কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন আর নেই
কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন মারা গেছেন। বার্ধক্যজনিত কারণে রোববার বিকেলে তার মৃত্যু হয় (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।
কথাসাহিত্যে অনবদ্য অবদানের জন্য তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলা একাডেমিসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। বিকেলে রাবেয়া খাতুনের মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়লে দেশের সাহিত্য ও শিল্পসংস্কৃতি অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে।
তার মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক প্রকাশ করেছেন। পৃথক শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী রাবেয়া খাতুনের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
বাংলা সাহিত্যে উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম রাবেয়া খাতুন। দীর্ঘ কর্মময় জীবনে তিনি সাহিত্যের সব শাখায় সফলভাবে বিচরণ করেছেন। উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, কিশোর উপন্যাস, স্মৃতিকথাসহ চলচ্চিত্র ও নাট্যজগতেও বিচরণ রাবেয়া খাতুনের। তার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘মেঘের পরে মেঘ’ অনুসরণে নির্মিত হয়েছে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র। তার অমর সৃষ্টি ‘মধুমতি’ ও ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’ও প্রশংসিত হয়েছে সব মহলে।
রাবেয়া খাতুন উপন্যাস লিখেছেন ৫০টিরও বেশি। এ পর্যন্ত চার খণ্ডে সংকলিত ছোটগল্প সংখ্যায় চারশর বেশি। ছোটদের জন্য লেখা গল্প-উপন্যাসও সংখ্যায় কম নয়। রাবেয়া খাতুন বাংলাদেশের ভ্রমণ-সাহিত্যের প্রধানতম লেখক। প্রথম উপন্যাস ‘মধুমতি’ (১৯৬৩) প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই শক্তিমান কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিতি পান। ক্ষয়িষ্ণু তাঁতি সম্প্রদায়ের জীবনসংকট ও উঠতি মধ্যবিত্ত জীবনের অস্তিত্ব জিজ্ঞাসার মধ্যে ব্যক্তিকে আবিস্কার করেছিলেন রাবেয়া খাতুন এই উপন্যাসে। তিনি ভ্রমণ-সাহিত্য রচনাকে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচনা করেছেন বলে এই সাহিত্যের বইও অনেক। বেশ কিছু আত্মজৈবনিক স্মৃতিমূলক রচনা লিখেছেন। ‘একাত্তরের ৯ মাস’ (১৯৯০) বইয়ে লিখেছেন একাত্তরের শ্বাসরুদ্ধকর দিনগুলোর কথা। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা একশরও বেশি।
তার লেখনী বাংলা সাহিত্যকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি ভূষিত হয়েছেন অসংখ্য পুরস্কারেও। সাহিত্যচর্চার জন্য পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন একুশে পদক (১৯৯৩), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৩), নাসিরুদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯৫), হুমায়ূন স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৯), কমর মুশতারী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৯৪), শের-ই-বাংলা স্বর্ণপদক (১৯৯৬), ঋষিজ সাহিত্য পদক (১৯৯৮), লায়লা সামাদ পুরস্কার (১৯৯৯) ও অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৯)। ছোটগল্পের জন্য পেয়েছেন নাট্যসভা পুরস্কার (১৯৯৮)। সায়েন্স ফিকশন ও কিশোর উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন শাপলা দোয়েল পুরস্কার (১৯৯৬)। আরও পেয়েছেন অতীশ দীপঙ্কর পুরস্কার (১৯৯৮), ইউরো শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০০৩)।
টিভি নাটকের জন্য পেয়েছেন টেনাশিনাস পুরস্কার (১৯৯৭), বাচসাস (বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি) পুরস্কার, বাংলাদেশ কালচারাল রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন মিলেনিয়াম অ্যাওয়ার্ড (২০০০), টেলিভিশন রিপোর্টার্স অ্যাওয়ার্ড (২০০০)।
লেখালেখির পাশাপাশি শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতাও করেছেন রাবেয়া খাতুন। সাংবাদিকতার সঙ্গেও দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন। ইত্তেফাক, সিনেমা পত্রিকা ছাড়াও তার নিজস্ব সম্পাদনায় পঞ্চাশ দশকে বের হতো মাসিক পত্রিকা ‘অঙ্গনা’। এ ছাড়া বাংলা একাডেমি, চলচ্চিত্র জুরি বোর্ড, লেডিস ক্লাব, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ, মহিলা সমিতিসহ অসংখ্য সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রাবেয়া খাতুন।
১৯৩৫ সালে ঢাকার বিক্রমপুরে জন্ম রাবেয়া খাতুনের। তার বাবা মৌলভি মোহাম্মদ মুল্লুক চাঁদ এবং মা হামিদা খাতুন। আরমানিটোলা বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা (বর্তমানে মাধ্যমিক) পাস করেন ১৯৪৮ সালে। ১৯৫২ সালের ২৩ জুলাই দেশের চলচ্চিত্রবিষয়ক প্রথম পত্রিকা ‘সিনেমা’র সম্পাদক এ টি এম ফজলুল হকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এ টি এম ফজলুল হক চলচ্চিত্রকার হিসেবেও পরিচিত ছিলেন এবং দেশের প্রথম শিশুতোষ সিনেমা ‘প্রেসিডেন্ট’ নির্মাণ করেন। এ টি এম ফজলুল হক ১৯৯০ সালের ২৬ অক্টোবর মারা যান। এই দম্পতির চার সন্তান ফরিদুর রেজা সাগর, কেকা ফেরদৌসী, ফরহাদুর রেজা প্রবাল ও ফারহানা কাকলী স্ব-স্ব ক্ষেত্রে স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব।