বাজেট অর্থনীতির অধোগতি থামাতে পারবে কি

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর

বাজেট অর্থনীতির অধোগতি থামাতে পারবে কি

করোনার দ্বিতীয় ধাক্কার সময় বাজেট উত্থাপিত হয়েছে। মানুষ প্রথম ধাক্কাই সামলাতে পারেনি। সঞ্চয়, আয় যা ছিল, সব ফুরিয়েছে। খানাগুলোর দ্বিতীয় ধাক্কা মোকাবিলা করার মতো সক্ষমতা অবশিষ্ট নেই। অভিঘাতে অধিকাংশ মানুষের ঝুঁকি প্রশমনের সক্ষমতা অনেক কম বলেই দারিদ্র্য বাড়ছে।

বিগত অর্থবছরে সরকারি ব্যয় আগের তুলনায় কমেছে। অধিক তারল্য থাকলেও ঋণপ্রবাহ বাড়েনি। ঘোষিত ঋণভিত্তিক প্রণোদনা প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ঘাটতির কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাতে অর্থ লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পৌঁছাতে পারেনি। অধিকাংশ মানুষের কর্ম নিয়োজনকারী খাতগুলো বঞ্চিত থেকে গেছে। সচ্ছল অংশই মূলত লাভবান হয়েছে। সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়ে বৈষম্য বাড়িয়েছে। অন্যদিকে অর্থনীতি আরও নিম্নগতির পথে যাচ্ছে।

অধোগতি রোধ এবং পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠনের কর্মসূচি হিসেবে সর্বজন খাতে বেশি গুরুত্ব আশা করা হয়েছিল। অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছিলেন, এবারের বাজেট হবে ‘মানুষের জন্য’ ‘জীবন ও জীবিকার প্রাধান্যের’ বাজেট। বলেছেন, ‘সব শ্রেণির মানুষকে মাথায় রেখে বাজেট করছি।’ দেখা যাক, বাজেটে জনগণের প্রত্যাশা এবং মন্ত্রীর কথা কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে।

সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে প্রকৃত বরাদ্দে সংকোচন

বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধির জন্য সম্প্রসারণশীল নীতি-কাঠামো নেওয়া হয়েছে। রাজস্ব ও মুদ্রানীতির মাধ্যমে ব্যক্তির হাতে এবং কারবারে সরাসরি নগদ অর্থ সরবরাহ করা হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে কর বাড়ানো হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে করপোরেট করের হার ২৮ শতাংশ প্রতিস্থাপন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সবাই যখন সম্প্রসারণশীল রাজস্ব নীতির আশ্রয় নিচ্ছে, বাংলাদেশ করোনাকালে দ্বিতীয়বারের বাজেটেও সংকোচনমুখিন নীতির দিকে ঝুঁকেছে। সর্বজন খাত—সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে প্রকৃত বরাদ্দ আগের চেয়ে কমেছে। সংঘবদ্ধ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের করপোরেট করে ছাড় দেওয়া হয়েছে। ছোট কারবার উপেক্ষিত থেকেছে। সাধারণ মানুষেরও করে ছাড় দেওয়া হয়নি।

যেকোনো হিসাবেই নতুন দারিদ্র্য বেড়েছে। জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে আগের বছরের চেয়ে বরাদ্দ ১৩ শতাংশ বেড়েছে। নতুন ১৪ লাখ মানুষকে এর আওতায় আনা হয়েছে। নগর দরিদ্রসহ আড়াই কোটি নতুন দরিদ্রের জন্য তা অপ্রতুল। উপরন্তু বরাদ্দকৃত অর্থের বেশির ভাগ অংশ সরকারি কর্মচারীদের পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদ প্রভৃতি প্রদানে যাবে। সরকারি প্রতিবেদনই বলছে, যোগ্য না হয়েও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ভাতা নেন ৪৬ শতাংশ সুবিধাভোগী। জনসংখ্যার সঠিক ডেটাবেইস না থাকায় এবং অনিয়মের কারণে অনেকে যোগ্য হয়েও কর্মসূচি থেকে বাদ পড়ছেন।

টাকার অঙ্কে বরাদ্দ সামান্য বাড়লেও বাজেট ও জিডিপির অংশ হিসাবে স্বাস্থ্য খাতে গতবারের চেয়ে বরাদ্দ কমেছে। গত বাজেটে জিডিপির অংশ হিসাবে বরাদ্দ ছিল ১ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। এবার তা কমে জিডিপির দশমিক ৯৫ শতাংশ হয়েছে। গত অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটের অংশ হিসাবে বরাদ্দ ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ থেকে কমে এবার হয়েছে ৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান ও আফগানিস্তান ছাড়া জিডিপির অংশ হিসাবে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দে বাংলাদেশ সবার চেয়ে পিছিয়ে। সুনির্দিষ্ট সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা কাঠামোর পরিকল্পনা বাজেটে নেই। স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বেড়ে চললেও কমানোর দিকনির্দেশনা অনুপস্থিত। এ থোক বরাদ্দ থেকে অধিকাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব নয়।

