প্রণোদনা অব্যাহত রেখে চাঙা রাখতে হবে ব্যবসা-বাণিজ্য

facebook sharing button
messenger sharing button
twitter sharing button
pinterest sharing button
linkedin sharing button
print sharing button
বাজেট

এখনো আসন্ন ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাব নিয়ে সংসদে আলোচনা করছেন সংসদ সদস্যরা। সংসদের বাইরেও বিশেষজ্ঞ এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা তাদের বাজেটবিষয়ক পর্যালোচনা তুলে ধরছেন। নানা নীতি প্রস্তাবনাও হাজির করছেন। গণমাধ্যমও বসে নেই। শিগগির আসন্ন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট চূড়ান্ত হবে। এ পর্যায়ে আবারও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, এ প্রস্তাবিত বাজেটকে স্বাভাবিক সময়ের বিবেচনায় বিচার করা উচিত হবে না। করোনাজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি আর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অচলাবস্থার কারণে যে বিশেষ অবস্থার মধ্যে আমরা রয়েছি, তার আলোকেই নীতিনির্ধারকদের বাজেট প্রণয়ন করতে হয়েছে।

সে বিবেচনার জায়গা থেকে এটি মানতেই হবে যে, বিদ্যমান বাস্তবতার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখে আগামীর সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপায়ণের একটি ভারসাম্যপূর্ণ পথনকশা হাজিরের চেষ্টা করা হয়েছে এবারের বাজেট প্রস্তাবে। একদিকে করোনা চিকিৎসা আর সামাজিক সুরক্ষা দিয়ে মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা এবং অন্যদিকে শিল্প ও ব্যবসাবান্ধব কর প্রস্তাবের মাধ্যমে ব্যক্তি খাতের প্রসার ঘটিয়ে কর্মসংস্থান বাড়ানোর মাধ্যমে মানুষের আয় বৃদ্ধির প্রচেষ্টার বিষয়কে খাটো করে দেখা উচিত হবে না। প্রতিকূল এ পরিবেশে বাড়তি বাজেট ঘাটতি নিয়ে আলাপও বিবেচনাপ্রসূত নয়।

বরং মূল মনোযোগ দিতে হবে এ দ্বৈত কৌশলের সফল বাস্তবায়নের দিকে। আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকের শক্তিশালী অবস্থানের বিচারে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নে অন্তত অর্থ আমাদের জন্য কোনো চ্যালেঞ্জ হবে না। আসল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, এ অর্থের যথার্থ খরচের। বিশেষ করে এ সংকটকালে কী করে করোনাভাইরাসকে পরাজিত করা যায়, সেটিই মূল চ্যালেঞ্জ। সেজন্যই সবার দৃষ্টি এখন টাকা নয়, টিকার দিকে।

প্রস্তাবিত বাজেটে খাতওয়ারি বরাদ্দের ক্ষেত্রে বোধগম্য কারণে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে স্বাস্থ্যের জন্য দেওয়া প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এটি মোট বাজেটের ৫.৪ শতাংশ। দীর্ঘকাল স্বাস্থ্যে বরাদ্দ মোট বাজেটের ৫ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে বলে অনেকেই আশা করেছিলেন এবার অন্তত এটি ৭-৮ শতাংশ হবে। আমিও তাদের সঙ্গে একমত। এক্ষেত্রে আরেকটু উদার হওয়া যেত।

সম্ভবত স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ব্যয়ে দক্ষতার ঘাটতি, অপচয় ইত্যাদির বিবেচনায় এমন সতর্ক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে আমাদের জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার জন্য ব্যক্তি খাতের ওপর নির্ভরশীলতাটুকু বাজেটপ্রণেতাদের বিবেচনায় রয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবায় ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের জন্য দেওয়া কর প্রস্তাবগুলোকে খুবই সময়োপযোগী মনে হচ্ছে। তবে সেটি তো আগামী দিনের বিষয়। আজকের সংকট তো টিকে থাকার। বেঁচে থাকার। সেই সংগ্রামে সব খাতকে সচেষ্ট করার কোনো বিকল্প নেই।

বরাবরের মতো শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে যাচ্ছে বাজেটের সবচেয়ে বড় অংশ (প্রায় ১৬ শতাংশ)। চলতি বছরের তুলনায় বরাদ্দ এক-পঞ্চমাংশের বেশি বাড়িয়ে ৯৫ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। মহামারির কারণে শিক্ষা কার্যক্রম যে মাত্রায় ব্যাহত হয়েছে, তার বিবেচনায় এ বরাদ্দ বৃদ্ধিকে স্বাগত জানাই। তবে বাড়তি বরাদ্দ কোথায় কীভাবে ব্যয় হবে, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে এগোতে হবে।

