জ্যারড কিম্বারের বিশ্লেষণ
টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশই সবচেয়ে ধীরগতিতে রান তোলে
মুশফিকুর রহিম গতকাল পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ইনিংস খেলার পর তাঁকে নিয়ে সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে আবার আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। এর বাইরে আরেকটি কথাও বলেছেন, যে কথায় বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ব্যাটিংয়ের দুর্বলতা উঠে এসেছে, ‘আমি কাইরন পোলার্ডের মতো নই যে দু-তিন বল পেলেই মারব। আমারও একটু সময় লাগে।’
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে নেমেই ছক্কা-চার হাঁকাতে পারেন, এমন ব্যাটসম্যানের কদর বেশি। মুহূর্তের মধ্যে ম্যাচের রং বদলে দিতে পারেন এমন ব্যাটসম্যান। কিন্তু বাংলাদেশের মূল ব্যাটিং–ভরসা যাঁরা, তাঁরা সবাই মুশফিকের মতোই, প্রথমে একটু থিতু হন সবাই। বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ব্যাটিং নিয়ে দারুণ একটি বিশ্লেষণ করেছেন জ্যারড কিম্বার। বর্তমানে ক্রিকইনফোতে কাজ করা এই বিশ্লেষক পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশই সবচেয়ে ধীরগতির ব্যাটিং করে। তাঁর ওয়েবসাইট থেকে বাংলাদেশকে নিয়ে লেখা বিশ্লেষণ পাঠকদের সুবিধার্থে এখানে তুলে ধরা
সফরে গেলে টি-টোয়েন্টিতে ভালো করে না বাংলাদেশ।
বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যে গত পাঁচ বছরে ঘরে ও প্রতিপক্ষের মাঠে অন্তত ১০ ম্যাচ খেলেছে, এমন দলগুলোর তালিকা দিয়েছি এখানে এবং আমি দেখাচ্ছি, কারা প্রতিপক্ষের মাঠের চেয়ে ঘরের মাঠে বেশি ভালো করে।
দেখা যাচ্ছে, এখানে পাকিস্তানই সবচেয়ে খারাপ। কিন্তু এর কারণ, তারা ঘরের মাঠে খুবই ভালো। নিজেদের মাঠে তাদের জয়-পরাজয়ের অনুপাত ২.৬ বলেই এমন দেখাচ্ছে। তারা প্রতিপক্ষের মাঠেও খারাপ নয়। বাংলাদেশের ঘরের মাঠে জয়-পরাজয়ের অনুপাত ১.৬। আর প্রতিপক্ষের মাঠে সেটা ০.৪৬৬। অর্থাৎ প্রতিটি জয়ের বিপরীতে দুটি হার।
প্রতিপক্ষের মাঠে তাদের পারফরম্যান্সের একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ওরা ঘরের চেয়ে বাইরেই বেশি রান করে। বাইরে হারে এবং ঘরে ভালো করে, এমন রেকর্ডের এক দলের ক্ষেত্রে আপনি এটা আশা করেন না। ঘর ও প্রতিপক্ষের মাঠের ব্যাটিংয়ে নিউজিল্যান্ডের পার্থক্য অনেক বড়। কিন্তু সেটা যুক্তিসংগত, ওরা ঘরের মাঠে দুর্দান্ত আর বাইরে একদম বাজে।
বাংলাদেশ প্রতিপক্ষের মাঠে হারে, কিন্তু ঘরের মাঠের তুলনায় ওভারপ্রতি ১ রানের বেশি তোলে। এমনকি উইকেটপ্রতি রানেও তারা বাইরে ভালো। এটা আসলেই চমকপ্রদ। এটা সত্যি, অধিকাংশ দল খুব বেশি টি-টোয়েন্টি খেলে না এবং পূর্ণশক্তির দল নিয়ে খুব কমই নামে; তবু বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের কথা চিন্তা করলে, এটা খুবই ধীরগতির। এবং তারাই একমাত্র দল, যারা প্রতিপক্ষের মাঠের চেয়ে ঘরে কম গতিতে রান করে। তাই মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, এটা কেন হয়।
ঘর ও প্রতিপক্ষের মাঠের পারফরম্যান্স যোগ করলে এই বিশ্বকাপে শুধু ওমান ও শ্রীলঙ্কাই বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে ভালোই ভোগে। স্কটল্যান্ডের সঙ্গে হারার ম্যাচে বা ওমানের সঙ্গে জেতা ম্যাচে এটা পরিষ্কার দেখা গেছে। তাদের টপ অর্ডার দারুণ গতিতে বল নষ্ট করে এবং তাদের শেষ দিকে বড় শট খেলার ব্যাটসম্যান তৈরি হয়নি।
কিন্তু বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলা অন্য জায়গায় ক্রিকেট খেলার চেয়ে একদম ভিন্ন। আপনি বলতে পারে, নিউজিল্যান্ডও এমন এক জায়গা। কিন্তু নিউজিল্যান্ডে ক্রিকেট খেললে আপনি টি-টোয়েন্টিতে দরকার, এমন দক্ষতা অর্জন করবেন। আর এই বিশ্বকাপ তো অস্ট্রেলিয়া বা ভারতে হওয়ার কথা ছিল। আর এই দুই ভেন্যুই দ্রুত রান তোলার জায়গা। আর বাংলাদেশে এর পুরো উল্টো।
কিন্তু এখানেই মজার একটি ব্যাপার ঘটেছে। মাত্র দুটি জায়গা আছে, যেখানে বাংলাদেশের মতো রান তোলা যায় না বা টিকে থাকা যায় না। একটা ওমান, যেখানে বাংলাদেশ প্রথম পর্ব খেলেছে। আরেকটি হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত, যেখানে বিশ্বকাপের বাকি অংশ হচ্ছে।
বাংলাদেশের জন্য এটাই একমাত্র সুবিধা নয়। যেখানে অনেক দলই প্রস্তুতি ম্যাচ কাজে না লাগিয়ে সময় নষ্ট করেছে। বাংলাদেশ সেখানে তিনটি ভালো প্রস্তুতি ম্যাচ পেয়েছে। স্কটল্যান্ডের কাছে হারটাও ওদের জাগিয়ে তুলেছে। ওরা যদি কখনো ভালো করে, এটাই উপযুক্ত সময়।
অথচ একসময় মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টিতে ভালো হয়ে উঠছে। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে (বিপিএল) ক্রিকেট অঙ্গনে খুব ভালো টুর্নামেন্ট হিসেবে দেখা হচ্ছিল। প্রচুর অর্থ আসছিল, বিগ ব্যাশ বাদ দিয়ে অনেক ক্রিকেটার খেলতে যাচ্ছিলেন। এবি ডি ভিলিয়ার্স ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেরা খেলোয়াড়েরাও সেখানে যেতেন।
সব মালিক হয়তো ভালো ছিলেন না, কিন্তু কেউ কেউ আধুনিক চিন্তাধারার ছিলেন এবং মনে হচ্ছিল এই লিগ ভালো করবে। বিসিবি এই লিগের নিয়ন্ত্রণ নিল। এর কী প্রভাব হবে, তা বলার সময় এখনো আসেনি। কিন্তু এই মুক্তবাজার বাংলাদেশকে নতুন এক যুগে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বিসিবি সেটা থেকে সরে এসেছে।
তারা বেশ কিছু অদ্ভুত নিয়ম করেছিল, যেমন সবাইকে লেগ স্পিনার নিতে বাধ্য করা। মনে হচ্ছিল, তারা ঠিক জানে না, আসলে কী দরকার। তারা শুধু নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছে এবং তাদের বুদ্ধি–পরামর্শ যারা আসলেই টাকা বিনিয়োগ করছে, তাদের চেয়ে ভালো। হয়তো তারাই ঠিক, কিন্তু কে নিয়ন্ত্রণে আছে, সেটা এক পাশে সরিয়ে রাখলেও আগের সমস্যাই রয়ে গেছে—বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা টি-টোয়েন্টিতে রান করতে পারেন না।
গত পাঁচ বছরে সব ধরনের টি-টোয়েন্টির সর্বোচ্চ রান করা ২০০ ব্যাটসম্যানকে স্ট্রাইক রেট অনুযায়ী সাজানো হয়েছে। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের সবুজ রং দিয়ে দেখানো হয়েছে।
আমি জানতাম তাঁরা নিচের দিকে থাকবেন, কিন্তু এটা হাস্যকর রকম বাজে অবস্থা। এখানে আরও একটি সমস্যা আছে। এ তালিকায় এত কম বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান আছেন, এটাও বড় সমস্যা। আর এর কারণ, তাঁরা সবাই ধীরগতির।