শিক্ষা খাতে টাকার অঙ্কে বরাদ্দ সামান্য বাড়লেও বাজেটের অংশ এবং জিডিপির অংশ হিসাবে গতবারের চেয়ে বরাদ্দ কমেছে। জিডিপি ও বাজেটের অংশ হিসাবে গেল অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল যথাক্রমে ২ দশমিক ২৪ এবং ১২ দশমিক ২৮ শতাংশ। কিন্তু তা এবার নেমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ২ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ এবং ১১ দশমিক ৯২ শতাংশে। শিক্ষা খাতের ব্যাপক ক্ষতি কীভাবে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব, তা নিয়ে বাজেটে কার্যকর পথনির্দেশ নেই।

রাজস্ব রক্ষণশীলতার আড়ালে গোষ্ঠীতন্ত্র লাভবান

সেকেলে রাজস্ব রক্ষণশীলতার কায়দায় সর্বজন খাতে প্রকৃত ব্যয় কমানো এবং কিছু খাতে কর অবকাশ দিলেও জ্বালানি, বিদ্যুৎ এবং পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বরাদ্দ বেড়েছে। অথচ এ খাতগুলো বছরের পর পর অর্থের অদক্ষ ব্যবহার, অপচয় এবং সময়মতো কাজ শেষ না করতে পারার জন্য সমালোচিত। জনপ্রশাসন এখনো বাজেটের সবচেয়ে বড় খাত। প্রকৃত রাজস্ব রক্ষণশীল তাত্ত্বিকতায় সরকার ছোট হওয়ার কথা। এসব খাতে ব্যয় কমানো হতো, কিন্তু তা না করে বাড়ানো হয়েছে।

বাজেটে মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ৩৯ দশমিক ২ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এনার্জি ও পরিবহন খাতে। গত বছর এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু সর্বজনের সামাজিক খাতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বরাদ্দ আগের বছরের ২২ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ২০ দশমিক ৯ শতাংশ। বাজেটের ৬০ দশমিক ৭২ শতাংশই ব্যয় হবে পরিচালন খাতে। পরিচালন ব্যয়ের এক-চতুর্থাংশের বেশি ব্যয় হবে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও পেনশন পরিশোধে।

অন্যদিকে দুই বছরে করপোরেট কর কমেছে ৫ শতাংশ। এতে ব্যবসায়ীরা ছাড় পাবেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য কোনো ছাড় নেই। যুক্তরাষ্ট্রে করপোরেট কর বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে ঠিক যেন উল্টো! এতে মূলত গোষ্ঠীতন্ত্রই লাভবান হচ্ছে।

ঋণ বাড়লেও জনগণের হাতে অর্থ যাচ্ছে না

ঘাটতির এক-তৃতীয়াংশ জোগাড় করতে হবে ঋণ করে। মাথাপিছু ঋণ বাড়ছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে নগদ অর্থ যাচ্ছে সামান্যই। ঋণ বাড়লেও মানুষের হাতে টাকা যাচ্ছে না। উদাহরণস্বরূপ, প্রণোদনা হিসেবে ব্যবসার মোট টার্নওভার ৭০ লাখ টাকা পর্যন্ত করমুক্ত রাখার প্রস্তাব রাখা হলেও বাজেটে কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের (সিএমএসএমই) খাতকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সরাসরি নগদ সহায়তার প্রস্তাব দেওয়া হয়নি। এ খাতে পূর্বে ঘোষিত প্রণোদনার অর্থ বাস্তবায়নের ধীর অগ্রগতির কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা বাজেটে নেই। অথচ এখানেই সবচেয়ে বেশি মানুষ নিয়োজিত। করকাঠামোর বহুমুখীকরণে জোর দেওয়া হয়নি। রপ্তানি পণ্য ও বাজারের বৈচিত্র্য আনয়ন, অঞ্চল এবং খাতভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন করব্যবস্থা নিলে অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তর করা যেত। আগামীর অগ্রযাত্রা নির্মাণে বাজেটে এ ধরনের দিকনির্দেশনা অতীব প্রয়োজনীয় ছিল।

জনগণের অর্থে জনগণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা দরকার

বাজেটে জনগণের অর্থের ওপর জনগণের কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পুরো প্রক্রিয়াটিই আমলাতান্ত্রিক এবং নির্বাহী বিভাগের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে। সংশোধিত বাজেট নিয়ে আলোচনা না হওয়ায় জানা যায় না, কেন বাজেট বাস্তবায়িত হচ্ছে না। রোধন-তদারকি-জবাবদিহি তথা অর্থব্যবস্থার গণতন্ত্রায়ণের অনুপস্থিতি প্রকট। ফলে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে না।

অনেক তথ্য-উপাত্তের মধ্যেই সামঞ্জস্য নেই। অনেক পরিসংখ্যান হালনাগাদ করা হয়নি। সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা অবহেলিত। সবার জন্য টিকা পাওয়া অনিশ্চিত থাকলে অর্থনীতির চাকা ঘুরবে কীভাবে।

দুরবস্থা উত্তরণের সুনির্দিষ্ট কাঠামো ও পরিকল্পনা না থাকায় বাজেট গতানুগতিক গোষ্ঠীতান্ত্রিক স্বজনতোষী সংরক্ষণশীলতায় ঘুরপাক খাচ্ছে। অথচ অভিঘাত মোকাবিলায় সারা বিশ্ব সম্প্রসারণশীল নীতির ওপরই জোর দিচ্ছে। মুজিব শতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করাই হতো জনগণকে দেওয়া সবচেয়ে বড় উপহার। বাজেটে সর্বজনের খাতগুলো উপেক্ষিতই থেকে গেছে।

ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারপারসন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *