রেললাইনে রাজনীতির বাঁক

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা বন্ধু চিরকাল, রেললাইন বহে সমান্তরাল…।’ কিন্তু সুনামগঞ্জের রেললাইন গানের এই নির্বিঘ্ন যাত্রা পাচ্ছে না। এখানে দুই বন্ধুতে গোল লেগেছে। স্থানীয় রাজনীতির জটে পড়ছে রেললাইন। দুই বন্ধুর একজন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, অন্যজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। প্রথমজন সুনামগঞ্জের সাংসদ, পরেরজন সিলেট সদরের।

তবে ছাতক–সুনামগঞ্জ–মোহনগঞ্জ রেলপথ স্থাপন নিয়ে দুই বন্ধু মন্ত্রীর ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে ছড়ানো উত্তাপ আর যেন বাড়তে দিতে চান না তাঁরা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করেছেন। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, বিষয়টা এখানেই শেষ করা উচিত। তবে সুনামগঞ্জের মানুষের উদ্বেগ রয়ে গেল রেললাইন নিয়ে।

রেলপথ নিয়ে সিলেটের রাজনীতিতে ‘আফাল’ শিরোনামে গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। তাতে রেলপথটি কোন এলাকা দিয়ে যাবে, তা নিয়ে স্থানীয় সাংসদ ও পরিকল্পনামন্ত্রীর বিরোধিতাকারী জেলার পাঁচ সাংসদের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর যুক্ত হওয়ার বিষয়টি উঠে আসে। রাজনীতিঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা একে সিলেট বিভাগে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের চেষ্টা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।

রেলপথ ইস্যু নিয়ে প্রথমে সুনামগঞ্জের পাঁচ সাংসদের পক্ষে রেলপথমন্ত্রীকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চিঠি দেওয়া, পরে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া এবং ফেসবুকেই পরিকল্পনামন্ত্রী তার জবাব দেওয়ায় রাজনীতির স্তর ছাড়িয়ে বিষয়টি সামাজিকভাবে আলোচনায় আসে।

কিন্তু জট খুলেও যেন খুলল না। রেলপথমন্ত্রীকে লেখা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আধা সরকারি চিঠিতে (ডিও) বিষয় উল্লেখ আছে ছাতক–সুনামগঞ্জ–মোহনগঞ্জ রেলপথ স্থাপন। সুনামগঞ্জের সাংসদেরাও এই প্রকল্প নিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রীর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে গতকাল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, পাঁচ সাংসদ তাঁর কাছে এসেছেন ঢাকা–সিলেট ব্রডগেজ রেললাইন প্রকল্প ছাতক পর্যন্ত সম্প্রসারণ করতে রেলপথমন্ত্রীকে চিঠি দেওয়ার জন্য। সাংসদরা বলেছেন, তাঁরা গেছেন ছাতক-সুনামগঞ্জ রেলপথের বিষয়ে।

আমাদের কূটনৈতিক প্রতিবেদক জানান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেছেন, ঢাকা-সিলেট রেললাইন প্রকল্পের মধ্যে যে সুনামগঞ্জের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি রয়েছে, তা তাঁর জানা ছিল না। দীর্ঘদিনের বন্ধু পরিকল্পনামন্ত্রীর সঙ্গে ভুল–বোঝাবুঝি হওয়ায় তিনি দুঃখিত।

সাংসদদের পক্ষে রেলপথমন্ত্রীকে চিঠি দেওয়ার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ঢাকা-সিলেট রেললাইনকে ব্রডগেজ করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে, কিন্তু ব্যয় বেশি বলে তা স্থগিত আছে। রেলপথমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, পাহাড়ের মধ্য দিয়ে রেলপথ যাবে বলে গার্ডওয়াল দিতে হবে। সিলেটের নদীগুলো খরস্রোতা বলে সেতুগুলো চওড়া করতে হবে। সিলেটে ট্রেনের ডিপো করতে হবে। তাই ব্যয় বেশি। প্রাথমিকভাবে প্রকল্প‌টি ১৬ হাজার কোটি টাকার ছিল। ডিপোসহ কিছু বিষয় বাদ দিয়ে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা কমানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।’

