চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে বুধবার শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হন জবদুল হক (৭৫)। পরে সেখান থেকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাঠানো হয় গত শুক্রবার বিকেলে। কিন্তু শনিবার দুপুর পর্যন্ত জবদুল ভর্তি হতে পারেননি। তার পাশে আছেন স্ত্রী মরিয়ম আর নাতি নাফিস ইকবাল। শনিবার বেলা পৌনে ১১টার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে থেকে তোলাছবি: শহীদুল ইসলাম
চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে গতকাল শুক্রবার রাতে পাওয়া নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদনে জানা গেছে, তিন ধরনের নমুনা পরীক্ষায় সংক্রমণের সর্বশেষ গড় হার ৫৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। তবে আরটি-পিসিআর ল্যাবে নমুনার ক্ষেত্রে এ হার ৫৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আগের দিন শনাক্তের গড় হার ছিল ৪১ দশমিক ৬০ শতাংশ।
আজ শনিবার শহরের বিশ্বরোড মোড়, শান্তির মোড়, সিসিডিবির মোড়, বাতেন খাঁর মোড় ছাড়া পুলিশের জোর তৎপরতা দেখা যায়নি। নিমতলা মোড়, বড় ইন্দারা মোড়, পুরাতন বাজার মোড়, ডাকঘর ও থানার সামনে মানুষ ও যানবাহন চলাচল ছিল স্বাভাবিক সময়ের কাছাকাছি। খোদ সদর থানা ফটকের সামনেই বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জটলা করে মানুষ দাঁড়িয়েছিল। শহরের বাইরে সদর উপজেলার পলসা, নয়াগোলা, বারঘরিয়া, মহারাজপুর, শিবগঞ্জের রানিহাটি, ছত্রাজিতপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় মানুষের চলাচল ছিল বেশি। অনেকের মুখেই মাস্ক ছিল না। লকডাউনের বিধিনিষেধ যথাযথভাবে কার্যকর হচ্ছে না। মানুষও মানছে না। রিকশা, অটোরিকশা চলাচল বেড়ে গেছে।
২৫০ শয্যার চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালের বহির্বিভাগে দুপুর ১২টার দিকে দেখা যায়, চিকিৎসকের কক্ষের সামনে সামাজিক দূরত্ব ছাড়াই রোগীরা লাইনে দাঁড়ানো। করোনা ওয়ার্ডে চাপ বেড়েছে। দুদিন আগেই শয্যাসংখ্যা ২০ বাড়িয়ে ৩০ করা হয়েছিল। প্রথম দিনই তা পরিপূর্ণ হয়ে যায় বলে জানান হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) নাদিম সরকার। বেলা একটার দিকে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের কক্ষে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি দুররুল হোদা, সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী, আরএমও ও করোনা ওয়ার্ডের চিকিৎসকদের নিয়ে সভা হয়েছে। সেখানে কী করে বাড়তি করোনা রোগীদের চাপ সামলানো যায়, সে বিষয়ে আলোচনা হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, আগামীকাল রোববার শয্যা বাড়িয়ে ৫০-এ উন্নীত করা হবে।
আরএমও বলেন, সন্দেহভাজন বেশ কয়েকজন করোনা রোগী মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন। শয্যার অভাবে তাঁদের করোনা ওয়ার্ডে পাঠানো যাচ্ছিল না। দুপুর ১২টার দিকে করোনা ওয়ার্ডের সামনে কথা হয় রোগীদের কয়েকজন স্বজনের সঙ্গে। সেলিনা আকতার নামের একজন বলেন, তাঁর মাকে ভর্তি করেছিলেন গত ৩১ মে। তখন বুকের ব্যথা ছিল, খাওয়াদাওয়া করছিলেন না। এখন ব্যথাও কমেছে, খাওয়াদাওয়াও করছেন। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। চিকিৎসা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও তিনি বলেন, ওয়ার্ডে একজন চিকিৎসককেই কর্মরত দেখা গেছে। তিনি রোগীদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