বিশেষত ‘ডিজিটাল ডিভাইডে’র কারণে যেন দরিদ্র শিক্ষার্থীরা কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে না পড়ে সেদিকে সতর্ক নজর রাখা চাই। শিক্ষা খাতে যে ক্ষতি এরই মধ্যে হয়ে গেছে, তা পূরণ করা মোটেও সহজ হবে না। তাই এ খাত নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তা করতে হবে নীতিনির্ধারকদের। বিশেষ করে সংকট মোকাবিলার সময় যে দক্ষতা ও পুনঃদক্ষতা অর্জনের দরকার সেদিকে নজর দিতে হবে।

সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। এতে মহামারিজনিত অর্থনৈতিক অচলাবস্থায় বিপাকে পড়া মানুষ বেশ খানিকটা সুরক্ষা পাবেন। তবে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচিগুলোর ব্যাপ্তি বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন নতুন কর্মসূচি নিয়েও ভাবা দরকার। বিশেষ করে নগরাঞ্চলের হতদরিদ্ররা কিন্তু এখনো সরকারি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর আওতায় সেভাবে আসেননি।

করোনার চিকিৎসা ব্যয় সামাল দিতে গিয়ে দরিদ্ররা তো বটেই, এমনকি মধ্যবিত্তদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশও হিমশিম খাচ্ছে। বাড়তি স্বাস্থ্য ব্যয়ের এ চাপ থেকে মানুষকে রক্ষা করতে করোনার চিকিৎসা যারা বেসরকারি সেবাকেন্দ্রে নিচ্ছেন, তাদের জন্য একটি ভাউচার স্কিম অন্তত পাইলট ভিত্তিতে চালু করা দরকার। সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমা এবং পেনশন স্কিম নিয়েও আমাদের এগোনো দরকার।

করোনাজনিত অর্থনৈতিক ধাক্কা মোকাবিলায় কৃষি যে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে, বাজেট প্রণয়নের সময় নীতিনির্ধারকরা সে বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন থেকেছেন বলেই মনে হয়েছে। তাই ৭.৩ শতাংশ বেড়ে কৃষিতে বরাদ্দ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা। স্থানীয় সরকার ও পল্লি-উন্নয়ন খাতে দেওয়া উন্নয়ন বরাদ্দ মোট উন্নয়ন বাজেটের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। এর সুফলও পাবে মূলত কৃষি খাতই। এছাড়া নতুন করে প্রতিটি ইউনিয়নে ৩২টি সবজি পুষ্টি বাগান এবং ১০০টি করে পারিবারিক পুষ্টি বাগান করার যে কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে, তা একদিকে গ্রামীণ পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক শক্তি বাড়াবে, অন্যদিকে দেশের সার্বিক খাদ্য নিরাপত্তা সুসংহত করতেও কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

‘রিজিওনাল সার্ক সিড ব্যাংক’ও একটি দূরদর্শী উদ্যোগ। কৃষির যান্ত্রিকীকরণ এবং গবাদি পশু ও ডেইরি উন্নয়নের জন্য যে প্রকল্প বরাদ্দ রয়েছে তা-ও এ খাতকে টেকসই প্রবৃদ্ধি দিতে সহায়ক হবে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে বিপুল অঙ্কের ভর্তুকি প্রদান এবং দেশের ভেতরে কৃষকের পছন্দের যন্ত্রপাতি তৈরির জন্য সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ প্রশংসার দাবি করে। একইভাবে দেশীয় শিল্পোন্নয়নে বাড়তি কর সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগটিও প্রশংসনীয়। দেশেই মোটরগাড়ি উৎপাদনের প্রস্তাবটি দূরদর্শী। এ শিল্পের হাজার হাজার খুচরা যন্ত্র তৈরির কাজে নিশ্চয়ই অনেক এসএমই যুক্ত করা সম্ভব হবে।

সার্বিক বিচারে বলা যায়, একই সঙ্গে স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি থেকে মানুষকে রক্ষা করা এবং ব্যক্তি খাতের বিকাশের মাধ্যমে মানুষের আয় বৃদ্ধির যে দ্বৈত কৌশল প্রস্তাবিত বাজেটে নেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবমুখী ও ভারসাম্যপূর্ণ। এ লক্ষ্যগুলো নিশ্চয়ই অর্জনযোগ্য।