তাঁর সঙ্গে যে আমার দ্বন্দ্ব লেগে গেল, তাতে আমি তাজ্জব। এখানে যে তাঁদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ছিল, সে সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল না।

এ কে আব্দুল মোমেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সম্প্রতি সুনামগঞ্জের পাঁচ সাংসদ আমার অফিসে আসেন। তাঁরা একটি আবেদনপত্র আনেন। তাঁরা ওই রেলপথকে ছাতক পর্যন্ত নেওয়ার কথা বলেন। আমি খুব সরল মনে ডিও পাঠিয়ে দিয়েছি। ওই ডিও এখন কন্ট্রোভার্সির (বিতর্ক) কারণ।’ তবে তিনি স্বীকার করেন, রেলপথমন্ত্রীকে চিঠি দেওয়ার আগে পরিকল্পনামন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কথা বলা উচিত ছিল। তিনি বলেন, ‘তাঁর সঙ্গে যে আমার দ্বন্দ্ব লেগে গেল, তাতে আমি তাজ্জব। আমি এ বিষয়ে ওনার সঙ্গে কথা বলব।’

জানতে চাইলে সাংসদ মহিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ছাতক-সুনামগঞ্জ রেলপথের বিষয়টি জানিয়ে অনুরোধ করি। আমরা পরিকল্পনামন্ত্রীকেও অনুরোধ করেছি। আমরা দুজনকেই সম্মান করি। কিন্তু পরিকল্পনামন্ত্রী যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, ত আশা করিনি।’

এসব বড় কোনো ইস্যু নয়। এটাকে এখানে শেষ করা উচিত। এখন যেটা হচ্ছে, সেটা চায়ের কাপে ঝড় তোলার চেষ্টা।

এম এ মান্নান পরিকল্পনামন্ত্রী

অন্যরা শঙ্কায় রেলপথ নিয়ে

জেলা বিএনপির সভাপতি বলেন, ‘দলের পক্ষে নয়, একজন নাগরিক হিসেবে বলব, ছাতক-সুনামগঞ্জ রেলপথের আলোচনা বহু পুরোনো। এটি আদৌ হবে কি না সন্দেহ। এখন যে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তাতে সন্দেহ আরও বাড়ছে। যাঁরা এসব করছেন, তাঁরা সবাই একই দলের লোক। তাঁদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকাশের হাতিয়ার বানাচ্ছেন রেলপথকে।’

জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক এনাম আহমেদ বলেন, রেলপথ সুনামগঞ্জ হয়ে মোহনগঞ্জ পর্যন্ত যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। শুরুতেই টানাটানি শুরু হলে প্রক্রিয়াটা বিলম্বিত হবে।

জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিশেষজ্ঞ কমিটির ওপর বিষয়টি ছেড়ে দেওয়া দরকার। এটা কারও ব্যক্তিগত ইগো বা প্রেস্টিজের বিষয় নয়। এ কারণে যদি রেল সুনামগঞ্জে না আসে, তাহলে আমরা মর্মাহত হব।’একই রকম মত দিয়েছেন জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সদস্য নির্মল ভট্টাচার্য।

রেলপথ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত সুনামগঞ্জের সাংসদ পীর ফজলুর রহমান বলেন, ‘পরিকল্পনামন্ত্রীকে আমরা সম্মান করি। ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ নেই। আমার কাছে যেটা যৌক্তিক মনে হয়েছে, সেটাই বলছি।’

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এনামুল কবির বলেছেন, ‘পরিকল্পনামন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী—দুজনই সম্মানিত মানুষ। জেলার পাঁচজন সাংসদ যে মত দিয়েছেন, তারও গুরুত্ব আছে। বিষয়টি নিয়ে বসে আলোচনা করা ভালো।’

পরিকল্পনামন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, কারও সঙ্গে তাঁর কোনো ঝগড়া বা দ্বন্দ্ব নেই। তিনি বলেন, ‘এটাকে এখানে শেষ করা উচিত। এখন যেটা হচ্ছে, সেটা চায়ের কাপে ঝড় তোলার চেষ্টা।’ তিনি বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী একটা পোস্ট দিয়েছিলেন, আমি তার জবাব দিয়েছি। এখানেই শেষ।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *