটি। তবে পরিবেশনের নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। সাধারণত তিনভাবে ফোয়া গ্রা প্রস্তুত করা হয়—কাঁচা বা ক্রুড, আধা সেদ্ধ এবং পুরো সেদ্ধ। কাঁচা ফোয়া গ্রা সরাসরি স্বল্প আঁচে ভেজে বিভিন্নভাবে পরিবেশন করা হয়। আধা সেদ্ধ ও সেদ্ধ ফোয়া গ্রা রুটির ওপর মাখনের মতো প্রলেপ মাখিয়ে পরিবেশন করা হয়। গোল গোল চাকা করে কেটে বিভিন্ন খাবারের সঙ্গেও পরিবেশন করা হয় এটি।
রি দ্য ভোঁ
একটি বিচিত্র খাবার। সুইটব্রেড বা মিষ্টি রুটিও বলা হয়। তবে রুটির সঙ্গে কোনোই সম্পর্ক নেই এর। আসলে এটি হচ্ছে অরগান মিট, বাচ্চা গরুর থাইমাস গ্লান্ড, হৃৎপিণ্ডের ওপরের দিকের একটি অঙ্গ। পূর্ণ বয়স্ক গরুতে এই অঙ্গটি থাকে না। চমৎকার রন্ধনপ্রণালিতে বেশ উপাদেয় ফরাসিদের পছন্দের একটি খাবার এটি। প্রায় সব ক্ষেত্রেই মাখন এবং লেবু, কমলার রসে হালকা সসে মাশরুম দিয়ে রান্না করা হয়। তবে শেফরা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে নানা রন্ধনপ্রণালি এবং পরিবেশনায় বেশ হেরফের করে থাকেন।
তেত দ্য ভোঁ
আক্ষরিক ভাষান্তর করলে হয় ‘বাচ্চা গরুর মাথা’। ফ্রান্সে এ খাবারের বেশ নামডাক আছে। এটি তৈরির প্রধান উপাদান হচ্ছে বাচ্চা দুধের গরুর কানসহ নরম চামড়া, গরুর পায়া ও জিহ্বা। মাথার চামড়ার উপরিভাগের লোম তুলে ফেলা হয়। এরপর টুকরা টুকরা করে নেওয়া হয়। বিভিন্ন তরিতরকারি, বিশেষ করে বড় বড় টুকরার শালগম, গাজর, আলু দিয়ে সেদ্ধ করে অনেকক্ষণ ধরে অনেকটা ঝোলসহ রান্না করা হয়। সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাকের খুব প্রিয় খাবার এই ‘তেত দ্য ভোঁ’। অনেক নামকরা রেস্তোরাঁর বিশেষত্ব হচ্ছে এই খাবার। তৈরিতে তেমন ঝামেলা নেই। তবে একটু সময় বেশি লাগে।
দেশ এবং জাতিভেদে খাদ্যসংস্কৃতির ভিন্নতা লক্ষণীয়। আগে থেকে ভিনদেশি খাবার সম্পর্কে ধারণা থাকলে আগ্রহীরা নতুন নতুন খাবারের স্বাদ আস্বাদনে উৎসাহী হতে পারবেন। তাতে আনন্দিত হওয়ার সুযোগ থাকে।