তবে বিভিন্ন অংশীজনের আলোচনা-সমালোচনা এবং বাজেট প্রস্তাব ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনার গভীরতর বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই বাজেটের প্রস্তাবনাগুলোকে আরও সুবিন্যস্ত ও সুসংহত করার সুযোগ এখনো রয়েছে। আমরা নিশ্চিত, সরকারেরও তেমন সদিচ্ছা রয়েছে। তাই মাসের শেষে আসন্ন অর্থবছরের বাজেট চূড়ান্ত করার আগে নীতিনির্ধারকদের বিবেচনার জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব সামনে আনতে চাই। সবদিক বিবেচনায় নিয়েই তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।

১. স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির মধ্যমেয়াদি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মেয়াদকালেই এ খাতে বরাদ্দের অনুপাত মোট বাজেটের শতাংশ হিসাবে অন্তত ১০-১২ শতাংশে উন্নিত করা চাই। তবে কেবল বরাদ্দ বৃদ্ধিতে আটকে না থেকে কাঠামোগত পরিবর্তনেও মনোযোগ দিতে হবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় মোট স্বাস্থ্য বাজেটের মাত্র ২৫ শতাংশ যাচ্ছে। এ অনুপাত মধ্যমেয়াদে ৩৫-৪০ শতাংশ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। আবার বিনা মূল্যে বা ভর্তুকি মূল্যে ওষুধের খরচ আসে যে উপখাত থেকে, সেই ‘মেডিকেল ও সার্জিকেল সাপ্লাই’ উপখাতে বর্তমানে মোট স্বাস্থ্য বাজেটের ২০ শতাংশ দেওয়া হয়।

এ অনুপাতও বাড়িয়ে ২৫-৩০ শতাংশ করা চাই। তা করা গেলে দরিদ্র মানুষের পকেট থেকে ওষুধ কেনার খরচ কমানো যাবে। মোট কথা, বাড়তি বরাদ্দ কোথায় কীভাবে ব্যয় হবে, সেই অগ্রাধিকার যথাযথভাবে নির্ধারণ করতে হবে। উপেক্ষিত স্বাস্থ্য গবেষণার দিকে মনোযোগ বাড়ানোর সময়ও কিন্তু চলে যাচ্ছে। সক্ষমতার অভাব থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারত্বের সংস্কৃতি গড়ে তোলার দিকে সরকারকে হাঁটতে হবে।

২. শিল্প ও ব্যবসাবান্ধব কর প্রস্তাবগুলোকেই প্রস্তাবিত বাজেটের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশীয় শিল্পের বিকাশের জন্য কর অবকাশ, করছাড়সহ নানাবিধ ইতিবাচক উদ্যোগ উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করবে। ছোট আর নতুন উদ্যোক্তারা যেন এসব সুবিধা বেশি বেশি পান, তা নিশ্চিত করতে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য অংশীজনকে।

মনে রাখতে হবে, এবারের বাজেটের সাফল্য বহুলাংশে নির্ভর করছে ব্যবসা-বাণিজ্য আমরা কতটা সহজ করতে পারলাম তার ওপর। ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ স্লোগানটি সামনে আনতেই এমন ব্যবসাবান্ধব নীতি গৃহীত হয়েছে। এ স্লোগানটিকে আরও বেশি সামনে আনতে পারলে বিশ্ববাজারে আমাদের অবস্থান আরও মজবুত হবে। দেশেও দক্ষ জনশক্তির বিকাশ ঘটবে।

৩. সার্বিক বিচারে কর প্রস্তাবগুলো সময়োপযোগী হলেও কিছু কিছু কর প্রস্তাব পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। করোনাকালে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্রোভাইডারগুলো অর্থনীতিকে সচল রাখতে এবং প্রান্তিক মানুষের কাছে টাকা পৌঁছাতে ব্যাপক কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে এদের পুরস্কৃত করার বদলে যেন একরকম শাস্তিই দেওয়া হয়েছে। এদের আয়ের ওপর করারোপের প্রস্তাবটি অন্তত এ সংকটকালের জন্য থামিয়ে রাখা উচিত। আমাদের বিশ্বাস, বাজেটটি চূড়ান্ত করার আগে মাননীয় নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়টি আবারও ভেবে দেখবেন।

৪. আমাদের জনগণ কিন্তু শিক্ষার জন্য, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য এখন একটি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভর করে থাকেন। করোনাকালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষগুলো এমনিতেই চাপে পড়েছে। এ অবস্থায় তাদের আয়ের ওপর করারোপ সময়োচিত মনে হচ্ছে না।