করোনা ওয়ার্ডে রোগীর খোঁজ নিতে আসা ফাইজার রহমান বলেন, ওয়ার্ডে শয্যাসংখ্যা বাড়লেও চিকিৎসক বাড়েনি। বাড়েনি ওয়ার্ড বয় ও আয়ার সংখ্যাও। রোগীর স্বজন শিবগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী জমিনপুরের মামুনুর রশীদ জানান, ওয়ার্ডের রোগীদের জন্য ওয়ার্ডের বাইরে রয়েছে মাত্র একটি শৌচাগার। সেটা সব সময় নোংরা থাকে।
করোনা ওয়ার্ডে দায়িত্বরত চিকিৎসা কর্মকর্তা মো. শাখাওয়াত বলেন, ওয়ার্ডে এখন ১২ জন রোগীর অবস্থা জটিল। তাঁদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা খুবই খারাপ। তাঁদের এখনই আইসিইউতে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া দরকার। এ হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা নেই। রাজশাহীতে পাঠানো যাচ্ছে না। কেননা, সেখানে আইসিইউতে শয্যা ফাঁকা নেই। গতকাল একজনকে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তাঁকে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
এই চিকিৎসক আরও জানান, ‘সব শয্যার জন্য হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলাও (এইচএফএনসি) নেই। এখানে দায়িত্বরত একজন নার্স বলেন, রোগীদের অক্সিজেন সরবরাহে ব্যবহার করা হয় নন-রিব্রেদার মাস্ক (হাই কনসেনট্রেশন মাস্ক)। নন-রিব্রেদার মাস্ক ব্যবহার করা হয় একবারের জন্য। কিন্তু এর অভাবের কারণে আমরা এটা একাধিকবার ব্যবহার করছি।’ করোনা ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত তথ্য কর্মকর্তা চিকিৎসক আহনাফ শাহরিয়ার জানান, সাতজন রোগীর অক্সিজেনের মাত্রা খারাপ অবস্থায় রয়েছে। সবারই অক্সিজেন মাত্রা ৯০-এর নিচে।
আরএমও নাদিম সরকার বলেন, শয্যাসংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু এ মুহূর্তে চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ছে না। প্রয়োজন আরও তিন–চারজন চিকিৎসকের। আয়া, ওয়ার্ড বয় ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীও দরকার। কিন্তু এগুলোর সংকট রয়েছে। তিনি আরও জানান, এ মুহূর্তে করোনা ওয়ার্ডের জন্য নন-রিব্রেদার মাস্ক ছাড়া অন্যান্য উপকরণের সংকট তেমন একটা নেই। অক্সিজেনের মজুত মোটামুটি সন্তোষজনক।বিজ্ঞাপন
সড়কে যানবাহন চলাচলের আধিক্য প্রসঙ্গে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) লিয়াকত আলী শেখ বলেন, ‘এখন আমের মৌসুম। এ জন্য যানবাহনের চলাচল বেড়েছে। আম ও অন্যান্য মালামাল পরিবহনে আমাদের ছাড় রয়েছে।’
সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে ই–মেইলে তথ্য দেওয়ার বাইরে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার জন্য তিন দিন ধরে সিভিল সার্জন জাহিদ নজরুল চৌধুরী সাংবাদিকদের ফোন ধরছেন না। তিন দিন আগে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওপরের নির্দেশ রয়েছে। এ জন্য ফোন ধরছি না।’ ওই দিন তিনি আরও বলেন, ‘এখন থেকে আমি করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা দেব না। যা বলার করোনা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসকই জানাবেন।’
সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার সকাল আটটা থেকে গতকাল শুক্রবার সকাল আটটা পর্যন্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৯ জন করোনা রোগী মারা গেছেন। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক সাইফুল ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, শুক্রবার সকাল আটটা থেকে শনিবার সকাল আটটা পর্যন্ত তাঁদের হাসপাতালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাঁচজন করোনা রোগী মারা গেছেন।