এটা বোঝার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, ক্রিকেট গিক (ওয়েবসাইট) বিভিন্ন ধরনের ব্যাটসম্যানের ব্যাখ্যায় যা বলেছিল, সেটা ব্যবহার করা। এই গ্রাফের বাঁদিকে উঁচুতে আছেন স্ট্রাইক বদলানো ব্যাটসম্যান, যাঁরা মূলত মিডল অর্ডারে খেলেন। ডানের তলানিতে থাকা ব্যাটসম্যানরা হলেন চার-ছক্কা মারার বিশেষজ্ঞ, ইনিংসের শুরুতে হোক বা শেষে। বাঁয়ের নিচে থাকা ব্যাটসম্যানরা হলেন আগুনে ব্যাটসম্যান, যাঁরা খুব বেশি ডট বল না দিয়েই চার–ছক্কা মারতে পারেন। আর ডান দিকের উঁচুতে থাকা ব্যাটসম্যান হলেন ধীরগতির। তাঁরা যে ইনিংসকে থিতু করতে এমন করছেন, তা–ও নয়; তাঁরা আসলেই ধীরগতির ব্যাটসম্যান।
সবুজ রঙের বিন্দুগুলো বাংলাদেশের খেলোয়াড়, তাঁরা চার-ছক্কা মারেন না, তাঁরা প্রান্ত বদল করেন না, তাঁরা শুধু নিকোলাস কেজ (হলিউড তারকা) যেভাবে দৃশ্য চিবিয়ে খান, সেভাবে বল খেয়ে ফেলেন।
আর বিপিএল খুবই ধীরগতির টুর্নামেন্ট। গত পাঁচ বছরে তারা চারটি টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছে। এর মধ্যে মাত্র একটিতে ওভারপ্রতি ৮ রানের বেশি ছিল। শীর্ষ লিগগুলোতে, সব মিলিয়ে ২৯টি টুর্নামেন্ট হয়েছে। এর মধ্যে আটটিতে ওভারপ্রতি ৮ রানের কম হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি বিপিএলের। পাকিস্তান সুপার লিগ বা ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগও মাঝেমধ্যে ধীরগতির হয়। কিন্তু বিপিএলে প্রায় সব সময় ধীরগতিতে রান তোলে। এটাই পার্থক্য।
এর মানে আমরা জানি, বিপিএল ধীরগতিতে রান তোলার একটি লিগ এবং আন্তর্জাতিক ম্যাচেও এখানে উইকেটে রান তোলা কঠিন। আর এ কারণে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরাও ধীরগতির। নিচে বিপিএলে গত কয়েক বছরে অন্তত ৪০০ রান করেছেন, এমন ব্যাটসম্যানের অবস্থা (গড় ও স্ট্রাইক রেটের তুলনা) দিলাম। লাল বিন্দুগুলো বাইরের খেলোয়াড়, সবুজগুলো বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান।
আমি ভেবেছিলাম, হয়তো তাঁদের দেশের উইকেটের কারণেই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের অবস্থা এমন দেখায়। সেখানে হওয়া আন্তর্জাতিক ম্যাচ তো এমনটাই দেখায়। এখন আমার মনে হচ্ছে, এমন উইকেটে খেলে বড় হওয়ার কারণে স্বাধীনভাবে শট খেলা শিখছেনই না। ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের সবুজ উইকেটের কারণে একসময় এমন অভিযোগ করা হতো।
আর বাংলাদেশ দলের সফরে ভালো না করাটাও স্বাভাবিক। তারা টি-টোয়েন্টি এমনভাবে খেলে, যা অন্য কোথাও খেলা হয় না। এমন কন্ডিশনের কারণেই সাকিব আল হাসানের মতো অসাধারণ এক অলরাউন্ডারের জন্ম হয়েছে এবং মোস্তাফিজুর রহমানের মতো বিরল একজনের দেখা মিলেছে; কিন্তু এর ফলে এমন কিছু ব্যাটসম্যান সৃষ্টি হয়েছে, যাঁরা দ্রুত রান তুলতে পারেন না।
কিন্তু যা মনে হচ্ছে, এবার খুবই কম রানের এক বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে। আপাতত খুবই কম স্কোরের টুর্নামেন্ট বলেই মনে হচ্ছে একে এবং যে আইপিএল হয়েছে, সেখানেও রান কম হয়েছে। বিশ্বকাপের বাছাইপর্বেও সেটা হয়েছে। এর মানে এটা নয় যে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিতবে বা ধারেকাছে যাবে। কিন্তু এর মানে নিজেরা কোনো টুর্নামেন্ট আয়োজন না করলে, এবারের মতো নিজেদের সঙ্গে যায় এমন কোনো কন্ডিশনে আবার খেলতে আরও বহুদিন অপেক্ষা করতে হবে তাদের।
এবারের বিশ্বকাপ কম রানের টুর্নামেন্ট হবে বলে মনে হচ্ছে এবং বাংলাদেশ কম রান তোলা দল। ফলে শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে দ্বিতীয় পর্ব শুরু করাটা তাই খুবই বাজে ফল।