এ বিষয়টিও বাজেট পাশের আগে পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। নীতিনির্ধারকদের ভুলে গেলে চলবে না, মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশও কিন্তু এখন উচ্চশিক্ষার জন্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে। আর করোনা তাদের জীবন-জীবিকাকেই বেশি চাপের মধ্যে ফেলেছে।

৫. তামাকের ওপর করের প্রস্তাবগুলোও একইভাবে পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। বিশেষজ্ঞ ও তামাকবিরোধী অ্যাক্টিভিস্টদের পক্ষ থেকে সব তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর এবং তার ওপর সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপের যে প্রস্তাব করা হয়েছিল, বাজেটে তার প্রতিফলন ঘটেনি। কিন্তু এগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে ২০ লাখ মানুষকে ধূমপান থেকে বিরত করা যেত, পাশাপাশি ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত করও পাওয়া যেত।

বাজেট অধিবেশনেই এখন পর্যন্ত অনেক সংসদ সদস্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর না বাড়িয়ে তামাকপণ্যের ওপর কার্যকর করারোপের এ প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের পক্ষে মত দিয়েছেন। তামাকপণ্য সেবনের সঙ্গে ফুসফুসের ক্ষতির সম্পর্ক আছে। আর এর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রয়েছে করোনার। তাই ২০৪০ সাল নাগাদ তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার পাশাপাশি করোনা সংকট মোকাবিলার লক্ষ্যে তামাকপণ্যের ওপর বেশি করে করারোপ খুবই প্রাসঙ্গিক হবে।

৬. কৃষিতে প্রশংসনীয় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ভর্তুকির পাশাপাশি করছাড়ের সুবিধাগুলোও কৃষির টেকসই বিকাশে সহায়ক হবে। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণও কৃষির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বাজেট প্রস্তাবে এ দিকগুলোয় মনোযোগ দেওয়া দরকার। মনে রাখতে হবে, বিদেশ থেকে যে প্রবাসী শ্রমিকরা দেশে ফিরেছেন তাদের অনেকেই হয়তো কাজে ফিরতে পারবেন না। নগর থেকে কাজ হারিয়ে গ্রামে ফেরাদের একটি অংশের ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য।

তাদের শ্রমকে যাতে কৃষিতে বিনিয়োজিত করা যায়, সেজন্য আরও ভাবা চাই। শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা কৃষি খাতে উদ্যোক্তা হিসাবে যোগ দিলে এ খাত আরও এগোবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫০০ কোটি টাকার যে স্টার্টআপ তহবিল আছে, সেখান থেকে এ নতুন উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন করা যেতে পারে। একই তহবিল থেকে প্রতিটি জেলায় ১০-২০ জন মডেল নারী উদ্যোক্তাকেও অর্থায়ন করার উদ্যোগ নেওয়া যায়।

জেলা পর্যায়ের উইমেন চেম্বারগুলো এক্ষেত্রে সমন্বয় করতে পারে। তাদের জন্য সামাজিক গ্যারান্টর হতে পারে। এর পাশাপাশি আরও সহজ করে গ্রামীণ খুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের সুবিধা কীভাবে দেওয়া যায়, সে বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের ভাবার সময় যে বয়ে যাচ্ছে।

৭. গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলো সব সতর্কতা অবলম্বন করে চালু রাখার যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে, তার সুফল আমরা ইতোমধ্যে পেতে শুরু করেছি। রপ্তানি আগের ধারায় ফিরছে। উন্নত দেশগুলোয় টিকা ব্যাপক হারে দেওয়ার কারণে ওইসব দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে চাঙাভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। তাই আমাদের প্রধান প্রধান রপ্তানি পণ্যের চাহিদা বাড়তে শুরু করেছে। তবে কারখানায় নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলেও নারী শ্রমিকদের বাসস্থানে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ কিন্তু রয়েই গেছে।

চার-পাঁচটি কারখানার শ্রমিকদের আবাসনের জন্য ক্লাস্টার ভিত্তিতে মানসম্পন্ন আবাসনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে এ লক্ষ্যে কারখানা মালিকদের দুই শতাংশ সুদে অর্থায়ন পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাদের এ বিষয়ে আরও আগ্রহী করে তোলা দরকার।

ব্যয় বাড়াতে হবে সেটি ঠিক। কিন্তু আমরা যে আমাদের সরকারি আয় বাড়াতে পারছি না, সে সত্যটিও মানতে হবে। রাজস্ব বোর্ডকে আরও তৎপর করা তাই খুবই দরকার। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ দ্রুততম সময়ে নিলে আসন্ন অর্থবছরেই এসবের সুফল পাওয়া যেতে পারে-(ক) ট্যাক্স রিটার্ন দাখিলের প্রক্রিয়াটি পুরো অটোমেশন করা দরকার, যাতে অনলাইনে সহজেই রিটার্ন দাখিল করা যায়; (খ) আয়কর মামলার জট খুলতে এডিআর তথা বিকল্প সালিশি ব্যবস্থা চালু করার পাশাপাশি দক্ষ আইনজীবীদের প্যানেল নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে মামলার নিষ্পত্তি করে বিপুল অঙ্কের বকেয়া কর আদায় করা সম্ভব; (গ) ভ্যাট আদায় বাড়াতে ভ্যাট আদায়ের ডিভাইস বিনা মূল্যে বা কিস্তিতে খুদে ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের দেওয়া যেতে পারে। যে ব্যবসায়ীরা এটি ব্যবহার করবেন, তাদের আদায়কৃত ভ্যাটের ১০ শতাংশ প্রণোদনা হিসাবে দিলে সুফল পাওয়া যাবে; এবং (ঘ) একটি বা দুটি কর অঞ্চলকে মডেল অঞ্চল ঘোষণা করে সেখানকার সবাই যেন টিআইএন নম্বরধারী হন সেজন্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে তাদেরও প্রণোদনার আওতায় আনা যায়।

টিআইএনধারীদের হোল্ডিং ট্যাক্স বা অন্য নাগরিক করের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া যেতে পারে। তাদের জন্য ওই এলাকার অবকাঠামোর উন্নয়ন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করে উদাহরণ সৃষ্টি করা যেতে পারে। তখন অন্য করাঞ্চলের অধিবাসীরাও স্বেচ্ছায় সহজে কর দেওয়ার অনুপ্রেরণা খুঁজে পাবেন। একটু ‘আউট অব দ্য বক্স’ ভেবে প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হলে কর আহরণের দক্ষতা বহুগুণে বাড়ানো সম্ভব। এখানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী সমিতি তথা কমিউনিটিকে যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া গেলে কর প্রদানে জন-আগ্রহ নিশ্চয়ই বাড়ানো সম্ভব। কর প্রদান দেশপ্রেমের অংশ-এ স্লোগানটি জনপ্রিয় করা গেলে নিশ্চয়ই এক্ষেত্রে জন-অংশগ্রহণ বাড়বে।

করোনাজনিত অর্থনৈতিক স্থবিরতার মধ্যে সরকারের রাজস্ব আয় বোধগম্য কারণেই চাপের মধ্যে পড়েছে। আগামী দিনেও এ চাপ থাকবে। চলতি বছরে এ কারণে বাজেট কাটছাঁট করতে হয়েছে। আর বাজেট কাটছাঁট করার সময় প্রথমেই এর প্রভাব পড়ে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষার মতো সফট সেক্টরগুলোর ওপর। আগামী দিনে যেন এমন না হয়, তার জন্য সতর্ক থাকতে হবে। এ বছর বরং এসব খাতে কী করে আরও বেশি বরাদ্দ দেওয়া যায় সে কথা ভাবতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন হলে বাজেট ঘাটতি আরেকটু বাড়ে বাড়ুক। এ মুহূর্তে মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা তেমনটি নেই।

আর তা মাথা তুলতে চাইলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার যথেষ্ট ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আছে। তাই এখনই এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। এখন বরং ভাবতে হবে প্রণোদনা অব্যাহত রেখে কী করে করোনাভাইরাসকে পুরোপুরি পরাজিত না করা পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্যকে চাঙা রাখা যায়। আর আমি মনে করি, এ মুহূর্তে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি যে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তাতে বাজেট ঘাটতি বাড়িয়ে কিছুটা হলেও সম্প্রসারণমূলক রাজস্ব ও মুদ্রানীতি অব্যাহত রাখার কোনো বিকল্প নেই। বাজেট ঘাটতি নিয়ে এখনই অত ভাবিত হওয়ার দরকার নেই।

স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষার মতো খাতগুলোয় প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিতে বাজেট ঘাটতি আরও দশমিক পাঁচ কিংবা পুরো এক শতাংশ বাড়ালেও খুব বড় সংকট তৈরি হবে না। মনে রাখা চাই, সময়টা খুবই অস্বাভাবিক ও অনিশ্চিত। তাই বাজেটের রূপরেখাকেও স্বাভাবিক কাঠামোর মধ্যেই ধরে রাখতে হবে এমন কোনো কথা নেই। সময়টা এখন যে কোনো মূল্যে জীবন ও জীবিকা সংরক্ষণের। তাই বাজেটপ্রণেতাদের গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে আরেকটু সাহসী হতে দোষের কিছু নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *